মহাস্থানগড়ভিত্তিক টেকসই পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা অনুসন্ধানে দরকার নীরিক্ষাধর্মী গবেষণা
উপক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বদ্বীপ। গঙ্গা-ব্রহ্মাপুত্র-মেঘনা অববাহিকা পরিবেষ্টিত দেশটির অভ্যন্তরে প্রধান নদীগুলোর শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত। নদীবাহিত পাললিক ভূমি বসবাসের জন্য অত্যন্ত উপযোগী হবার কারণেই হয়তো বহুকাল আগে থেকে পৃথিবীর অনেক অঞ্চলের মানুষ বঙ্গীয় বেসিনে এসে বসতি গড়ে তুলেছিল। তবে ঠিক কখন এই বেসিনে মানুষের বসবাস শুরু হয়েছে এর সঠিক সময় জানা সম্ভব না হলেও, গত প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান অনুযায়ী আমরা এটুকু ধারণা করতে পারি যে, কৃষিভিত্তিক গ্রামপ্রধান দেশটিতে আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে উয়ারী-বটেশ্বর নামক প্রাচীন নগর গড়ে উঠেছিল। এছাড়া, বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়, যা একসময় পুন্ড্রনগর নামে পরিচিত ছিল — আনুমানিক দুই হাজার তিনশ বছর পূর্বে করতোয়া নদীর তীরে এই সমৃদ্ধ নগর বিকাশ লাভ করেছিল। পাশাপাশি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে পাহাড়পুর তথা সোমপুর মহাবিহার এবং বাগেরহাট মসজিদ শহরের স্থাপনাসমূহ। এছাড়া, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বাংলাদেশ কর্তৃক সংরক্ষিত রয়েছে পাঁচ শতাধিক প্রত্নস্থল।
বাংলাদেশে এত সমৃদ্ধ প্রত্নস্থলসমূহ থাকার পরেও আমরা প্রত্নস্থানের প্রতি এখনও ততটা আকৃষ্ট হতে পারিনি, যতটা প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। কেন হতে পারিনি? আমরা কি আদৌ দেশ ও বিদেশের পর্যটকদের জন্য প্রত্নস্থলগুলোকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি? অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের জাতীয় আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস পর্যটনশিল্প এবং এক্ষেত্রে প্রত্নস্থলগুলোর অবদান অনস্বীকার্য। ভারত পারলে আমরা কেন প্রত্নস্থানভিত্তিক টেকসই পর্যটনশিল্প গড়ে তোলার উপর অধিকতর গুরুত্ব দিচ্ছিনা?
অথচ ২০২৩ সালের বিশ্ব পর্যটন দিবসে জাতিসংঘ 'পর্যটন ও সবুজ বিনিয়োগ' প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে শুধুমাত্র প্রথাগত বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উৎপাদনশীলতাকে উন্নীত না করে উদ্ভাবনী সমাধানের ওপপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে উন্নত ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য জাতিসংঘ ইতোমধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ (এসডিজি) নির্ধারণ করে দিয়েছে।
এক্ষেত্রে, জলবায়ুর মতো বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলা, বেকারদের কর্মসংস্থান, দারিদ্রতা নিরসনের ওপর বিনিয়োগ করে কীভাবে একটি উন্নত বিশ্ব গড়ে তোলা যায় – এর ওপর গুরুত্বারোপ করে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশেরও নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। টেকসই পর্যটনশিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে চাকুরিবাজারভিত্তিক বিষয় পাঠদানের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যভিত্তিক গবেষণাধর্মী বিষয়ের প্রবর্তন জরুরি। যেহেতু নিরীক্ষাধর্মী গবেষণা ছাড়া পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন সম্ভব নয়, তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ দায় থেকে কোনভাবেই মুক্ত নয়। অন্তত, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যভিত্তিক পর্যটন নামক গবেষণাধর্মী বিষয়ের পাঠদান শুরু করা যেতে পারে। দেশের যেকোনো একটি প্রত্নস্থানের ওপর নিরীক্ষাধর্মী গবেষণা পরিচালনা করে প্রত্নস্থানভিত্তিক পর্যটনশিল্প বিকাশের সম্ভাব্যতা ও বাধাগুলোকে চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া ভীষণ প্রয়োজন।
গত কয়েক বছর ধরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে মহস্থানগড়ের প্রত্নস্থলগুলোর সঙ্গে স্থানীয়দের সম্পর্ক পর্যবেক্ষণের জন্য আমরা সমীক্ষা পরিচালনা করছি। মহাস্থানগড় ক্লাস্টারে অনেকগুলো প্রত্নস্থল রয়েছে। এর মধ্যে আমরা গত দুই বছর যাবত শুধু চার কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে অবস্থিত প্রত্নস্থলগুলোর জিআইএস মানচিত্রায়ণ করে বোঝার চেষ্টা করছি একটি সাইট থেকে অন্য সাইটের দূরত্ব কেমন; সাইট নিয়ে স্থানীয়দের পর্যবেক্ষণ; প্রতিদিন কতো সংখ্যক পর্যটক মহাস্থানগড়ে বেড়াতে আসেন; ট্যুরিস্ট গাইড হিসেবে কারা নিয়োজিত; আবাসন ও খাওয়ার ব্যবস্থা কেমন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কোন বাধা আছে কি না ইত্যাদি।
