পদ্মা নদীতে বিলাসবহুল হাউসবোট
পদ্মা নদীর বিকেল। সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। দু-একটি জেলে নৌকা তখনও মাছ শিকারে ব্যস্ত। মাছের লোভে একঝাঁক গাঙচিল উড়ে বেড়াচ্ছে এদিক-ওদিক। আকাশের রঙিন আভার কিছুটা ফুটে উঠেছে পদ্মার ঈষৎ ঘোলা জলে। দূরে কোনো এক চর থেকে ভেসে আসছে পাখিদের কিচিরমিচির।
এমনই এক আশ্চর্য বিকেলে পদ্মার বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে একটি বজরা! না, পদ্মার এই বজরায় রবীন্দ্রনাথ নেই, এ ঘটনা সেই ব্রিটিশ আমলের শিলাইদহেরও নয়। একবিংশ শতাব্দীতে একদল ভ্রমণবিলাসী ঘুরে বেড়াচ্ছেন পদ্মার বুকে। বজরাটি একটি আধুনিক হাউসবোট। নাম 'রঙ্গিলা বাড়ই'। হাওরের পর্যটন মৌসুম শেষে শীতকালে প্রমত্তা পদ্মার বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে সে।
বাংলাদেশের পর্যটন খাতে হাউসবোট নতুন বিষয় নয়। অনেক বছর আগেই ভাটি অঞ্চলের হাওরগুলোতে বিলাসবহুল হাউসবোট চালু হয়েছিল। তবে এবারই প্রথম পদ্মা নদীতে যাত্রা শুরু করল এ ধরনের পূর্ণাঙ্গ হাউসবোট।
সাধারণত সব ধরনের আধুনিক সুবিধার পাশাপাশি প্রকৃতির কোলে ভেসে ভেসে সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ মেলে এসব হাউসবোটে। এবার পদ্মার বুকে সে সুযোগ করে দিল 'রঙ্গিলা বাড়ই'।
শিলাইদহ, শাহজাদপুর আর পাতিসরে নিজেদের জমিদারি দেখাশোনা করতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যবহার করতেন বজরা। সেই বজরাতেই কখনো আপন মনে ঘুরে বেড়াতেন কীর্তিনাশায়। বজরার নামও দিয়েছিলেন 'পদ্মা'।
রবীন্দ্রনাথের দেখাদেখি এরপর অনেকেই হয়তো বজরায় পদ্মা নদী ঘুরেছেন। তবে বাণিজ্যিকভাবে পদ্মা নদীতে বজরা চালু হলো এই প্রথম।
উদ্যোক্তা হাসানুর রহমান উল্লাসের ভ্রমণের নেশা অনেকদিনের। নিজে ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন বলে ঠিক করেছিলেন পেশা গড়বেন পর্যটন খাতে। সেই ভাবনা থেকেই সুনামগঞ্জের হাওরে গড়ে তোলেন একের পর এক হাউসবোট। সেগুলোর নামও বিচিত্র। জলছবি, জলরঙ, হিমাদ্রি, সিলভার ওয়েভ। এক বছর আগে যাত্রা শুরু করে হাউসবোট 'রঙ্গিলা বাড়ই'।
হাওরে পর্যটন মৌসুম শুরু হয় বর্ষাকালে। জুন-জুলাই থেকে শুরু করে অক্টোবর পর্যন্ত চলে পর্যটকদের আনাগোনা। এরপর পানি কমে অলস পড়ে থাকে হাউসবোটগুলো। শীতকালে তাই মুনাফার মুখ দেখেন না মালিকেরা।
এ সময় কী করা যায় ভাবতে গিয়ে নদীভিত্তিক পর্যটন সম্ভাবনার কথা মাথায় আসে উল্লাসের। বললেন, 'নদীমাতৃক দেশ হলেও আমাদের রিভার ট্যুরিজম কিন্তু সেভাবে বেড়ে ওঠেনি। নদীভিত্তিক পর্যটন চালু করার দায়বদ্ধতা থেকেই আমরা পরিকল্পনা করতে থাকি। আমাদের এত সুন্দর নদী দেখানোর জন্য,
