চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত এক মাসে কমেছে ৮০%
বাংলাদেশের চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত অক্টোবরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে মাত্র ২৩৩ মিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে, যা আগের মাসের তুলনায় চার-পঞ্চমাংশ কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, আমদানি বৃদ্ধি, রপ্তানিতে মন্থর গতি এবং রেমিট্যান্সের নেতিবাচক প্রবণতার কারণে চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত কমেছে। অথচ সেপ্টেম্বরেই দেশে চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত ছিল ১.২ বিলিয়ন ডলার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত কমে আসায় এক্সচেঞ্জ রেট ও বৈদেশিক মুদ্রায় এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে।
ব্যালেন্স অব পেমেন্টের মূল উপাদান হিসেবে কাজ করে ব্যালেন্স অব ট্রেড (পণ্যের আমদানি বিয়োগ করে শুধু রপ্তানি), বিদেশ থেকে নেট আয় এবং নেট কারেন্ট ট্রান্সফার।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, "আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আগের তুলনায় কমেছে। এছাড়া রেমিটেন্সে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ব্যালেন্স অব পেমেন্টে আমাদের কমফোর্ট জোন ছিল চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত। এখন সেটাও কমে আসছে।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, চলতি হিসাব ভারসাম্য কমার অন্যতম কারণ হচ্ছে আমদানি বৃদ্ধি। নতুন অর্থবছরের জুলাই থেকে প্রতি মাসে আমদানি হয়েছে ৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। তবে অক্টোবরে আমদানি ছিল প্রায় ৫.৫ বিলিয়ন ডলার। ফলে ট্রেড ব্যালেন্স এবং কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সে এর প্রভাব পড়ে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৬৭%। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে প্রবৃদ্ধির হার কমে ৩.৬১% হয়েছে। অন্যদিকে, রেমিট্যান্স প্রবাহ আগের অর্থবছরের তুলনায় ৪.৩৫% কমেছে।
বৈদেশিক ঋণের অর্থ পরিশোধের বেলায় একটি দেশের প্রাথমিক উৎস হলো চলতি হিসাব ভারসাম্য। যখন একটি দেশের চলতি হিসাব ভারসাম্য ঋণাত্মক হয়ে যায়, তখন তাদেরকে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ পরিশোধ করতে হয়। ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ঋণাত্মক হয়ে গেলে সরাসরি রিজার্ভ থেকে অর্থ পরিশোধ করা হয়।
ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট; স্বল্প, মধ্য, দীর্ঘমেয়াদী ঋণ, এবং ট্রেড ক্রেডিটের সমন্বয়ে গঠিত আর্থিক হিসাবের ঘাটতি অক্টোবরে কিছুটা কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, চার মাসে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩.৯৭ বিলিয়ন ডলার; যা সেপ্টেম্বর থেকে ১১২ মিলিয়ন ডলার কমেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে আর্থিক হিসাবের উদ্বৃত্ত ছিল ১.২৮ বিলিয়ন ডলার।
জাহিদ হোসেন বলেন, আর্থিক হিসাবের ঘাটতি কিছুটা কমলেও তা খুব বেশি নয়। ট্রেড ক্রেডিট ঘাটতি ৩.৬৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ রপ্তানিকারকরা তাদের পুরো পেমেন্ট দেশে আনছেন না।
"এর একটি কারণ হলো, রপ্তানিকারকরা ডলারের জন্য কম রেট পাচ্ছেন। রপ্তানিকারকদের জন্য এখন নির্ধারিত ডলার রেট ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা। অথচ ব্যাংকগুলো ১২৩ টাকায় রেমিট্যান্স কিনছে। যদি ডলারের হার বাজারের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত না হয় তবে ট্রেড ক্রেডিট ঘাটতি বাড়তে পারে," তিনি বলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কমে যাওয়ায় আর্থিক হিসাবের ঘাটতি বাড়ছে। পরিশোধের পরিমাণ নতুন স্বল্পমেয়াদী ঋণের পরিমাণকেও ছাড়িয়ে গেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে নতুন ঋণের চেয়ে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার বেশি। অন্যদিকে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১৭ শতাংশ কম পাওয়া গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "আমরা এখন কম বৈদেশিক ঋণ পাচ্ছি। বিদেশি বিনিয়োগও সেভাবে বাড়ছে না। এর একটি কারণ হলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা আমাদের নেতিবাচক রেটিং দিয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগে আরও অনীহা দেখাচ্ছে।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের অক্টোবরে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি হয়েছে ৯৬ টাকায়। সর্বশেষ চলতি বছরের নভেম্বরে ডলার রেট ছিল ১১০ টাকা ২৫ পয়সা। এ কারণে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের খরচ অনেক বেড়ে যায়।
জাহিদ হোসেন বলেন, "আমাদের ঋণের প্রাপ্যতা কমে গেছে। অর্থাৎ অনেক ক্ষেত্রেই আমরা ঋণ নিতে চাই কিন্তু পাই না। স্বল্পমেয়াদি ঋণ পাওয়ার একটি বড় কারণ আত্মবিশ্বাসের অভাব।"
আমদানি কমলেও অক্টোবরে বাংলাদেশের বাণিজ্য ভারসাম্যে (রপ্তানি এবং আমদানির মধ্যে পার্থক্য) ঘাটতি বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি ৩.৮১ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, যা জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের ১.৮২ বিলিয়ন ডলার থেকে বেশি।
তবে আগের অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর শেষে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৯ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এবার দেশের বাণিজ্য ঘাটতি অনেকটাই কমেছে।
সেপ্টেম্বর শেষে দেশের সামগ্রিক ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ঘাটতি ছিল ৩.৮৩ বিলিয়ন ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার কম।