বায়ু দূষণ রোধে ঠিকাদার ও তদারকি প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে
সরকারি বেসরকারি অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামতের মাধ্যমে বায়ু দূষণ হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং ওই কাজের তদারকি সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে শাস্তির আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। গত ১৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত কমিটির দ্বিতীয় সভায় বায়ু দূষণ রোধে এ সিদ্ধান্তসহ আরো বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে এই কমিটি গঠন করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন এই কমিটির সভাপতি। এক বছরে কমিটি দুটি বৈঠক করেছে। চলতি জানুয়ারির শেষে পরবর্তী বৈঠক করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে পরিবেশ অধিদপ্তর সুত্রে জানা গেছে।
কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, উন্নয়ন প্রকল্পে ইটের পরিবর্তে নির্দিষ্ট পরিমাণে ব্লকের ব্যবহার করতে হবে। একইসাথে পরিবেশ ছাড়পত্র ও লাইসেন্সবিহীন ইটভাটা বন্ধের পরামর্শ ও উন্মুক্ত স্থানে ময়লা আবর্জনা, পৌরবর্জ্য, গাছের লতাপাতা পোড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
কমিটির দ্বিতীয় সভায় মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, বায়ুদূষণ রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। অর্থ ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, 'উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে পরিবেশ ব্যবস্থাপনা বাবদ ব্যয় বরাদ্দ থাকে। সেই বরাদ্দ ঠিকাদাররা সঠিকভাবে ব্যবহার করছে কি না, তা তদারকি করা দরকার। এই বরাদ্দ যথাযথভাবে ব্যয় করা না হলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এবং প্রকল্পের তদারকি প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।'
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, বেসরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছেন কমিটির অন্য সদস্যরা। বায়ু দূষণ রোধে সরকার এখন থেকে কঠোর হবে। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ যাতে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করে সেজন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নতুন সরকারের মন্ত্রি পরিষদে এসব বিষয় উত্থাপন করে মন্ত্রীরা যাতে উদ্যোগগুলোর বাস্তবায়ন মনিটরিং করেন সে বিষয়টি জানানো হবে।
যানবাহনের ধোঁয়া নিঃসরণ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক
কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ এ মাস থেকে ডিজেলচালিত পুরনো বাস-ট্রাকের ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়ার সময় যানবাহনের ক্ষতিকর ধোঁয়া বা গ্যাসের নিঃসরণ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করবে।
এছাড়া পরিবেশ দূষণকারী ফিটনেসবিহীন ও ইকোনোমিক লাইফ অতিক্রান্ত হয়েছে এমন যানবাহনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে।
বিআরটিএর পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক টিবিএসকে বলেন, বায়ু দূষণ রোধে গত ডিসেম্বরে মিরপুর-১ এ যানবাহনের ক্ষতিকর ধোঁয়া নির্গমন পরীক্ষা শুরু হয়। ডিজেলচালিত যানবাহনের পাশাপাশি অন্যান্য জ্বালানি নির্ভর যানবাহনও এ পরীক্ষার আওতায় রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, 'যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়ায় দূষণের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। উচ্চ দূষণের স্তরের যানবাহনগুলো মেরামত করা এবং ফিটনেস সার্টিফিকেট নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই পরীক্ষার উদ্যোগটি পর্যায়ক্রমে সারাদেশের বিআরটিএ অফিসগুলোতে চালু করা হবে।'
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন সকল হাসপাতালে মেডিক্যাল বর্জ্য উপযুক্ত ইনসিনারেটরের মাধ্যমে পরিবেশসম্মতভাবে ধ্বংস করতে হবে বলে জানানো হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ে সচেতনতামুলক কার্যক্রম চালাবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো।
ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, রাজউক, সিটি কর্পোরেশনসহ অধীনস্থ সংস্থাগুলোকে চিঠি দিয়ে নতুন উন্নয়ন প্রকল্পে নির্দিষ্ট হারে ব্লকের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে প্রকল্পের ডিপিপি তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
একইসাথে সংস্থাগুলোর ওয়ার্ক সিডিউলে বাজার দর অনুযায়ী ব্লকের দর অন্তর্ভূক্ত করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে চিঠিতে।
গণপূর্ত অধিদপ্তরকেও একই নির্দেশনা দিয়েছে পণপূর্ত মন্ত্রণালয়। শিক্ষা প্রকৌশল ও স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এই নির্দেশনা দিয়েছে বলে জানা গেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক টিবিএসকে বলেন, 'বায়ু দূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন পক্ষের বেশকিছু কার্যক্রম রয়েছে। কিন্তু বায়ুমান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ দূষণ কার্যক্রম আটকানো যাচ্ছে না।'
তিনি বলেন, 'দুইভাবে দূষণ হচ্ছে। প্রথমত; দেশের মধ্যে সড়কের ধুলাবালি, সরকার-বেসরকারি নির্মাণ কার্যক্রম, যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলা, গাছের লতাপাতা পোড়ানো ও মেডিক্যাল বর্জ্যের মাধ্যমে দূষণ হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে আদেশ জারি করা হচ্ছে, মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জেল-জরিমারা করা হচ্ছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না।'
দ্বিতীয়ত; ট্রান্স-বাউন্ডারি এয়ার পলিউশন থেকে দূষণ অব্যাহত রয়েছে। আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই দূষণ কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ৩০ শতাংশ বায়ু দূষণের জন্য দায়ী ট্রান্স-বাউন্ডারি উৎস, বিশেষ করে ভারতের উৎসগুলো।
জিয়াউল হক বলেন, 'বায়ুদূষণ রোধে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদাররা যাতে বায়ু দূষণ রোধকেন্দ্রীক কার্যক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করে, সেটা বাধ্য করা হবে। নয়ত ঠিকাদারদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।'
এর বাইরে প্রচলিত ইটভাটা বন্ধ করে আধুনিক ভাটা স্থাপন এবং জনসাধারণকে আধুনিক চুলা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে প্রকল্পের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় এ প্রকল্প নেওয়া হবে। প্রকল্পের মাধ্যমে আধুনিক ইটভাটা স্থাপনে প্রচলিত ইটভাটার মালিকদের সহজ শর্তে ও কম সুদে ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এর বাইরে ব্লক কারখানা স্থাপনেও উদ্যোক্তাদের উদ্বুদ্ধ করা হবে।
দেশে বায়ু দূষণের চিত্র
বায়ু দূষণের দিক থেকে অনেকদিন ধরেই ঢাকা বিশ্বের শীর্ষ শহর। এছাড়া দেশের ৫৪টি জেলার বায়ুমান বেশিরভাগ সময়ই খারাপ থাকে।
পরিবেশ অধিদপ্তর দেশের ১৬টি স্থানে সার্বক্ষণিক বায়ুমান পরিবীক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। এর মাধ্যমে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) প্রকাশ করা হচ্ছে।
গত ২ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তরের একিউআই অনুযায়ী, ঢাকার বায়ুমান অস্বাস্থ্যকর। এদিন ঢাকার আকাশের বায়ুতে দূষণের মাত্রা ছিল ২১৪।
একইভাবে গাজীপুর, সাভার, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, নরসিংদী, রংপুরের বায়ুমানও ছিল অস্বাস্থ্যকর। ওইদিন নারায়ণগঞ্জের বায়ুমান ছিল ৩০৭, যা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর।
খারাপ বায়ুমানের ফলে মানুষ বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ধুলিকণা, সীসাসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা বায়ুর মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে ফুসফুস, হার্ট, যকৃতসহ বিভিন্ন অঙ্গ আক্রান্ত হচ্ছে। এমনকি মানুষের প্রজনন ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। গর্ভপাত হচ্ছে, শিশু জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মাচ্ছে।