উত্থান, পতন, তারপর আবার যেভাবে ঘুরে দাঁড়ালেন ইমরান খান
পাকিস্তানের গণমাধ্যম যখন ইমরান খানের বক্তব্য প্রচারে সামরিক বাহিনীর সেন্সরশিপ মেনে চলছিল– তখন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর দল সামাজিক মাধ্যম টিকটকে প্রচারকাজ চালিয়েছে। পুলিশ যখন তাঁর সমর্থকদের সমাবেশকে নিষিদ্ধ করেছিল– তখন তাঁরা ভার্চুয়ালি সভা করেন অনলাইনে।
এরপর যখন তাঁকে কারারুদ্ধ করা হলো– তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ইমরান খানের গলার অনুকরণে তাঁর বক্তব্য তৈরি ও প্রচার করেছেন সমর্থকরা।
কারাবন্দি ইমরানের বার্তাগুলো দেশটির লাখ লাখ মানুষের মনের কথাই বলেছে– যারা বনেদি রাজনৈতিক পরিবারগুলোর সীমাহীন দুর্নীতি এবং দেশের গভীর অর্থনৈতিক সংকটে গভীরভাবে হতাশা বোধ করেন। সঙ্গে সামরিক বাহিনীর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ নিয়ে ক্ষোভ তো আছেই। এসব কারণে গত কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানের আরও অবনতি হচ্ছে। ইমরান মানুষকে বোঝাতে পেরেছেন, একমাত্র তিনিই হতে পারেন এই সংকটের পরিত্রাতা। তারুণ্যকে সাথে নিয়ে তাঁর নেতৃত্বে দেশ ফিরিয়ে পাবে হৃত গৌরব।
গত বৃহস্পতিবারে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় নির্বাচন। যেখানে ইমরান খান সমর্থিত প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আসনে জয়ের সাফল্য পেয়েছেন। এই ঘটনা পাকিস্তানের রাজনীতির বাকি সব খেলোয়াড়কে বিমর্ষ করেছে। এত দমনের পড়েও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে পিটিআই অনুসারীরা ভোটযুদ্ধে জিতবেন– এমনটা তাঁদের প্রত্যাশিত ছিল না। কারণ, সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের সাথে দ্বন্দ্বের পর ২০২২ সালে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই তাঁর সমর্থকদের ওপর দমনপীড়ন চলেছে। রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে জাতীয় রাজনীতি থেকে সাইডলাইন করতেই নেওয়া হয় এসব পদক্ষেপ।
কিন্তু, ইমরান যেন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। নির্বাচনে তাঁর প্রার্থীদের সাফল্য হয়েছে তাঁরই কারিশমায়। এই ঘটনায়, সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দেশটির রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর কূটকৌশলকে পরাস্ত হয়েছে। যে সামরিক বাহিনী শক্তহাতে বেসামরিক রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে– হঠাৎ যেন তা ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে।
এই ঘটনা আরও প্রমাণ করেছে, ইমরান খান এবং পাকিস্তানের ইন্টারনেট ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত তারুণ্য রাজনীতির সমীকরণ নতুন করে লিখছে। দক্ষিণ এশিয়ার ২৪ কোটি জনসংখ্যার পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী দেশটির এই নয়া বাস্তবতা বিশ্ব রাজনীতির জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ।
ইমরান খান কারাবন্দি, এই অবসরে নির্বাচনের ফলে পিছিয়ে থাকা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা জোট সরকার গঠনে উদ্যোমী। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। ইমরান খানের দলও জোট সরকার গঠনে সমমনাদের সাথে আলোচনা করছে। তবে নওয়াজের মুসলিম লীগই এগিয়ে রয়েছে এই দৌড়ে। এই বাস্তবতায়, নির্বাচনের পরেও সমগ্র পাকিস্তান এক অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে।
তবে আইনপ্রণেতাদের সাথে নিয়ে ইমরান খানের দল যদি সরকার গঠন করতে পারে তাহলে– দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সামরিক বাহিনীর সাথে বিরোধে জড়ানোর পরেও একটি রাজনৈতিক দল প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করবে। যদিও সে সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
কিন্তু, সরকার গঠন করতে পারুন বা নাই পারুন, ইমরান প্রমাণ করেছেন, "রাজনীতিতে তাঁর ভিত্তি নড়ানো যায়নি, এবং অসন্তুষ্ট তরুণদের কাছে তাঁর আবেদন কতোটা ব্যাপক।" এ মন্তব্য করেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কুইন্সি ইনসস্টিটিউটের মিডল ইস্ট প্রোগ্রামের উপ-পরিচালক অ্যাডাম ওয়েনস্টেইন।
তিনি বলেন, "রাজনীতিকে নিজেদের পছন্দমাফিক চালানোর গৎবাঁধা কৌশল প্রাচীন হয়ে পড়েছে; আর গেম চেঞ্জার হয়ে উঠেছে তরুণদের সচেতনতা ও সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার।"
পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইতিহাসের অর্ধেকটা সময় সরাসরি দেশ শাসন করেছে সামরিক বাহিনী। মাঝেমধ্যে যখন বেসামরিক সরকারকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হয়েছে, তখন সর্বময় ক্ষমতা ছিল মুষ্টিমেয় কিছু নেতার হাতে– যাদের মধ্যে রয়েছেন ইমরানের প্রতিদ্বন্দ্বী নওয়াজ শরীফ। বেসামরিক এসব সরকারও ছিল সামরিক বাহিনীর হাতের পুতুল।
সামরিক বাহিনীর অনুগত এই শাসকেরা নিজেদের পরিবার-কেন্দ্রিক দল গড়েছেন; দলীয় নেতৃত্ব এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতেগোণা কিছু পরিবারের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে, যার বাইরে থেকে আসারা সর্বোচ্চ দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির নেতা হতে পেরেছেন।
কিন্তু, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটির তরুণ জনসংখ্যা বেড়েছে বিপুল হারে, বর্তমানে তাঁরাই মোট ভোটারের অর্ধেক। বিশ্লেষকরা বলছেন, পারিবারিক রাজনীতি, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচার দেখে দেখে গভীর হতাশা জন্ম নেয় তরুণদের মধ্যে।
তাঁদের বেশিরভাগ প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলো থেকে মুখ ফেরাতেও শুরু করেন। পাকিস্তানী রাজনীতির একজন শীর্ষ বিশ্লেষক জাইঘাম খান বলেন, কারণ তরুণরা বুঝতে পারছিলেন, "পারিবারিক বা আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকা লোকজনই দিনশেষে দলে অগ্রাধিকার পায়। পুরোনো দলগুলো তাদের বিচারে তখন বাতিলের কাতারে পড়ে যায়– আর তার ফলে ইমরান খানের মতো একজন রাজনীতিকের জন্য স্থান তৈরি হয়।"
এই প্রেক্ষাপটে, সামরিক বাহিনীর আনুকূল্য পেয়ে রাজনীতিতে উত্থান হয় ইমরানের; আর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি তরুণ প্রজন্মের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে পুঁজি করে নিজের রাজনৈতিক ভিত্তিকে দৃঢ় করেন। এভাবেই জেনারেলদের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসেন ইমরান। পাকিস্তানের পারিবারিক ধারার রাজনীতিবিদরা এখানেই তাঁর চেয়ে পিছিয়ে।
ইমরানের দল তেহরিক -ই- ইনসাফ রাষ্ট্রীয় সেন্সরশিপের বাইরে থাকা সামাজিক মাধ্যমে তাঁদের প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে। দেশটির তরুণরা বলছেন, তাঁদের প্রজন্মের মধ্যে দারুণ এক আন্দোলন জাগায় এই প্রচারণা।
সামাজিক মাধ্যমে ইমরান খানের যেসব বক্তব্যের ভিডিও ভাইরাল, সেগুলোতে তাঁকে জেনারেলদের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা করতে শোনা গেছে। ২০২২ সালে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের জন্য সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা এবং বিদেশি শক্তি (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রকে) দায়ী করেন তিনি। একইসঙ্গে জানান যে, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কারপন্থী হওয়ার কারণেই তাঁকে অপসারণ করা হয়েছে। এবং, তিনি যেকোনো মুল্যেই হোক দেশকে সমৃদ্ধি ও আধুনিকায়নের পথে নিতে চান।
তাঁর এই বার্তা দেশব্যাপী ব্যাপক সাড়া ফেলে।
গত বৃহস্পতিবার নির্বাচনের দিন লাহোরের একটি ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে এসেছিলেন ওসমান সাঈদ। ৩৬ বছরের ৩৬ বছরের যুবক বলেন, "আমি পরিবর্তনের জন্য ভোট দিয়েছি। দীর্ঘদিন ধরে যেসব রাজনৈতিক দল দেশ শাসন করেছে– তাঁদের পারিবারিক দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থার ওপর আমি চরম বিরক্ত। তাঁরা ইমরান খানকে জেলে পুরেছে– এটাও আমার ভোট দেওয়ার প্রধান কারণ। এই ঘটনা ইঙ্গিত দেয়, সবকিছু এস্টাব্লিশমেন্ট (সামরিক বাহিনী) নিয়ন্ত্রণ করছে।" সাইদ জানান, এই আসনের পিটিআই প্রার্থী (স্বতন্ত্র)কে ভোট দেন তিনি।
ইমরান খানের ক্ষমতায় থাকার শেষ মাসগুলোর কথা বেশিরভাগ ভোটারই মনে রাখেননি, যখন মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে হতে শুরু করে। এজন্য অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই বলেন, ইমরানকে যদি নিয়মমাফিক তাঁর মেয়াদ পূর্ণ করতে দেওয়া হতো, তাহলে এই নির্বাচনে জিততে পারতেন না তিনি। কারণ, তখন ব্যর্থতার দায়ভার এড়ানো সহজ হতো না।
তবে ক্ষমতাচ্যুত করার পরেও সামরিক নেতৃত্ব ইমরানকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে নেননি, আর এটাই ছিল তাঁদের সবচেয়ে বড় ভুল। দেশের রাজনৈতিক ময়দানের পরিবর্তন তাঁরা হয় আঁচ করেননি, নাহলে পুরোপুরি গোঁয়ার গোবিন্দের মতোন অগ্রাহ্য করেছেন। এটি অনেক বড় গোয়েন্দা ব্যর্থতারও ইঙ্গিত দেয়। সব মিলিয়ে কারাবন্দি ইমরানও যে জেলখানার গারদ পেরিয়ে তাঁদের ভিত্তি ধরে নাড়া দেবেন– কেইবা ভাবতে পেরেছিল!
