শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য হতে পারে ‘গেম চেঞ্জার’
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কর্তৃক শিক্ষক মূল্যায়ন একটি বৈশ্বিক স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে পরিচিত। শিক্ষার্থী সহায়ক শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে জবাবদিহিতা নিশ্চিতে এটি একটি কার্যকরী টুল। তবে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এই পদ্ধতিটির চর্চা খুব একটা দেখা যায়না।
শিক্ষক মূল্যায়ন প্রায়ই একটি কোর্স বা প্রোগ্রামের কার্যকারিতা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করতে পারে। এক্ষেত্রে ঐ কোর্সের ভালো দিকগুলির পাশাপাশি উন্নতির ক্ষেত্রগুলিও সনাক্ত করা যায়। এছাড়াও এই পদ্ধতি শিক্ষক কেন্দ্রিক শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থী সহায়ক শিক্ষার দিকে পরিচালিত করে। ফলে পড়াশোনায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ এবং অনুপ্রেরণা আরও বৃদ্ধি পায়।
তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক মূল্যায়নের সমর্থনে পলিসি গ্রহণের ক্ষেত্রে সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব দেখা যায়। এটি শিক্ষার্থীদের বৃদ্ধি ও বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি শিক্ষার সামগ্রিক মানকেও প্রভাবিত করে।
শিক্ষকের পাঠদানের কার্যকারিতা বিভিন্ন উপায়ে পরিমাপ করা যেতে পারে। এটি হতে পারে 'স্টুডেন্ট অ্যাচিভমেন্ট গ্রোথ' পদ্ধতির মাধ্যমে; যা সময়ের সাথে সাথে শিক্ষার্থীর একাডেমিক অগ্রগতির উপর শিক্ষকের প্রভাব পরিমাপ করে। এই পরিমাপটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কারণ এটি শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পারফরম্যান্সের উন্নতিতে শিক্ষকের নির্দেশনামূলক পদ্ধতি কতটুকু কার্যকর সেটি নির্ধারণে সহায়তা করে।
আরেকটি পদ্ধতি হতে পারে 'স্টুডেন্টস পারসেপশনস অফ দ্য টিচার ইফেক্টিভনেস অ্যান্ড ক্লাসরুম ইন্সট্রাকশনাল ক্লাইমেট'। এই পদ্ধতিতে মূলত শিক্ষকের কার্যকারিতা এবং শ্রেণিকক্ষে শেখার পরিবেশ সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা কী মনে করছেন সেই তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই প্রতিক্রিয়া শিক্ষকদের শিক্ষাদানের পদ্ধতি এবং শ্রেণীকক্ষের কার্যকলাপের কৌশলগুলি কীভাবে শিক্ষার্থীরা উপলব্ধি করছে সে সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।
পিয়ার রিভিউও শিক্ষকদের পাঠদানের কৌশল উন্নতিতে একটি শক্তিশালী টুল হতে পারে। এক্ষেত্রে তারা সহকর্মীদের একে অপরের শিক্ষার কৌশলগুলি পর্যবেক্ষণ করবে এবং নিয়মতান্ত্রিক ও বিভাগের উদ্দেশের সাথে মিল রেখে পাঠদানের কৌশলগুলোর উন্নতিতে আলোচনা করার ক্ষেত্র তৈরি করবে।
এক্ষেত্রে পিয়ার রিভিউ একদিকে শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতার সংস্কৃতি তৈরি করবে। অন্যদিকে শিক্ষকেরা একে অপরের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা বিনিময়ের মাধ্যমে পাঠদানের পরিবেশকে ক্রমাগত উন্নত করতে পারবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থী-সহকর্মী উভয় পক্ষেরই প্রতিক্রিয়াগুলো জানা ও বোঝা। একইসাথে গঠনমূলক পরামর্শের উপর ফোকাস করা। কেননা নিজেদের পাঠদানে উন্নতির জন্য শিক্ষকদের নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ ও প্রতিক্রিয়াগুলো আমলে নেওয়া উচিত।
তবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পর্যালোচনা করার সময় শিক্ষকরা কখনও কখনও ভুল বুঝতে পারেন। যেমন, তারা নেতিবাচক মন্তব্যে খুব বেশি ফোকাস করতে পারেন বা প্রতিক্রিয়াগুলো ভুলভাবে বিশ্লেষণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে অনেক সময় তারা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াগুলোকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেয় না এবং নিজেদের ভালো দিকগুলো সম্পর্কে বুঝতে পারে না। তারা এটিকে নিজেদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির একটি টুল হিসাবে না দেখে বরং ব্যক্তিগতভাবে নিয়ে থাকে।
শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের মতোই সহকর্মীদের পর্যালোচনাগুলিও শিক্ষকদের পাঠদানের গুণগত মান বৃদ্ধিতে এবং উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ টুল। আর তাই এগুলোকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করা উচিত। একইসাথে যখন একটি নতুন পাঠদান পদ্ধতি কিংবা প্রযুক্তির ফলাফল বিশেষভাবে ভালো হয়েছে তখন শিক্ষকদের উচিত নিজেদের সাফল্য উদযাপন করা।
সার্বিক গুরুত্ব বিবেচনায় দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন এবং সমপর্যায়ের বিষয়টি অতিদ্রুত চালু করা উচিত। কেননা এই টুলগুলি শুধু পাঠদানের পরিবেশই উন্নত করে না। বরং পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নেও অবদান রাখে।
পদক্ষেপগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার গুণগত মান আরও উন্নত হবে। একইসাথে জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পাশাপাশি শিক্ষকদের মধ্যেও ক্রমাগত নতুন কিছু শেখার সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। যার ফলে শেষ পর্যন্ত সেটি শিক্ষার্থীদের শেখার সম্ভাবনাকেই বাড়িয়ে তুলবে।
একইসাথে এমন পদক্ষেপ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ শিক্ষার পরিবেশ তৈরিতে আরও সহায়তা করবে। ফলে শিক্ষকরা শিক্ষাদান পদ্ধতিতে উৎকর্ষ ও উদ্ভাবনের জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করতে উৎসাহিত করতে পারে। এছাড়াও শিক্ষার্থীরা তাদের শিখন প্রক্রিয়ায় নিজেদের মতামত প্রদানের মাধ্যমে ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পারে।
উপরন্তু এই অনুশীলনগুলি বিশ্বমঞ্চে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সামগ্রিক খ্যাতি এবং প্রতিযোগিতায় অবদান রাখতে পারে। ফলে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সারা বিশ্ব থেকে আরও মানসম্মত শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের আকর্ষণ করতে করতে পারবে।
তবে এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, এই শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এটির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অভ্যন্তরে মানসিকতা ও সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন প্রয়োজন। এর জন্য দরকার সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারের কাছ থেকে একটি শক্তিশালী নেতৃত্ব ও প্রতিশ্রুতি।
চ্যালেঞ্জ যতই থাকুক না কেন, তবুও শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ও পিআর রিভিউ বাস্তবায়নের সম্ভাব্য সুবিধাগুলির কথা বিবেচনা করলে উদ্যোগগুলো বেশ ফলপ্রসু। কেননা পদ্ধতিটির মধ্যে রয়েছে অপার সম্ভাবনা; যা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার মান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে পারে। সেক্ষেত্রে এটি বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারদের তথা নীতিনির্ধারক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসক, শিক্ষক থেকে শিক্ষার্থীদের একসাথে কাজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷
এই পদ্ধতিটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি শিক্ষা সহায়ক পরিবেশ তৈরি করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। যার মাধ্যমে সত্যিকার অর্থেই শিক্ষকরা নিজের সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়ে শেখাতে পারে এবং ছাত্ররা তাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়ে শিখতে পারে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পাঠদান মূল্যায়ন এবং পিআর রিভিউ উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।