ড. কামালের গণফোরাম: নির্বাচনে থেকেও নেই!
বাহাত্তরের সংবিধান প্রণেতাদের একজন ড. কামাল হোসেনের দল গণমোরাম আসন্ন নির্বাচনে আছে, আবার একপ্রকার নেই। গণফোরামের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি নিলেও তিনি আছেন ইমেরিটাস সভাপতি হিসেবে। তিনি নেই কোনও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে।
তবে দলের নতুন সভাপতি মফিজুল ইসলাম খানসহ দলের ৯ জন আসন্ন নির্বাচনে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। দলের নেতারা বলছেন ড. কামাল হোসেনের পরামর্শেই তারা নির্বাচনে এসেছেন। তবে মনোনয়ন জমা দেওয়া গণফোরামের ৪টি মনোনয়ন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন।
মোস্তফা মহসীন মন্টু ও অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন গণফোরামের আরেকটি অংশ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে রয়েছে। তারা নিয়মিত সরকার পতনের কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন।
যদিও দলটি গত নির্বাচনে বিএনপিকে সাথে নিয়ে গড়েছিলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তার দল ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করলেও ড. কামাল গত নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ২০১৮ নির্বাচনে ২৭টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ২টি আসনে জয় পায়।
দলটির বর্তমান সভাপতি মফিজুল ইসলাম খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা ড. কামাল হোসেনের পরামর্শ নিয়েই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। আমরা বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের সাথে নেই। কারো সাথে সমঝোতার মধ্যেও নেই। আমরা আমাদের দল নিয়ে নির্বাচনে যাচ্ছি।"
তিনি আরও বলেন, দলের যারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না তারা মূল দলের কেউ না। গণফোরাম নিবন্ধিত দল হিসেবেই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
আসন্ন নির্বাচনে গণফোরাম থেকে ৯টি আসনে তাদের প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন এবং সেখানে সাবেক সংসদ সদস্য সিলেট-২ আসনে মোকাব্বির খান সহ ৪ জনের মনোনয়ন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। দলটি জানিয়েছে তারা বাদ পড়াদের প্রার্থীতা ফিরিয়ে আনতে বুধবার আপিল করবেন।
মফিজুল ইসলাম খান বলেন, "সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমরা অন্তত ৫টি আসনে জয়ের প্রত্যাশা করি। আমি নিজে মানিকগঞ্জ-৩ থেকে নির্বাচন করছি।"
তবে যাদের নিয়ে আসন প্রাপ্তির প্রত্যাশা করেছিলেন তাদের অনেকেরই মনোনয়ন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। সিলেট-২ এর মোকাব্বির খান, কুমিল্লা-৫ এর আলীমুল ইহসান, কুমিল্লা-১১ এর আবদুর রহমান জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন বাতিল করেছে ইসি।
এ বিষয়ে দল বলছে, বাদ পড়াদের প্রার্থীতা ফিরিয়ে আনতে আইনি প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে তারা।
আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করে গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেন জীবনে একবারই সংসদ সদস্য হয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে। জাসদের প্রার্থী শাহজাহান সিরাজকে হারিয়ে তখনকার ঢাকা-১৪ আসন থেকে জিতেছিলেন তিনি।
এরপর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনে একাধিকবার হেরেছেন ড. কামাল। একেকবার দাঁড়িয়েছেন একেকটি আসন থেকে, কিন্তু জয় আসেনি।
আওয়ামী লীগ থেকে যখন নির্বাচন করেছেন, প্রতিবার দ্বিতীয় হয়েছেন। আর নিজের দল গণফোরামের প্রার্থী হয়ে নগণ্য সংখ্যক ভোট পান। জামানত হারিয়েছেন বেশ কয়েকটি নির্বাচনে।
ড. কামাল হোসেন ১৯৯২ সালের আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসে গঠন করেন গণফোরাম। দলটি ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে ১০৪টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ৫৪ হাজার ২৫০টি ভোট পায়। কামাল হোসেনসহ সকল প্রার্থীই তাদের জামানত হারায়।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, গত নির্বাচনে গণফোরাম ২৭টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ২টি আসনে জয় পায়। ২০১৮ সালে ২৭ প্রার্থী মোট ৫ লাখ ২ হাজারের কাছাকাছি ভোট পায়। ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপির সাথে একত্রে বয়কট করে গণফোরাম।
২০০৮ এর নির্বাচনে ৪৫টি আসনে প্রার্থী দিয়েও কোনও আসনে জয় পায়নি গণফোরামের কোনও প্রার্থী। এ নির্বাচনে গণফোরামের প্রার্থীরা মোট ৭২,৯১১টি ভোট পায়। প্রায় সকল প্রার্থীরই জামানত হারায় এ নির্বাচনে।
২০০১ সালের নির্বাচনে গণফোরাম ১৭টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ভোট পায় মাত্র ৮,৪৯৪টি। কোনও আসনের প্রার্থী জয়ী হতে পারেনি বরং সকলেই তাদের জামানত হারিয়েছেন।
২০০১ সালে ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুর আসন থেকে শেষ ভোটে লড়েছেন ড. কামাল, সেবারও জামানতের শেষ রক্ষা হয়নি। ৬,১৮৭ ভোট পেয়ে হারার পর জনতার মন জয়ের লড়াইয়ে ক্ষ্যান্ত দেন ড. কামাল। তারপর আর ভোটে নামেননি।
এরপর সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরেই ছিলেন বর্তমানে ঐক্যফ্রন্ট নেতা। তবে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনি আবার সরব হন। তখন তার 'ডকট্রিন অব নেসেসিটি'র তত্ত্বটি তত্ত্বাধায়কের তিন মাসের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বিষয়টি ছাড়িয়ে যেতে ভূমিকা রাখে।
সাংবিধানিক গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলেও ছদ্ম সেনা শাসনের একটি সরকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার ব্যাখ্যা কখনো দেননি ড. কামাল।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় এলে রাজনীতিতে কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিলেন ড. কামাল। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তার তৎপরতা চোখে পড়েনি।
গত ২৭ অক্টোবর ড. কামাল অব্যাহতি নেন। তখন এক লিখিত বক্তব্যে ড. কামাল হোসেন বলেন, "আমার বয়স এবং শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় এখন আর সক্রিয়ভাবে সভাপতির দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। এমতাবস্থায় আমি সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে, তথা গণফোরাম-এর সভাপতি পদ থেকে অব্যাহতি নেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছি।"
ড. কামাল হোসেন বলেন, তিনি ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে দেশ ও জাতির জন্য সাধ্য মোতাবেক অবদান রাখার চেষ্টা করবেন। দলের প্রতি সহযোগিতা ও পরামর্শ সব সময়ই থাকবে।
যুবক বয়সেই আইনজীবী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন কামাল হোসেন। নজরে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন, তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য সম্পদ হবেন। সেই ভাবনা থেকে স্বাধীন দেশে ঠাঁই দেন মন্ত্রিসভায়। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
১৯৭২ সালে প্রণীত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে ছিলেন। ১৯৭৩ সালে নির্বাচনের পর তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেন বঙ্গবন্ধু। পরের বছর দায়িত্ব দেওয়া হয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের।