গাজায় পশ্চিমাদের ঔপনিবেশিক যুদ্ধ সম্পর্কে ফ্রাঞ্জ ফানো আমাদের যা বলতে পারেন
ফ্রাঞ্জ ফানো তাঁর বহুল সমাদৃত গ্রন্থ 'দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ' (বাংলায় অনূদিত হয়েছে– জগতের লাঞ্ছিত' নামে) এ লিখেছেন, "সকল সশস্ত্র সংগ্রামে, এমন একটা মোড় আসে, যখন আর ফেরার পথ থাকে না। প্রায় সব (উপনিবেশের) ক্ষেত্রেই এই পরিস্থিতি দেখা দেয়– ব্যাপক ও সর্বাত্মক দমনপীড়নের কারণে, যা উপনিবেশের সব স্তরের মানুষকে গ্রাস করে।' বেঁচে থাকলে আজকের গাজাকে দেখেও তিনি একই কথা বলতেন।
ইসরায়েল, গাজা ও পশ্চিম তীরের জন্য ফানোর বর্ণিত ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণ উপস্থিত হয়েছে।
ফিলিস্তিন এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ যে, তার সাথে যে অবিচার হয়েছে– তা আধুনিক যুগের ইতিহাসে বিরল। এই একটি সংগ্রামের প্রকৃত চিত্র যখন উঠে আসে – তখন উপনিবেশবাদী ধ্যানধ্যারণার প্রবক্তা ও অনুগামীদেরদের যুক্তি অসার প্রমাণিত হয়ে যায়।
আজ গাজা থেকে শুরু করে লোহিত সাগর পর্যন্ত সর্বত্র – উপনিবেশের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভীতিতে সন্ত্রস্ত পশ্চিমাদের অবৈধ হত্যাযন্ত্রের মুখোশ খুলে পড়েছে। গণহত্যা, যুদ্ধ চাপানোর পাশাপাশি নিপীড়িত মানুষকে অনাহারে মারাকে – অলিম্পিক পর্যায়ের একটানা ভণ্ড, দ্বিচারী কূটনৈতিক বক্তব্যের মাধ্যমে বৈধতার সাফাই দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু, প্রকৃত ঘটনা বৈশ্বিক দক্ষিণ তথা উন্নয়নশীল বিশ্বের অজানা নয়, এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মানুষ আর মার্কিন আধিপত্যবাদের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বাঁচতে চায় না।
ফ্রাঞ্জ ফানোর ইতিহাস-বিদিত গ্রন্থের ভূমিকায় প্রখ্যাত ফরাসি লেখক, বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক জঁ পল সার্ত্রে লিখেছিলেন, "ব্যাপক সজাগ এই বিশ্বে আমাদের ম্যাকিয়াভেলিয়ান দর্শনকে আর কেউ বিশ্বাস করে না। কারণ, আমাদের একের পর এক মিথ্যাচারের নজির দেখেছে তারা। (অবৈধ) বসতি স্থাপনকারীর সামনে তখন একটাই পথ খোলা থাকে, তা হলো- নিষ্ঠুর শক্তি প্রয়োগ… ভূমিপুত্রদের তখন হয় বশ্যতা শিকার করে নেওয়া, অথবা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হওয়া– এর যেকোনো একটি বেঁছে নেওয়ার বিকল্পই অবশিষ্ট থাকে।"
ফ্রাঞ্জ ফানো ছিলেন এক যুগান্তকারী চিন্তাবিদ এবং মনোচিকিৎসক, যিনি উপনিবেশবাদের বর্ণবাদী আচরণ এবং তার ফলে শাসিত ও শাসকের মনে জন্ম নেওয়া সুদূরপ্রসারী মানসিক প্রভাবগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। সাত বছর ধরে চলা নৃশংস এক যুদ্ধের পর আলজেরিয়ায় ফ্রান্সের পরাজয় যখন আসন্ন– তখন এসব কথা লিখেছিলেন ফানো ও সার্ত্রে।
কিন্তু, গাজায় মাত্র চার মাসের যুদ্ধে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন অ্যাংলো-স্যাক্সন সাম্রাজ্য পরাজয়ের সম্মুখীন– এমন দাবি অত্যূক্তি মনে হতে পারে। তবে ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধ পশ্চিমা শক্তির সীমাবদ্ধতাকে প্রকাশ করেছে, এবং আন্তর্জাতিক আইন ও যুদ্ধের নিয়মনীতির বিষয়ে তাঁদের দ্বিচারিতার স্বরূপ উন্মোচন করেছে।