যেহেতু পদ্মার প্রতি মানুষের আলাদা টান ও ভালোবাসা আছে, পদ্মা সেতু, রুপালি ইলিশ, এ অঞ্চলের জনপদ, মানুষের কার্যক্রম দেখানোর প্রয়াস থেকেই আমরা কার্যক্রম শুরু করি।'
পদ্মার 'কীর্তিনাশা' নামটি ঘুচেছে অনেক আগে। আব্দুল আলীমের 'সর্বনাশা' পদ্মা নদীর দেখা এখন আর মেলে না। শীতকালে পদ্মা হাজির হয় তার শান্ত, সুবোধ রূপে। এদিকে-ওদিকে পলি জমে জেগে ওঠে চর, আনাগোনা বাড়ে পাখপাখালির। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর আর নরম রোদের বিকেল আপন করে নেয় দর্শনার্থীদের।
এমন এক আকর্ষণীয় সময়ে কার্যক্রম শুরু করায় অল্পদিনে বেশ সাড়া মিলেছে বলে জানালেন উল্লাস। বললেন, 'আমরা ইতোমধ্যে বেশ কিছু কর্পোরেট ট্রিপ করেছি। আমরা যতগুলো ট্রিপ করেছি, সবাই-ই মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। অনেকে না এসেও ফোনে, টেক্সটে মুগ্ধতা জানিয়েছেন। পদ্মার রূপ, সৌন্দর্য দেখে সবাই খুশি। "পদ্মার পলিদ্বীপ' উপন্যাসের লেখক আবু ইসকাকের পরিবার, বংশধরেরা এসেছিলেন, যথেষ্ট মুগ্ধ হয়েছেন তারা।"
সম্প্রতি রঙ্গিলা বাড়ই হাউসবোটে বন্ধুদের সাথে ডে-নাইট ট্রিপে এসেছিলেন আহমেদ সম্রাট। পদ্মা নদীতে বন্ধুদের নিয়ে অসাধারণ সময় কাটিয়েছেন বলে জানালেন তিনি।
ট্রিপের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে সম্রাট বললেন, 'বন্ধুরা একসাথে, পদ্মায় বোট চলছে। আমরা চরে খেলেছি বন্ধুরা মিলে, গানটান করার মতো সুন্দর সব জায়গা ছিল। পাশাপাশি তাদের খাবার-দাবার অসাধারণ ছিল। গেস্টদের প্রতি তাদের যে দায়বদ্ধতা, সেদিক থেকে একশোতে একশো। খুব সুন্দর ট্রিপ হয়েছে।'
পদ্মায় হাউসবোট চালু হওয়াকে বাড়তি সুযোগ হিসেবে দেখছেন তিনি। বললেন, 'এই হাউসবোটে আমরা নদীটা উপভোগ করতে পেরেছি। বিনোদন ও প্রকৃতি উপভোগ করার জন্য খুব ভালো জিনিস। সবচেয়ে উপভোগ্য বিষয় ছিল ছোট ছোট চরগুলো।'
ঢাকার অদূরে হওয়ায় একদিনের পর্যটন স্পট হিসেবে পদ্মা নদী অনেকেরই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য এখন। সে কথা বিবেচনায় 'রংগিলা বাড়ই' এখন দোহারের মৈনটঘাট থেকে মাওয়া পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে দর্শনার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী নদীর যেকোনো জায়গাই ঘুরিয়ে আনা সম্ভব বলে জানালেন উল্লাস।
