ইউক্রেনের রাশিয়ার মতো পর্যাপ্ত গোলাবারুদের যোগান নেই, হুমকির মুখে কিয়েভের ২০২৪
ইউক্রেন যুদ্ধে বড় ভূমিকা রাখছে উভয়পক্ষের আর্টিলারি বা কামান। বিপুল পরিমাণ গোলা প্রতিদিন ব্যবহার হচ্ছে। তাই গোলা বা আর্টিলারি শেলের বিশাল চাহিদাও রয়েছে। যুদ্ধের জন্য নিজস্ব উৎপাদনের পাশাপাশি, উত্তর কোরিয়ার মতোন মিত্রদের থেকেও গোলা কিনছে রাশিয়া। অন্যদিকে, ইউক্রেনের ভরসা ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া চালান। তবে রাশিয়া যেভাবে গোলা পাচ্ছে, সে তুলনায় ইউরোপ পর্যাপ্ত পরিমাণে দিতে পারছে না কিয়েভকে। এই অবস্থায়, বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী বছরে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চ্যালেঞ্জের মধ্যেই পড়তে হবে ইউক্রেনকে।
পরিস্থিতির গভীরতা বুঝতে একটু পেছনে ফিরে দেখা দরকার। এ বছরের মার্চে ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে ইউক্রেন মাসে আড়াই লাখ করে গোলার সরবরাহ চেয়েছিল। দেশটির তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেক্সি রেজনিকভ বলেছিলেন, যুদ্ধ পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতি মাসে অন্তত সাড়ে তিন লাখ শেল দরকার। মিত্রদের কাছে তার চেয়ে কমই চাওয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, মাসে এক লাখ ১০ হাজার গোলা রেশনিং করে ব্যবহার করছে ইউক্রেন। এই অবস্থায়, যুদ্ধের ময়দানে এগিয়ে থাকার জন্য ইউরোপের সাহায্য দরকার। এই সাহায্য লড়াইয়ে প্রকৃত পার্থক্য গড়ে দেবে।
এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিশ্রুতি দেয়, এক বছরের বছরের মধ্যেই অন্তত ১০ লাখ গোলা দেওয়া হবে। অর্থাৎ, ইউক্রেন যা চেয়েছিল– তার মাত্র তিন-ভাগের এক ভাগ সরবরাহের অঙ্গীকার করে ইইউ। নভেম্বর মাস শেষে, বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের সেনাবাহিনীর মজুত থেকে তিন লাখ গোলা দিয়েছে ইইউ।
আগামী বছরের মার্চে প্রতিশ্রুতিতে উল্লেখ করা সময় এক বছর পূর্ণ হবে, অর্থাৎ আগামী চার মাসের মধ্যেই বাকি থাকা সিংহভাগ সরবরাহ দিতে হবে। কিন্তু, সেখানেও সমস্যা রয়েই গেছে। নতুন গোলা উৎপাদন করে, তারপর এই সহায়তা দিতে হবে বলে জানিয়েছেন ইইউ এর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল।
গত ১৪ নভেম্বর ইইউ-ভুক্ত দেশগুলোর প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের এক সভায় তিনি একথা বলেন।
তাঁর এ কথায় স্পষ্ট হয়ে যায়, ইউরোপের মাটিতে প্রায় দুই বছর ধরে যুদ্ধ চললেও– ইইউ তার সদস্য দেশগুলোর গোলা উৎপাদন সক্ষমতার যথাযথ পর্যালোচনা করেনি। সভায় বোরেল বলেন, "(উৎপাদনে) বর্তমানে আমাদের কী অবস্থা, এবং দ্বিতীয় ধাপের সরবরাহের জন্য আমাদের উৎপাদন গতি কেমন হতে পারে– আমরা সে বিষয়ে জানতে চাই।"
এমন সময় এই চিত্র সামনে আসছে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের ঘরোয়া রাজনীতি ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়ার গতি কমিয়েছে।
যুদ্ধের আরেক পক্ষ রাশিয়াও তাদের উৎপাদনের তুলনায় বেশি গোলা ছুঁড়ছে। এই অবস্থায়, গত সেপ্টেম্বরে চালান পেতে উত্তর কোরিয়ার শরণাপন্ন হয় মস্কো। হোয়াইট হাউসের মুখমাত্র জন কিরবি বলেছেন, ক্রয়চুক্তির এক মাসের মধ্যেই উত্তর কোরিয়া এক হাজার কনটেইনার-বোঝাই গোলাবারুদ দিয়েছে।
এস্তোনিয়ার সামরিক গোয়েন্দা প্রধান কর্নেল অ্যান্তস কিভিসেল্গ বলেন, এর অর্থ তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ শেল পেয়েছে রাশিয়া। একই পরিমাণ গোলা ইউক্রেনকে দিতে ইইউ ৮ মাস সময় নিয়েছে, অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ার থেকে মাত্র এক মাসে পেয়েছে রাশিয়া।
