ভারতে, সবকিছুর জন্য একটা করে অ্যাপ আছে, এমনকি পাবেন আদর্শ সন্তান গড়ার অ্যাপও
আপনি কি ভারতের ধনকুবের রতন টাটার ব্যবসায়িক বুদ্ধি, আধ্যাত্মিক গুরু স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাশক্তি, পারমাণবিক সাফল্যের নায়ক এপিজে আব্দুল কালামের মতো বৈজ্ঞানিক প্রতিভাসম্পন্ন করে নিজের সন্তানকে বড় করতে চান? তাহলে দেশটিতে এক্ষেত্রে সহযোগী হিসেবে শুধু একটি নয়, বরং রয়েছে বেশ কয়েকটি অ্যাপ।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারতের মায়েরা সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের আঙ্গিকে সন্তানদের লালন-পালন করে থাকে। এটিকে মাতৃত্বের উত্তরাধিকারের সূত্রে 'গর্ভ সংস্কার' নামেও অভিহিত করা হয়। যেখানে একটি শিশুর লালন-পালন ও ধর্মীয় মূল্যবোধ শেখানোর জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়।
কিন্তু বর্তমানে ভারতে সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র প্রাচীন পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয় না। বরং এখন শিশুদের বড় করার দীর্ঘ পথে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। যেখানে মায়েরা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
ছোট-বড়ও বেশ কয়েকটি স্টার্টআপ এমন কিছু অ্যাপ বাজারেও ছেড়েছে। এগুলো বৈজ্ঞানিক গবেষণার সাথে প্রথাগত প্রসবপূর্ব এবং প্রসবোত্তর সন্তান লালন-পালনের রীতিনীতিগুলোকে সামঞ্জস্য করে। এর মধ্যে রয়েছে সুস্থতার চর্চা ও খাদ্যতালিকাগত পরিকল্পনা; যা যোগব্যায়াম, ধ্যান, গল্প পড়া ও শিশু সঙ্গীত শোনার মতো ইতিবাচক বিষয়কে একত্রিত করে৷
এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে চমকপ্রদ অ্যাপগুলো তৈরি করা হয়েছে। এটি ব্যবহার করে মায়েরা স্মার্টফোনের মাধ্যমে নানা বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে। ঠিক তেমনি একটি অ্যাপ 'গর্ভ সংস্কার গুরু'।
ভারতে সন্তান লালন-পালনে পুরানো পন্থা ও নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তির মধ্যে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে অনেকেই মনে করছেন, ভারত নিজেদের জাতীয়তাবাদ প্রাধান্য দেওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্কৃতিগুলোও আয়ত্ত করতে পারে। অ্যাপ ডেভেলপাররা সার্বিক বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে নতুন আঙ্গিকে সন্তানদের বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
বহুকাল ধরেই ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে দূরে সরিয়ে বরং ঘৃণা ও বিভাজনের বিস্তারের জন্য স্মার্টফোনকে দায়ী করা হয়েছে। তবে বিষয়টিকে অন্তত এখন একচেটিয়াভাবে বিচার করাটা যুক্তিযুক্ত মনে হবে না।
অন্যদিকে গর্ভাবস্থায় নারীদের একদিকে তীব্র উদ্বেগ ও চাপকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। একইসাথে এই সময়টাতে দম্পতিদের মধ্যকার পারস্পরিক বোঝাপড়ার দরকার হয়ে থাকে।
ঠিক তেমনি একজন এক দম্পতি জিগনেশ ও ধরা। গত বছর তারা নিজেদের দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। তখন পিতা-মাতা ও তাদের বড় সন্তান সকলেই একটি অ্যাপ ব্যবহার করেছেন। যেটি ব্যবহার করে গল্প বলা কিংবা শিশুতোষ গান গাওয়া ইত্যাদি করা হয়েছে। কখনও কখনও তারা মায়ের পেটে হাত রাখতেন এবং অনাগত শিশুর উদ্দেশে বলতেন "আমরা তোমাকে এই পৃথিবীতে স্বাগত জানাই।"
সেক্ষেত্রে অ্যাপগুলো ব্যবহারের আগে ঠিক করতে হবে পিতা-মাতা কেমন সন্তানের প্রত্যাশা করছেন। সেই অনুযায়ী প্ল্যাটফর্মগুলোতে একটি চার্ট পূরণ করতে হয়; যা 'ড্রিম চার্ট' নামে পরিচিত। ঐ চার্ট অনুযায়ী অ্যাপগুলো নির্দেশনা সাজিয়ে ফেলে।
১৭ মাস বয়সী ঠিক তেমনি একটি শিশু ধ্যাই। তার জন্য বানানো চার্টে রয়েছে সুন্দর চুলের মিষ্টি হাসির ছবি। এতে সনাতন ধর্মাবলম্বীর দেবতা কৃষ্ণ ও শক্তির দেবতা হনুমানের ছবিও রয়েছে। এছাড়াও অ্যাপটিতে স্যুট পরিহিত বিশিষ্ট শিল্পপতি রতন টাটার হাসিখুশি ছবিও ছিল।