২০২০ সালে আমরা পরিচিত হই স্থানীয় কয়েকজন ভ্যানচালকের সঙ্গে যারা মহাস্থানগড়ের বিভিন্ন সাইটের আশপাশে বাস করেন। এদের মধ্যে একজন ভ্যানচালক হলেন আবু বকর। তিনি প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে মহাস্থানগড় জাদুঘরের পেছনে অবস্থিত গ্রামে স্ত্রী-সন্তানসহ বাস করে আসছেন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক মহাস্থানগড়ের সাইটগুলো খননের ক্ষেত্রেও দীর্ঘদিন ধরে বকর ভাই খণ্ডকালীন কাজ করছেন। ফলে অনেক প্রাতিষ্ঠানিক গবেষকের চেয়েও অত্যন্ত দক্ষ হয়ে উঠেছেন তিনি। আমাদের গবেষক দল বকর ভাই ছাড়াও হাফিজ ভাইয়ের ভ্যানে করে চার কিলোমিটার ব্যাসার্ধের সাইটগুলো পর্যবেক্ষণ করে জিপিএস দিয়ে প্রতিটি সাইটের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের তথ্য নিয়ে প্রত্নস্থলগুলোর মানচিত্র তৈরি করেছে।
বকর ভাই এবং হাফিজ ভাই ছাড়াও শতাধিক ভ্যানচালক মহাস্থানগড়ের পর্যটকদের সাইট ঘুরিয়ে দেখান। এদের সকলেই প্রশিক্ষণহীন ট্যুরিস্ট গাইড হিসেবেই কাজ করেন। বকর ভাইয়ের ভাষ্যমতে মহাস্থানগড় জাহাজ ঘাটের সামনে যে পর্যটন মোটেল গড়ে উঠেছে, সেটার খাবারের দাম অনেক বেশি। যদি স্থানীয়রা ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান দিতে পারত তাহলে পর্যটকেরা স্বল্পমূল্যে ভালো মানের এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার খাওয়ার সুযোগ পেতেন। যেহেতু শীতকালে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পিকনিক করার জন্য প্রচুর মানুষ মহাস্থানগড়ে আসেন, তাই কর্তৃপক্ষ পর্যটন মোটেলের পাশেই গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। এ পার্কিং ব্যবস্থাপনাটি যদিও কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ইউনেস্কো কর্তৃক গাইডলাইন রয়েছে। প্রত্নস্থলের চারদিকে একটি নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধের মধ্যে যান্ত্রিক যানবাহন প্রবেশ নিষিদ্ধ করে প্রত্নস্থলটির বাফার জোন চিহ্নিত করা হয় যেন বাহনের দূষণ দ্বারা প্রত্নস্থল ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। কিন্তু, মহাস্থানগড়ে বাফার জোনের ধারণার প্রয়োগ এখন পর্যন্ত করা হয়নি।
যেহেতু এদেশে পর্যটনশিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে মহাস্থানগড়ভিত্তিক একটি টেকসই পর্যটনশিল্প গড়ে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে, তাই স্থানীয়দের অন্তর্ভুক্তিকরণের মাধ্যমে কীভাবে দেশ ও বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণ বৃদ্ধি করা যায়, সে বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা প্রয়োজন। স্থানীয়দের দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে বেকার যুবদকদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গাইডের কাজ করতে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা; যারা ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প তৈরিতে দক্ষ তাদেরকে সেসব ঐতিহ্য তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করা; ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরিতে সক্ষম জনগোষ্ঠীকে উপযুক্ত স্থানে খাবার বিক্রয় করার সুযোগ করে দেওয়া যায় কীভাবে — সেসব নিয়ে নীরিক্ষাধর্মী প্রচুর গবেষণা প্রয়োজন।
মহাস্থানগড়ের স্থানীয় বেকার যুবকদের ওপর পরিচালিত সমীক্ষা অনুযায়ী, অনেক উত্তরদাতা মনে করেন যে ট্যুরিস্ট গাইড হিসেবে কাজ করতে পারলে তাদের কর্মসংস্থানের নতুন পথ উন্মোচিত হবে। এছাড়াও, গবেষণা চলাকালীন এফজিডি [ফোকাস গ্রুপ ডিসকাসশন] অর্থাৎ উঠোন বৈঠক আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হলো, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হলে অর্থ উপার্জনের পথ প্রশস্ত হবে। আর অর্থ উপার্জনের পথ প্রশস্ত হলে স্থানীয়রা নিজ উদ্যোগে আরও যত্নসহকারে মহাস্থানগড়ের সাইটগুলো সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ হবেন। এক্ষেত্রে, কেবল প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কিংবা বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের ওপর সমস্ত দায় না চাপিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকেও সচেতনতা বৃদ্ধিতে এগিয়ে আসা উচিত। যথাযথ গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ উপস্থাপন করা গেলে নীতি-নির্ধারকদের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজতর হবে। এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে অন্তত একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যভিত্তিক পর্যটন বিষয়ের প্রবর্তন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারলে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার পরিধি বিস্তৃত হবে।
মোঃ রিফাত-উর-রহমান: রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।