ওরা আমার ভাইকে হত্যা করতে চেয়েছিল, তবুও সেই জিতেছে: ইমরান খানের বোন
যুক্তরাজ্যের পশ্চিম লন্ডনের ছোট্ট এক ফ্ল্যাটে বসবাস করেন পাকিস্তানের বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ ইমরান খানের বড় বোন রুবিনা খান। পাকিস্তানের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে দ্য সানডে টাইমসকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি।
এসময় তাঁদের পরিবার, ঘনিষ্ঠজন ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের করা মামলাগুলোর ফিরিস্তি দিতে দিতে তিনি বলেন, "গতবছরের মে মাস থেকে আমার ভাই জেলে আছে। সারাদেশের বিভিন্ন আদালতে মামলার হাজিরা দিতে হচ্ছে আমার দুই বোনকে। এরমধ্যে সন্ত্রাসবাদ থেকে শুরু করে সাইবার অপরাধের মতো মামলা রয়েছে।"
এসময় তাঁর এক বোন আলিমা খানের বিরুদ্ধে "ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় রাষ্ট্র-বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে বিভেদ তৈরির" মামলার এজাহারও দেখান তিনি সানডে টাইমসকে।
ইমরান খানের রাজনীতির জন্য পরিবারের সবাইকে কেমন দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে– তাঁরই যথাসম্ভব বর্ণনা দেন রুবিনা।
"খেজুরের বাগান করবে বলে বাড়ির পাশে মরুভূমির এক খণ্ড জমি কিনেছিল আমার এক বোন, সেই জন্য তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করা হয়েছে। আমাদের এক ভাগ্নে ও তাঁর স্ত্রীকে (নিরাপত্তা বাহিনী) তুলে নিয়ে যায়। আরেক ভাগ্নে গোয়াদার বন্দর দিয়ে স্পিডবোটে করে পালায়, এসময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করা হচ্ছিল। এরপর তাঁর সাথে কাজ করা ঠিকাদারের পেছনে লাগে ওরা। গত মে মাস থেকে এক বোনের গাড়িচালক জেলে রয়েছে। আমার বাবার আমল থেকে কাজ করা আমাদের বাড়ির বৃদ্ধ বাবুর্চিকে জেলে রাখা হয়। সেখানে তিনি মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এখন তাঁকে ভেন্টিলেটরে রাখতে হচ্ছে।"
"ওদের অধঃপতন, নীচতা সবচেয়ে হতবাক করে দেয়… তাঁরা শুধু রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না, এমনকি তাঁর ভাই-বোন, বাবুর্চি, ড্রাইভার সবার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। সবার বিরুদ্ধে যে তাঁরা তৎপর হবে– এটাই যেন বুঝিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া এমন হুটহাট করে এসব করা হয়, যাতে সব সময় শঙ্কা কাজ করে যেকোনো সময়েই একটা কিছু অঘটন ঘটবে। কিন্তু, তাঁদের এই অত্যাচার বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে…"
৭৩ বছরের রুবিনা খান জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা এবং পাকিস্তানে কয়েদি নম্বর ৮০৪ বলে বিখ্যাত ক্রিকেট তারকা থেকে রাজনিতিবিদ হয়ে ওঠা ইমরান খানের বড় বোন। কারাবন্দি সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর সমর্থিত প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে সর্বোচ্চ সংখ্যক আসনে জয়লাভ করেন। গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চমক দেখিয়েছেন তাঁরা। আর এই জয় এসেছে ইমরান খানের কারিশমায়। তাঁর প্রতি জনগণের অনুরাগ ও আস্থা থেকে।
ইমরানের দল তেহরিক -ই- ইনসাফ (পিটিআই) যেন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে সেজন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করেছে সামরিক বাহিনী।
নির্বাচনের আগের দুই সপ্তাহে আরও বহুকিছু করা হয়। সুষ্ঠু বিচার ছাড়াই ইমরানকে ২৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, এমনকী তৃতীয় স্ত্রীর সাথে 'অবৈধ ও ইসলাম-বিরুদ্ধ বিবাহের" মতো হাস্যকর অভিযোগে তাঁকে আরও ৭ বছরের সাজা দেওয়া হয়।