পাম্ভার নামের এক নারীর পরিবার অনলাইনে খাবারের ব্যবসা করেন। সন্তানের ক্ষেত্রে তারা অধিক উচ্চতার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। তাই এমন প্ল্যাটফর্ম তারা ব্যবহার করছেন।
জিতেন্দ্র টিমবাদিয়া ও তার স্ত্রী চেতা ধাভাক 'ড্রিম চাইন্ড' নামের একই ধরনের একটি অ্যাপস চালু করেছেন। প্ল্যাটফর্মটি অল্প দিনেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
এ সম্পর্কে টিমবাদিয়া বলেন, "গর্ভাবস্থার ছয় মাস থেকে চার বছর পর্যন্ত একটি শিশুর পুরো জীবনের নীলনকশা তৈরি করা হয়। আর এখনকার মায়েরা বৈজ্ঞানিকভাবে উপযুক্ত ব্যাখ্যা ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নিতে রাজি হয়না।"
২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করা 'ড্রিম চাইন্ড' অ্যাপটির বর্তমানে পেইড ব্যবহারকারী রয়েছে ১৫ হাজার জন। এক্ষেত্রে ৯ মাসের জন্য ব্যাসিক প্যাকেজের মূল্য ২৫ মার্কিন ডলার; যেখানে নির্দিষ্ট কিছু সুবিধা চালু রাখা হয়েছে। আর হাইব্রিড প্যাকেজের মূল্য ১০০ থেকে ১৮০ ডলার। যেখানে প্রতিদিন অ্যাপ রুটিন ও অফলাইন ওয়ার্কশপের তথ্য জানানো হয়।
অফলাইন ওয়ার্কশপের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইয়োগা ও ব্যায়ামের ব্যবস্থা। যেমন, অ্যাপটির অফিস গুজরাটের সুরাটে ২০ জনের একদল নারী এই প্রশিক্ষণ নিয়েছিল।
ঐ ওয়ার্কশপে গিয়েছিলেন ২৬ বছর বয়সী হেতাল পান্ডব; যিনি পেশায় একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ। তিনি তখন নিজের প্রথম গর্ভাবস্থার তৃতীয় মাসে ছিলেন।
নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে যেয়ে হেতাল বলেন, "সাধারণ পরিবার থেকে শুরু করে এমনকি শিক্ষিত পরিবারগুলোতেও লোকজন গর্ভাবস্থায় করণীয়গুলো সম্পর্কে খুব বেশি একটা আলোচনা করা হয় না। এদিকে ওয়ার্কশপে উত্তেজনা, উদ্বেগ ও পরিবারের নানা ফ্যাক্টরগুলো নেই। এখানে শুধুই আমরা এবং আমাদের শিশুরা।"
এছাড়াও ড্রিমচাইল্ড অ্যাপ প্রতিনিয়ত 'আপনার গর্ভাবস্থাকে সুখী ও আত্মবিশ্বাসী করুন' নামে বড় সেমিনারের আয়োজন করে। গত সেপ্টেম্বর মাসেই প্রায় ৫০০ দম্পতি আহমেদাবাদের একটি বড় অডিটোরিয়াম এমন একটি সেমিনারে অংশ নেন। যেটি দেখতে অনেকটা 'চাকরি মেলা' এর মতো মনে হয়েছে।
ঐ সেমিনারে পিতা-মাতারা সন্তানদের প্রত্যাশিত গুণাবলি সম্পর্কে নিজেদের মনোভাব প্রকাশ করেন। তারা সন্তানের মাঝে আত্মবিশ্বাস, সৃজনশীলতা, সহানুভূতি, জাতীয় গর্ব, সততা ইত্যাদি নানা গুণের কথা বলেন।
সম্প্রতি 'গর্ভ সংস্কার গুরু' অ্যাপের প্রতিষ্ঠাতা প্রশান্ত আগারওয়াল অনলাইনে একটি সেমিনারের আয়োজন করেন। প্ল্যাটফর্মটিতে ১৮ হাজার পেইড সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। তার ঐ সেমিনারে ১২৫ জন অংশ নিয়েছিলেন। যেখানে তিনি সন্তান লালন-পালন নিয়ে নানা উপদেশ প্রদান করেন।
এরপর আগারওয়াল অ্যাপের সাবস্ক্রিপশন নিয়ে কথা বলেন। সেখানে তিনি সেশনটি শেষ হওয়ার ৩০ মিনিটের মধ্যে সাইন আপ করা ব্যক্তিদের জন্য ডিসকাউন্টের ঘোষণা দেন।
তখন পায়েল নামের এক অংশগ্রহণকারী জিজ্ঞাসা করেন, ডিসকাউন্টের অফারটা বিকেল পর্যন্ত থাকবে কি-না। কেননা প্লাটফর্মটিতে সাবস্ক্রিপশন করার ক্ষেত্রে তাকে তার স্বামীর সাথে কথা বলতে হবে।
অন্যদিকে পাম্ভর সন্তান জন্মদানের সময় এমনি একটি অ্যাপ ব্যবহার করেছেন। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় সন্তানের ক্ষেত্রে তার প্রত্যাশা অনুযায়ী ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মিল পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
পাম্ভর বলেন, "গর্ভ ধারণের নয় মাস ধরে আমি ভেবেছিলাম, 'ও বড় কিছু করবে।' আবদুল কালাম যেভাবে করেছিলেন। যিনি দেশের পারমাণবিক কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়েছিলেন এবং পরে ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।"
পরিশেষে একটি হাসি দিয়ে তিনি বলেন, "তবে চাপের কিছু নেই।"