ক্রেতা নেই, অবরোধে শপিংমলগুলোতে বেচাকেনাও কম
রিকশা, মাঝেমধ্যে দুয়েকটি ছোট মিনি কাভার্ড ভ্যান, আর মানুষের হাঁটাচলা। রাস্তায় মালামাল নিয়ে মাঝেমধ্যে দু-একটি ভ্যান চলতে দেখা গেলেও দুই চাকার ঠেলাগাড়িগুলো একেবারেই উধাও। রাস্তার দুই পাশের সারি সারি দোকানগুলোতে কর্মচারীরা একা বা জটলা করে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত।
বিএনপি-জামায়াতের অবরোধের দ্বিতীয় দিনের এই চিত্র দেখতে দেখতে মোটরবাইকে উর্দু রোড, চকবাজার, মিটফোর্ড হয়ে বাবুবাজার ব্রীজের নিচ দিয়ে ইসলামপুর কাপড়ের মার্কেট পর্যন্ত পৌঁছতে সময় লাগলো মাত্র ২০-২৫ মিনিট, যা স্বাভাবিক সময়ে প্রায় অসম্ভব।
অলস বসে থাকা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হরতাল-অবরোধ থাকলে ঢাকার বাইরে থেকে ক্রেতারা আসতে পারেন না। ঢাকার অল্প কিছু ব্যবসায়ীরা হয়তো আসেন, সেটাও ঝুঁকি নিয়ে। সবমিলিয়ে ৭০-৮০ শতাংশ বেচাবিক্রি কমে গেছে।
পুলিশের পাহারায় দোকান খুললেও শঙ্কায় সময় কাটছে ব্যবসায়ীদের।
পাইকারি এই মার্কেট সহ খুচরা বেচাবিক্রিতে জনপ্রিয় নিউমার্কেট, বসুন্ধরা শপিং মল, ধানমন্ডির মেট্রো শপিং মল, রাপা প্লাজা, শ্যামলী স্কয়ার, মৌচাক মার্কেট, ফরচুন সহ ঢাকার মার্কেটগুলো ঘুরে দেখা গেছে, মার্কেটগুলো পুরোই ফাঁকা। বিক্রেতারা বলছেন, অবরোধে গাড়ি পোড়ানো সহ নানা আতঙ্কে ক্রেতারা শপিংমল মুখী হন না, যে কারণে বিক্রি নেই।
ইসলামপুর রোডের এশিয়ান প্লাজার ড্রিম জোন দোকানটিতে পাইকারি থ্রিপিস বিক্রি করা হয়। দোকানের ম্যানেজার সহ জনাতিনেক মানুষ বসে বসে সময় কাটাচ্ছিলেন। ম্যানেজার মো. জাভেদ মাহমুদ বলেন, '৮০% বিক্রি নেই। মানুষ স্বাভাবিক চলাচল করতে না পারলে তারা এখানে আসবে না। সেটাই হচ্ছে, ক্রেতারা আসতে পারছেন না, বিক্রিও নেই।'
একই অবস্থার কথা জানালেন, লাক্সারী ফেব্রিক্সের ম্যানেজার আব্দুল লতিফ। তিনি বলেন, 'ঢাকার বাইরে থেকে ক্রেতারা আসতে পারছেন না। যে কারণে বিক্রি নেই বললেই চলে।'
জানা যায়, ঢাকার কাপড়ের এই বড় বাজারটিতে ৬ হাজারের বেশি দোকান রয়েছে, যারা মূলত পাইকারি কাপড় ব্যবসায়ী। এই দোকানগুলোর জামাকাপড় তৈরির জন্য রয়েছে ছোট-বড় কারখানা। একটি ছোট্ট দোকান ও সেটার কারখানা মিলে কর্মচারীর গড় সংখ্যা অন্তত ১০ জন। বড় দোকানগুলোতে এ সংখ্যা আরও বেশি। এই হিসেবে এই মার্কেটের কাজকর্মের সঙ্গে ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ সরাসরি জড়িত; যাদের আয় উপার্জন এখন ঝুঁকির মধ্যে। ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছেন অবরোধ দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কায়।
ব্যবসায়ীরা জানালেন, পুলিশ পাহারা দিচ্ছে, দোকান খোলা হচ্ছে। কিন্তু বিক্রি না থাকলে দোকান খোলা রেখে খুব একটা লাভ নেই। দীর্ঘমেয়াদে এই অবস্থা চলতে থাকলে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ, কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ একটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে বলে মনে করছেন তারা।