পদ্মা নদীতে প্রধান আকর্ষণগুলো কী? তিনি জানালেন, পদ্মা ট্রিপের প্রধান আকর্ষণ হলো পদ্মা সেতু। 'আমরা যখন পদ্মাসেতুর নিচে যাই, প্রত্যেকটি মানুষ মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে। এছাড়া পদ্মার ইলিশের প্রতি বাঙালির টান, ভালোবাসা, আবেগ রয়েছে। আমরা যখন ইলিশ সার্ভ করি, মানুষ পদ্মা নদীতে ভেসে যখন পদ্মার ইলিশ খেতে পান, সেতু দেখেন, ব্যাপারটা দুর্দান্ত হয়ে ওয়ে ওঠে।'
উল্লাস বলেন, 'পদ্মার বেশ কিছু চরে আমরা বোট নোঙর করি, তখন বেশ কিছু অ্যাক্টিভিটি করা হয়। আমাদের ডাইনিং টেবিল পদ্মার চরে নামাই, সেখানেই খাওয়াদাওয়া হয়। সেখানে ফুটবল, মোরগ লড়াই, বালিশ নিক্ষেপ, দৌড় প্রতিযোগিতাসহ নানা কিছু আয়োজন করি। নদী বহমান, স্নিগ্ধ পানি, সাদা বালি, লুকস লাইক সেন্ট মার্টিন, এর পাশেই সবাই খাওয়াদাওয়া করছেন, ব্যাপারটি সবাই উপভোগ করেন।
'আরেকটি বিষয়, পদ্মায় গোসল কিংবা সাঁতার কাটার বিষয়টিও অনেকে উপভোগ করছেন। কারণ অনেকে হয়তো ওপর দিয়ে যাচ্ছে, নদী দেখছে , কিন্তু নদীর পানি ধরে দেখার সুযোগ হচ্ছে না। এখানে তারা পদ্মায় সাঁতার, লাফালাফি করতে পারছে। এছাড়া সরাসরি দেখতে পারছে জেলেদের মাছ ধরা। এটাও আকর্ষণ করছে তাদের।'
নিজের হাউসবোটেরও একাধিক আধুনিক সুযোগ-সুবিধার কথা জানালেন উল্লাস। বললেন, রঙ্গিলা বাড়ই হাউস বোটে মিশেল ঘটেছে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার। 'আমাদের হাউসবোটে আটটি কেবিন আছে। প্রত্যেকটিতে অ্যাটাচড ওয়াশরুম, হাই কমোড। সুবিশাল লাউঞ্জ। কেউ যখন পরিবার নিয়ে ট্রিপে আসে, রাত্রিযাপন করে, তখন আরামদায়ক বিসানা, সেফটি-সিকিউরিটি, এসব সুবিধা আমরা নিশ্চিত করি।'
তা পদ্মার বুকে আরামদায়ক বিসানায় শুয়ে নদী উপভোগ করতে কেমন খরচ করতে হয় দর্শনার্থীদের? প্রশ্ন করাতে উল্লাস দিলেন খরচের হিসেব। 'আমরা অতিথিদের ঢাকা থেকে পিক করছি। ঢাকায় আমাদের বেশ কিছু পিকআপ পয়েন্ট আছে, যেমন উত্তরা, রামপুরা, এয়ারপোর্ট; এছাড়া চাহিদা অনুযায়ী অতিথিদের বাসা থেকে। বাসা থেকে পিক আবার ফেরার পথে ড্রপ করা থেকে শুরু করে হাউস বোটে নদী ভ্রমণ সমস্তটাই একসাথে। খরচের কথা বললে, ডে ট্রিপ করছি জনপ্রতি চার হাজার টাকা করে। ডে ট্রিপে থাকছে ব্রেকফাস্ট, মর্নিং স্ন্যাক্স, লাঞ্চ, ইভিনিং স্ন্যাক্স। নাইট ট্রিপে থাকছে বারবিকিউ। রাতে রয়েছে খেজুরের রস। বিভিন্ন চরে গিয়ে খাবারদাবারের আয়োজন। একরাত দুইদিনের এই ট্রিপে খরচ পড়বে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা।'
