নির্বাচন এবং প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক
স্কুলে একসময় ঘণ্টা বাজানোর প্রচলন ছিল। আমাদের কিশোর বেলায় প্রাইমারি স্কুল ঘণ্টা বাজিয়ে স্কুল শুরুর ঘোষণা দিত। ঘণ্টা পড়ার সাথে সাথে ক্লাসে প্রবেশ করতে হতো। এই ছিল নিয়ম।
বাংলাদেশের নির্বাচনী ঘণ্টা পড়ে গেছে। নির্বাচনের ঘণ্টা পড়ার সাথে সাথে নির্বাচনে অংশ নেওয়াটাই জনগণের দায়িত্বে পড়ে তখন। কিন্তু গত কয়েকটি নির্বাচন জনগণের দায়িত্ববোধ ভুলিয়ে দিয়েছে। গণমাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের আলোচনার উদ্ধৃতিতেও উঠে এসেছে এদেশের ভোট ব্যবস্থার কথা; রাতের ভোটে রূপান্তরিত হওয়ার কথা। যে কারণে তিনি প্রায়সই বলে থাকেন অতীতের মতন এবার রাতের ভোটা হবে না। ধন্যবাদ তাকে এই সত্য বারবার উদ্ধৃতি করার জন্য। এই ভোট ব্যবস্থার সাথে জনগণের আত্মার সম্পর্ক সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। ফলে নির্বাচনী ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে জনগণের নির্বাচনের সাথে সম্পর্কিত হওয়া যেন এক দূর অতীত।
নির্বাচন সম্পর্কিত ইতিহাসের চর্চা বহুবার হয়েছে। আবার নতুন করে বর্তমানে নির্বাচন নিয়ে ভবিষ্যতে চর্চা হবে। তবে নির্বাচনী ঘণ্টা বাজার পরে জনগণের সম্পৃক্ততা যতখানি হওয়ার কথা কিংবা জনগণকে যতখানি উৎসাহী হতে দেখার কথা তার কোনোটাই যে হয়নি সুনিশ্চিতভাবে বলা যায়। নির্বাচনী আবহাওয়া তৈরি করার জন্য এই প্রথম এক নতুন কৌশল ক্ষমতাসীন দল গ্রহণ করেছে। তারা বলছেন- যেখানে প্রয়োজন নেই, সেই সমস্ত জায়গায় দলীয় প্রার্থীদের স্বতন্ত্র প্রার্থীতা প্রত্যাহার করতে হবে, যদিও তার সময় এখন আর নেই। সাংবিধানিক জায়গা থেকে বলা যেতে পারে এর বৈধতা আছে। কিন্তু দলটির নিজস্ব গঠনতন্ত্রে এটি বৈধ নয়।
নির্বাচনের বৈধতা সৃষ্টির লক্ষ্যে দলের পরিচিত রাজনৈতিক কর্মীদেরকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য দলের প্রতীকের বাইরে এসে নির্বাচন করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অথচ এই দেশের সংবিধানেই ৭০ এর (খ) ধারা অনুসারে বলা আছে, দলের অনুমতি ছাড়া আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংসদে কোনো সাংসদ ভোট দিতে পারবেন না। এক্ষেত্রে তার সংসদ সদস্যকে পদ হারাতে হতে পারে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার যে কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে, তা কি সত্যি সত্যিই নির্বাচনকে অর্থবহ করতে পারবে? নাকি দলটির মধ্যে বিভাজন তীব্র হবে?
দলটির গঠনতন্ত্র অনুসারে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার বিধান রয়েছে। যা ইতোপূর্বে বহুবার বিভিন্ন নির্বাচনের সময় কার্যকর করতে দেখা গেছে। এবারের নির্বাচনের পূর্বে দলটির গঠনতন্ত্রের ঐ ধারা বিলুপ্ত না করেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা ক্ষমতাসীন দলটির গঠনতন্ত্র বিরোধী।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি গণমাধ্যমে নানান মন্তব্য করেছেন, এদের মধ্যে অন্যতম বিজেপির জে আকবর সাহেব। তিনি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে একটি 'স্থিতিশীল সরকার' দেখতে চায় ভারত। জনাব জে আকবর বিজেপি সরকারের দ্বিতীয় দফার শুরুতে বিজেপিতে যোগদান করেন। একসময়ের আনন্দবাজার গ্রুপের ডেইলি টেলিগ্রাফ ও টাইমস অফ ইন্ডিয়া পত্রিকার প্রধান সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
জে আকবর প্রথমে ভারতীয় বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপির পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে 'হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন'- এর মাধ্যমে নারীদের যৌন হয়রানীর অভিযোগ উত্থাপিত হয়। এবং অভিযুক্ত হয়ে পদত্যাগের বাধ্য হয়েছিলেন এই জে আকবর। তিনি ঝাড়খন্ড থেকে রাজ্যসভার সদস্য হয়েছিলেন সেই সময়। বর্তমানে তিনি বিজেপির কোনো সাংগঠনিক কাঠামোতে কিংবা সংসদ সদস্যও না। তাকে বিজেপি সরকার মন্ত্রিত্ব থেকে বাদ দিয়েছিল হ্যাশ ট্যাগ মি টু আন্দোলনের পরে পরে।
একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের প্রাক্তন হাইকমিশনার পঙ্কজ সরণ। তিনিও একইভাবে আগামী নির্বাচনে এক স্থিতিশীল সরকারের কথা বলেছেন। স্থিতিশীল সরকারের কথা বলেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিভাগের অধ্যাপক ইমন কল্যাণ লাহিড়ী। তিনি সিঙ্গাপুরে প্রকাশিত সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট পত্রিকায় এক নিবন্ধে এই স্থিতিশীলতার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ২০০১ সালে বিএনপি জামায়াত সরকারের কথা। ভারতীয় পক্ষে এই স্থিতিশীলতার প্রয়োজনীয়, কারণ তিনি কিছুটা ব্যাখ্যা করেছেন। অন্য দুজন তাদের বলা 'স্থিতিশীলতার' কোনো আংশিক বা পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা করেননি।
আসলে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই এই দুই দেশের প্রতিবেশী সম্পর্কে রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রের সম্পর্ক পর্যায়ে যথাযথভাবে গড়ে ওঠেনি। বঙ্গবন্ধুর স্বল্প শাসনের পরেই দেশ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী রাজনীতিবিদদের এক প্লাটফর্মে রূপান্তরিত হয়েছিল। ১৯৭৫ উত্তর বাংলাদেশে দালালি আইনে আটক ও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে মুক্তি পাওয়া অনেক ব্যক্তিকে রাজনৈতিক মঞ্চে আরোহণ করতে দেখা যায়। বাংলাদেশে জামাত ইসলাম নিষিদ্ধ দল। এই দলের তদানীন্তন আমির মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অবস্থান নেওয়ার ফলে দেশে নাগরিকত্ব হারান। নাগরিকত্ব হারানো গোলাম আযম দেশে ফিরে আসেন সম্ভবত ১৯৭৭ সালে। পরবর্তীকালে দলটি নিবন্ধন ফিরে পেলে গোলাম আজম আমিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এই দলটি নানান ভাবে ভারত বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করতে থাকে। দলটির আমির গোলাম আযম ১৯৭১ সনের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উপস্থিত হয়েছিলেন। সাধারণ পরিষদের বক্তৃতায মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের একটি ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। পরবর্তীকালে ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে জামায়াত বিএনপির সাথে সম্মিলিত জোট গঠন করে। ভারত বিরোধী অবস্থানকে আরও জোরালো করে। ২০০১ এর সাধারণ নির্বাচনের পরে পরেই দেশের নানান প্রান্তে সংখ্যালঘু ধর্ম অবলম্বীদের ওপর নির্যাতনের বেশ কিছু ঘটনা সামনে আসে। এই জোটের ভারত বিরোধী পুরনো ধারা এখনো আমরা মাঠে ময়দানে দেখতে পাই। আজকে নির্বাচন বর্জনকারী এ দলটি এবারও রাস্তায় ভারত বিরোধী স্লোগান দিচ্ছে।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে আরও বেশকিছু ঘটনা আমরা দেখতে পাই। এই বিএনপি জামায়াত জোটের ক্ষমতায় থাকাকালীন সেই দশ ট্রাক অস্ত্রের কথা আমরা জানি। আমরা জানি, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সাথে দলীয় প্রধানের সাক্ষাতের অস্বীকৃতির ইতিহাস।
কোনো দেশ তার প্রতিবেশী পছন্দ করতে পারে না। আজকের পৃথিবীর অর্থনীতি এবং উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই বর্তমান সরকারি দলের সাথে ভারত রাষ্ট্রটির একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ভারত স্বস্তিতে থাকে যখন এই রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে। অতীতে ভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য উলফা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তার অভিযোগ প্রমাণিত সত্য। ফলের ভারতের ক্ষমতাসীনদের পক্ষে গণতন্ত্র মুক্ত ভোট ইত্যাদি প্রধান বিষয় নয়। তাদের রাজনৈতিক স্বার্থটাই এখানে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ক্ষমতার সময়ে ভারতের পূর্বাঞ্চলের উলফা মুক্ত হয়েছে। স্থিতিশীল সরকার চাওয়ার প্রধান কারণ সম্ভবত এগুলোই।
প্রতিবেশী ভারতের মতন অর্থনৈতিক শক্তির সাথে বিরোধিতা করে আগামী দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা যাবে না, এটাও একটা বিবেচনার বিষয়। বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতি ব্যাপকভাবেই প্রতিবেশী দেশটির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। অধিক জনসংখ্যার বাংলাদেশে খাদ্যক্ষেত্রে পৃথিবীতে এখন তৃতীয় আমদানিকারক দেশের রূপান্তরিত হয়েছে। খাদ্যশস্যের একটি বিশাল অংশ আমরা ভারত থেকে আমদানি করে থাকি, যদিও ভারতের নিজস্ব প্রয়োজনে আমাদেরকে নানান সময়ে সংকটে পড়তে হয়। তবুও প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে কৃষিপণ্য আমদানি করা আমাদের জন্য সাশ্রয়ী একথা মানতেই হবে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়