ইসলামপুর ক্লথ মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইসিএমএ) সাধারণ সম্পাদক নাসের উদ্দিন মোল্লা টিবিএসকে বলেন, 'সরকার আমাদের প্রটেকশন দিচ্ছে, পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। আমরাও দোকান খোলা রাখছি। কিন্তু ক্রেতা আসতে না পারলে পণ্য বিক্রি হয় না।'
তিনি বলেন, '৭০ শতাংশের বেশি বিক্রি কমে গেছে। এই অবস্থার দ্রুত অবসান হওয়া জরুরী, নইলে ব্যবসায়ীরা টিকতে পারবেন না।'
তবে পাইকারী মার্কেটে ক্রেতা না থাকলেও নিউমার্কেটে কিছু ক্রেতার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। ব্যবসায়ীরা জানালেন, শীতের কারণে নিউমার্কেট, নূরজাহান মার্কেটে বাচ্চাদের কাপড়ের দোকানগুলোতে কিছু বেচাবিক্রি হচ্ছে। এই বাইরে বড়দের জামাকাপড়ের বিক্রি নেই।
নিউমার্কেটের ফ্যাশন কালেকশনের বিক্রেতা শরিফুল জানালেন, 'অবরোধ হলেই ক্রেতা আসতে পারে না। বিক্রি ৬০-৭০% কমে যায়। কিন্তু অবরোধ না থাকলেই প্রচুর ভিড় হচ্ছে বাচ্চাদের শীতের কাপড়ের দোকানগুলোতে।
বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের নিচতলায় 'সারা' ব্র্যান্ডের শোরুম। হালকা শীতের এই সময়টাতে শীতের জামা-জ্যাকেট বিক্রির ধুম পড়ে যায় ব্র্যান্ডটিতে। অথচ এদিন গিয়ে দেখা গেল ক্রেতার জন্য 'হাহাকার'।
শোরুমের ম্যানেজার তরিকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'অবোরোধের আগে তুলনা করলে আমাদের বিক্রি প্রায় ৭০% কমে গেছে। ক্রেতা খুবই কম আসছে মার্কেটে।'
বসুন্ধরার 'জেন্টাল পার্কে'র সিনিয়র সেলসম্যান মেহেদি হাসান বলেন, 'আমাদের বিক্রি ৬০% কমে গেছে।'
একই অবস্থা ধানমন্ডির মেট্রো শপিং মলের। শীতের শুরুর এই সময়টা দেশে অনেক বিয়েশাদির অনুষ্ঠান হয়। চাহিদা বাড়ে শাড়ির। বিকালে মার্কেটের শাড়ির শো-রুম নীল আঁচল শাড়ি'জ এর ম্যানেজার মোহম্মদ ফারুক আহমেদ বলেন, 'অবরোধে বিক্রি চারভাগের তিনভাগই কমে গেছে। সাধারণত আমাদের ক্রেতা যারা, তারা নিজস্ব গাড়ি নিয়ে বের হয়। এখন শপিং করার জন্য ঝুঁকি নিয়ে তারা বের হচ্ছে না। যদি গাড়ি ভেঙ্গে ফেলে।'
তিনি বলেন, 'আমাদের দোকানে কর্মচারি আছে ৮ জন। সবাই বসে আছি, ক্রেতা নেই কাজ নেই।'
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে সব ধরনের খাদ্যপণ্য, ব্যবহার্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছু্র চড়া দামের কারণে জামা-কাপড়ের বিক্রি কয়েক মাস ধরেই কিছুটা নিম্নমুখী। তারপরও একটা বেচাবিক্রি ছিল। কিন্তু হরতাল-অবরোধে এটা একেবারেই তলানিতে নামিয়ে দিয়েছে।
ফ্যাশন আন্ট্রাপ্রেনারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি এবং ফ্যাশন হাউস অঞ্জনসের মালিক শাহীন আহমেদ বলেন, 'এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে অনেকে দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়বে। সামনে কিভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাব তা অনিশ্চিত। এ কারণে আমরা চাই রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে যাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়।'