নিয়মিত ট্রিপ হিসেবে দোহারের মধুর চর থেকে রিভার ক্রুজিং করে পদ্মা সেতুর নিচে আসে রঙ্গিলা বাড়ই। তবে রাত থাকলে আরও কয়েকটি জায়গা যুক্ত করা হয় বলে জানালেন উদ্যোক্তা। বললেন, গেস্টদের চাহিদা অনুযায়ী তারা ট্রিপের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে করে থাকেন। রঙ্গিলা বাড়ই নামের ফেইসবুক পেইজে যোগাযোগ করে বুক করা যাবে ট্রিপ। এছাড়া পেইজে থাকা মোবাইল নম্বরে কথা বলেও করা যাবে আয়োজন।
গত বছর সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। সেখানে হাউসবোটে ঘুরেছেন হাওর অঞ্চল। সেই দলের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী শাবাব ওয়াছি জানালেন তাদের অভিজ্ঞতার কথা। তার মতে, ঢাকার এত কাছে পদ্মা নদীতে হাউসবোট কার্যক্রম চালু হওয়া অনেকের জন্যই দারুণ সুযোগ। কর্মব্যস্ত মানুষও একদিনের ট্রিপে হাউসবোটে ঘুরে আসতে পারবেন।
হাসানুর রহমান উল্লাসের চিন্তাও একইরকম। নদীমাতৃক বাংলাদেশে 'রিভার ট্যুরিজমের' দারুণ সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। শুধু পদ্মা নদী নয়, ভবিষ্যতে দেশের অন্যান্য নদীকেও মানুষের সামনে তুলে ধরতে চান তিনি।
সামনে তার অন্য বোটগুলোও পদ্মায় যুক্ত করার কথা জানালেন উল্লাস। বললেন, 'আমার ইচ্ছা হলো বাংলাদেশের যে নদীগুলোতে এরকম বোট অপারেট করা সম্ভব, সেসব নদীতে কার্যক্রম শুরু করা। মানুষকে নদীটা দেখানো আমার অভিপ্রায়। পরিবার, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে যাতে যাওয়া যায়, সেজন্য সুন্দর আয়োজন আমি করতে চাই। আমাদের যে পরবর্তী প্রজন্ম আছে, তাদেরকে নদীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।
'বাংলাদেশে নদী এত সুন্দর, যেটা আসলে না গেলে কেউ বুঝবে না। নদী বাঁচলে আমরা বাঁচব। নদীতে ট্যুরিজম বাড়লেই মানুষ বুঝবে, নদী শাসিত হচ্ছে, দূষিত হচ্ছে, নদীকে বাঁচানো দরকার। যখন পর্যটন বাড়বে, তখন নেক্সট জেনারেশন গুরুত্ব দেবে। আমাদের দায়বদ্ধতা বাড়বে। সে ভাবনা থেকেই যা করণীয় আমি করতে চাই।'
বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম লিখেছিলেন, 'রঙিলা বারই রে, বারই, নানান রঙের খেলা খেলো'। সুনাগঞ্জের হাওরে চলবে বলে হাসানুর রহমান উল্লাস নিজের হাউসবোটের নামটি নেন ভাটির পুরুষের এই গান থেকে। এটি বাউল সম্রাটের প্রতি একটি ট্রিবিউট বলে জানালেন উল্লাস।
শাবাব ওয়াছির মতে, পদ্মা নদীতে 'রঙ্গিলা বাড়ই'য়ের যাত্রা শুরুও কর্মব্যস্ত নগরবাসীর জন্য ট্রিবিউট। এ ধরনের ভ্রমণবান্ধব হাউসবোট বাড়লে তা বেশ ইতিবাচক উদ্যোগ হবে বলে মনে করেন তিনি।