জেনারেলরা খেলার পুরোনো কৌশলে খেলেছেন, আর আশা করেছেন ইমরানকে রাজনীতিতে সাইডলাইন করা হবে সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু, তাঁরা বুঝতেও পারেননি সময়ই তাঁদের হাতে নেই। আর ইমরান কোনো পারিবারিক রাজনীতির নীল রক্তের উত্তরসূরি নন, তিনি নিজ পরিশ্রমে গড়েছেন রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। এবং তাঁর দেশের জেনারেলদের মতোই ইমরানও একরোখা বলেই পরিচিত।
ফলে বিভিন্ন সম্ভব-অসম্ভব চারটি অভিযোগ প্রমাণের দায়ে ইমরানকে ৩৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলেও– আঘাত ছিল আসন্ন। তাঁর শত শত সমর্থককে গ্রেপ্তার করায়- মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আরও উস্কে দেওয়া হয়। যারা আগে ইমরানকে পছন্দ করতেন না, তাঁদের অনেকের কাছেও তিনি গ্রহণযোগ্যতা পেতে থাকেন।
ব্যালটে পড়েছে তাঁরই প্রভাব। এবারের ভোটের ফলাফল (যদিও তাতে ব্যাপক কারচুপি করা হয়েছে) যেন সামরিক বাহিনীর পছন্দের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে জনতার রায়। যেখানে অভিজাত রাজনীতিবিদ ও ক্ষমতাধর জেনারেলদের এক পাল্লায়, আর অন্য পাল্লায় ইমরানকে রেখে বিচার করেছে জনতা।
গ্রেপ্তার-হয়রানি মানুষকে দমাতে পারেনি। পারেনি জনাব খানের সমর্থন এতটুকুও কমাতে। কারণ প্রতিটি অবিচারের ঘটনা সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে জনগণ জানতে পেরেছে। এবং তাঁরা আরও ক্ষুদ্ধ হয়েছে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ নিয়ে। অনেকেই বলেছেন, জেনারেলদের ওপর তীব্র ক্ষোভ থেকেই এবার তাঁরা ইমরানের প্রার্থীদের ভোট দিয়েছেন।
এপ্রসঙ্গে সামাজিক মাধ্যম 'এক্স' (সাবেক টুইটার) এ পিটিআইয়ের পাঞ্জাব প্রদেশের প্রধান হাম্মাদ আজহার বলেন, "পিটিআই একটি শান্তিপ্রিয় রাজনৈতিক দল– যারা ব্যালটের মাধ্যমে বিপ্লব সংঘটিত করেছে। কুচক্রিদের আমরা নিজেদের সংগ্রাম হাইজ্যাক করতে দেব না।"
তাঁর এই বক্তব্য ইঙ্গিত দেয়, সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট নওয়াজ শরীফ জোট সরকার গঠন করেও শান্তিতে থাকতে পারবেন না। এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় নেতা হয়ে, তাঁকে মসনদে বসে বেশিরভাগ জনতার ঘৃণা বয়ে বেড়াতে হবে।
আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা- গ্যালোপ- এর পাকিস্তান শাখার নির্বাহী পরিচালক বিলাল গিলানি বলেন, "শক্তির ভারসাম্য যদি রাজনৈতিক দলগুলোর দিকেও ঝুঁকে পড়ে, কিন্তু তাঁরা কি নিজেদের মধ্যেই গণতান্ত্রিক হতে পারবে? নাকি তাঁরা দলীয় আদর্শের বিষয়ে আরও বেশি ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠবে? যারা তাঁদের ভোট দেয়নি, সেই মানুষগুলোকে কি তাঁরা বঞ্চিত করবে? এখন এটাই মূল প্রশ্ন।
অনুবাদ: নূর মাজিদ