তারা ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের অভিযোগ করছে, ওদিকে গাজায় ইসরায়েলের প্রকাশ্য গণহত্যায় সব রকমের সহায়তা দিচ্ছে। দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত গণহত্যা এড়াতে ব্যবস্থা নেওয়ার অন্তর্বর্তীকালীন রায় দিলেও– পশ্চিমারা বর্ণবাদী অবস্থানে অনড় রয়েছে।
ঐতিহাসিক এ রায়ের পরে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ত্রাণ সহায়তাদানকারী জাতিসংঘের সংস্থা– ইউএনআরডব্লিউএ বা (আনরা)'কে তহবিল সহায়তা বন্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ এক ডজনের বেশি ইউরোপীয় দেশ।
নির্লজ্জভাবে বন্ধ করা তহবিল সহযোগিতা:
ইসরায়েল কোনো তথ্য-প্রমাণ না দিয়ে দাবি করে, গত ৭ অক্টোবরের হামলায় আনরার কর্মচারীরা হামাস ও ইসলামিক জিহাদের পক্ষে কাজ করেছেন। অপ্রমাণিত এ অভিযোগের ভিত্তিতে, আনরাকে তহবিল দেওয়া বন্ধ করা হয়। পশ্চিমা মিত্রদের থেকে এটি ইসরায়েলের জন্য বড় পুরস্কার। যা গাজায় অমানবিক পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটাবে।
ফিলিস্তিনি জনগণকে অকল্পনীয় বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়ে– হামাসকে বন্দি বিনিময়ে রাজি করানোর জঘন্য কৌশল হিসেবে এই পদক্ষেপ নেয় তারা। আনরার তহবিল বন্ধ করা ছিল-- বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ের পরিকল্পনায়। গাজা নিয়ে ইসরায়েলে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে নেতানিয়াহুর মন্ত্রীদের অংশগ্রহণ যা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। এই সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ছিল, গণহত্যার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপন।
ব্যাপক সামরিক শক্তি ও আর্থিক সন্ত্রাসের শক্তি দিয়ে যুদ্ধে হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েল ও তাঁর মিত্ররা বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে আছে– এসব ঘটনা কাগজে-কলমে তেমন ইঙ্গিত দিলেও, প্রকৃত বাস্তবতা পশ্চিমা অক্ষের জন্য এতোটা কুসুমাস্তীর্ণ নয়।
সামষ্টিক অর্থনীতিবিদ ফিলিপ পিলকিংটন সম্প্রতি যা তুলে ধরে বলেছেন, লোহিত সাগরে ইসরায়েল-সংশ্লিষ্ট জাহাজ চলাচলে হুথিদের অবরোধ, ইতিহাসে প্রথম নৌবাহিনী ছাড়া কার্যকরী নৌ-অবরোধের ঘটনা।
প্রতিরোধ যোদ্ধাদের এই 'গেম চেঞ্জিং' কৌশলের জবাবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইয়েমেনে বিমান হামলা চালাচ্ছে। ভূপাতিত করছে হুথিদের নিক্ষিপ্ত ড্রোন ও মিসাইল। কিন্তু, তাতে পিছু হটার বদলে হুথিরা এই আগ্রাসনে আরো ফুঁসে উঠেছে। ইঙ্গ-মার্কিন বিমান হামলার প্রতিবাদে লাখ লাখ ইয়েমেনি রাজধানী সানাসহ প্রধান প্রধান শহরের রাজপথে বিক্ষোভ করেছে।