উত্তর কোরিয়ার রাসুন বন্দর থেকে জাহাজে করে রাশিয়ার দুনাই বন্দরে গোলাবারুদের চালান পাঠানো হচ্ছে। এই সরবরাহের পরিমাণ জানতে স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করেছে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। এই বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দিচ্ছে, সরবরাহের পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে।
এছাড়া, উত্তর কোরিয়া থেকে রেলপথেও হয়তো অতিরিক্ত গোলাবারুদ পেয়েছে রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক– সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস) জানায়, সেপ্টেম্বরে পুতিন ও কিম জন উনের মধ্যে বৈঠকের পর থেকে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে ট্রেন চলাচল 'নাটকীয় হারে' বেড়ে যাওয়ার ঘটনা স্যাটেলাইট চিত্রে উঠে এসেছে।
গ্রীসের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়– অ্যারিস্টোটল ইউনিভার্সিটি অব থেসালোনিকি'র ইতিহাস বিভাগের ইমেরেটাস অধ্যাপক ইয়োরগোস মার্গারিতিস বলেন, 'পশ্চিমাদের বিস্মিত করে দিয়ে– চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে নিজেদের যা দরকার তা সংগ্রহে রাশিয়া সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে।'
ইউক্রেন যুদ্ধে উভয়পক্ষের আর্টিলারি শক্তির ভারসাম্যের প্রতি লক্ষ রাখা এই অধ্যাপক আল-জাজিরাকে বলেন, 'উত্তর কোরিয়া এক কোটি রাউন্ড গোলা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা বিপুল। এরমধ্যেই তারা দশ ভাগের একভাগ সরবরাহও করেছে।'
জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের একজন ফেলো জেনস বাস্টিয়ান বলেন, 'রাশিয়া ভালোভাবেই সরবরাহ পাচ্ছে, তাই ক্ষয়ক্ষতির তোয়াক্কা করছে না। নিঃসন্দেহে তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমেও যুদ্ধ-সরঞ্জাম পাওয়ার সুবিধা তাদের রয়েছে। কিন্তু, ইউক্রেনের বেলায় পরিস্থিতি ভিন্ন।'
এই অবস্থায়, দিশেহারা হয়ে সমাধান খুঁজছে ইইউ। দ্রুত সরবরাহের জন্য বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি বন্ধ রাখার পরামর্শও দিয়েছেন বোরেল। প্রসঙ্গত, ইউরোপের ৪০ শতাংশ উৎপাদিত গোলাবারুদের ক্রেতা হচ্ছে এই বিদেশি গ্রাহকেরা। তাই এই পথ বেছে নিলে বড় ধাক্কা খাবে মহাদেশটির প্রতিরক্ষা শিল্প। খুবই অল্প সময়ের জন্য এটা কার্যকর করা গেলেও, দীর্ঘদিন বা কয়েকমাস ধরে বিক্রি বন্ধ রাখা যাবে না।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের তুলনায়, দ্রুত ও বহুমুখী উপায়ে এ সংকট সমাধানে সাড়া দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ফেব্রুয়ারিতে দেশটি গোলা উৎপাদন ছয়গুণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়, কোরিয় যুদ্ধের পর এই হারে উৎপাদন বৃদ্ধির ঘটনা আরও কখনো ঘটেনি। মূলত, নিজস্ব মজুত পূরণের পাশাপাশি ইউক্রেনকে সহায়তা দিতে যা করা হয়। একইসঙ্গে, ভবিষ্যতের যুদ্ধের চাহিদা মাথায় রেখেও এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের আগপর্যন্ত প্রতি মাসে ১৪ হাজার ৪০০ গোলা কিনত মার্কিন সেনাবাহিনী। সেপ্টেম্বরে এই ক্রয় বাড়িয়ে তিনগুণ করা হয়। জানুয়ারিতে তা আরও দ্বিগুণ বাড়নো হয়। এই হিসাবে মাসে অন্তত ৯০ হাজার রাউন্ড গোলা কেনার অর্ডার দেওয়া হয়েছে। তবে এই মাত্রায় উৎপাদন করতে মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর আরও সময় লাগবে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী বছরের শেষ নাগাদ এই সামর্থ্যে পৌঁছাবে তারা।