সিরিয়া-জর্ডান সীমান্তে অবস্থিত একটি মার্কিন ঘাঁটিতে ইরাকের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ড্রোন হামলার ঘটনা (যাতে তিন সেনা নিহত হয়) আরো বড় সমস্যারই ইঙ্গিত দেয়। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মূলত লড়ছে অরাষ্ট্রীয় শক্তিগুলো। আগে এই অঞ্চলের যেসব স্বৈরশাসকদের উৎখাত করতে হামলা চালিয়েছে পশ্চিমা শক্তি। কিন্তু, তাঁদের মতো করে এসব শক্তিকে উৎপাটন করা সম্ভব নয়। প্রতিরোধ সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি আরব জনগণের মধ্যে সমর্থন রয়েছে। পশ্চিমা শক্তি ও ইসরায়েলকে যা উদ্বিগ্ন করে তুলছে।
এই অবস্থায়, পশ্চিমাদের সামরিক শক্তি প্রয়োগের ঘটনাগুলো মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের দাবানলের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
লেবানন থেকে শুরু করে লোহিত সাগর পর্যন্ত প্রতিরোধ সংগঠনগুলোর সাথে পশ্চিমা উপনিবেশিক শক্তির সংঘাত প্রশ্ন তুলছে– নির্বাচনের বছরে জো বাইডেন বা রিশি সুনাক যুদ্ধ শুরু করতে চান কিনা? কারণ ব্রিটিশ ও আমেরিকান ভোটাররা মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক যুদ্ধে ক্লান্ত, বিরক্ত। গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষেও শান্তিকামী নাগরিকরা আওয়াজ তুলছেন। কিন্তু, জনমতকে গ্রাহ্য না করে তাঁদের সরকার প্রধানরা যুদ্ধের হুমকিকে উস্কে দিচ্ছেন।
ইউক্রেন থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য– পশ্চিমারা তাদের দেশ থেকে হাজার মাইল দূরের সংঘাতে জড়াচ্ছে, ঠিক যেমনটি দেখা গিয়েছিল ফ্রাঞ্জ ফানোর সময়ে আলজেরিয়া, কঙ্গো ও ইন্দোচিনে।
আজ ইসরায়েল ও ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে যেতে একাট্টা হয়েছে পশ্চিমা রাজনৈতিক শ্রেণি, কিন্তু বেশিরভাগ পশ্চিমা নাগরিক মনে করেন, এসব লড়াই তাঁদের নয়।
ইয়েমেনের হুথিদের মুখপাত্র মোহাম্মদ আল-বুখাইতি বলেছেন, "আজ যুদ্ধ হচ্ছে– গাজায় গণহত্যা বন্ধের চেষ্টারত ইয়েমেনের সাথে– এই গণহত্যার সহযোগী ইঙ্গ-মার্কিন জোটের। পৃথিবীর সকল ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলকে এই দুই পক্ষের মধ্যে যেকোন একটির পক্ষ নিতে হবে, এখানে তৃতীয় কোনো পক্ষ হওয়া যাবে না। আপনাদের বলতে হবে, অন্যায় সংঘটিত হচ্ছে দেখেও আপনারা কোন পক্ষে আছেন।"
আজ থেকে ৬৩ বছর আগে ফানো লিখেছিলেন, "উপনিবেশবাদের জগৎ দর্শন শুভ আর অশুভের সংজ্ঞা দিয়ে গঠিত (ইউরোপীয় ও শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ যেখানে শুভ শক্তি)। যেখানে প্রতিটি বিষয়কে এই আলোকে বিচার করা হয়। এতে কলোনির ভূমিপুত্রদের মানবেতর পশু হিসেবে দেখানো হয়। বলা হয়, কলোনির আদি জনগোষ্ঠীর কোনো নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নেই। সে মূল্যবোধের শত্রু। আর এ বিচারে সেই প্রকৃত শয়তান।"
তিনি আরো বলেন, "ভূমিপুত্র এসব কিছুই জানে, এবং পশুজগতের সাথে নিজের এসব কাল্পনিক তুলনা শুনে আনমনে হাসে। কারণ সে জানে, সে পশু নয়। আর ঠিক তখনই সে নিজের মানবিক অস্তিত্ব সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন হয়। এবং মুক্তি সংগ্রামে জয়লাভের জন্য অস্ত্রে শান দিতে শুরু করে।"
সংক্ষেপিত অনুবাদ: নূর মাজিদ
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।