তার আগে দলের অনেক নেতাকেই পোরা হয় কারাগারের অন্ধ কুঠুরিতে, শুধুমাত্র দলত্যাগের শর্তে রাজি হয়েই তাঁদের অনেকে পরে ছাড়া পান।
এরপরও যারা ইমরানের জন্য মরণপণ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন, যারা তাঁদের আনুগত্য ছাড়েননি, তাঁদেরকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে বাধ্য করা হয়। দলের নির্বাচনী প্রতীক 'ক্রিকেট ব্যাট' বাতিল থেকে শুরু করে দলীয়ভাবে নির্বাচনেও বিধিনিষেধ দেওয়া হয়। যে প্রেক্ষাপটে, স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করেন পিটিআই প্রার্থীরা। সেখানেও তাঁদের দেওয়া হয়েছিল- জুতা, গাধা ও ইঁদুরের মতো উদ্ভট প্রতীক। পাকিস্তানে যেখানে নিরক্ষরতার হার বিপুল, যেখানে দলীয় প্রতীক ভোটের মাঠে প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের নিয়ামক– সেখানে এই প্রতিকূলতা ছিল আকাশসম। তাঁর ওপর অনেকে গ্রেপ্তার হন, বা গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপন করেন। ফলে নির্বাচনী জনসভা ও প্রচার-প্রচারণা করতেও পারেননি। এই দমনের মুখে প্রার্থীরা গেরিলা কৌশলে নামেন ভোটযুদ্ধে, আত্মগোপনে থেকেই টিকটক বা ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক মাধ্যমে ভোটারদের সাথে গণসংযোগ চালান।
এত কিছু করে, সামরিক বাহিনীর কর্তারা হয়তো গোঁফে তা দিতে দিতে ভাবছিলেন, খুব জব্দ করা গেল! কিন্তু, এত করেও ভবি উলটেছে। তিনি সরকার গঠন করতে পারুন না পারুন, ইমরান কিন্তু এরমধ্যেই জিতে গেছেন।
.আজ রোববার পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের মোট ২৬৬ আসনের মধ্যে ২৬৩ আসনের ফল ঘোষণা করা হয়েছে। এরমধ্যে ১০১টিতে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যাঁদের ৫ জন বাদে সবাই পিটিআই সমর্থিত। নির্বাচনে ৭৫ আসনে জয় পেয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) এবং ৫৪ আসনে জয় পেয়েছে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)।
এই নির্বাচনের ফল ঘোষণায় দুই দিন সময় নেওয়া, এবং সেই অবসরে অনেক আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হারিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু, তারমধ্যেও এক "নীরব বিপ্লব" ঘটে গেছে বলে অনেকেই মনে করেন।
শুক্রবার রাতেই জেল থেকে দেওয়া বার্তায় বিজয়ের ঘোষণা দেন ইমরান। কৃতজ্ঞতা জানান দেশবাসীকে।
সামাজিক মাধ্যম 'এক্স' সাবেক টুইটারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে প্রচারিত বার্তায় বলা হয়, "আমার বিশ্বাস ছিল, আপনারা সবাই ভোট দিতে আসবেন। আপনারা সেই আস্থার মর্যাদা রেখেছেন, আপনাদের এই ব্যাপক অংশগ্রহণের হার সবাইকে চমকে দিয়েছে।"
ইমরানের বড় বোনও ভাইয়ের এই জয়ে উচ্ছ্বসিত। তিনি বলেন, "এমনকী যারা ওকে ঘৃণা করতো– তাঁরাও আমাকে বলেছে তাঁরা পিটিআই'কে ভোট দিয়েছেন। আমার হোয়াটসঅ্যাপ ভোট দেওয়ার পর আঙ্গুলে কালির ছাপ দেওয়া এমন শত শত ছবি এসেছে। অনেকে যুক্তরাজ্য থেকে পাকিস্তানে গিয়ে ভোট দিয়েছেন। এই পরিস্থিতি শুধু আমার ভাইয়ের জন্য নয়, বরং পুরো পাকিস্তানের জন্য দেশবাসীর ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ।"
পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই কখনো সরাসরি, কখনোবা পর্দার অন্তরালে থেকে মূল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছেন দেশটির সেনাবাহিনীর শীর্ষ জেনারেলরা। কিন্তু, ইমরানকে তাঁরা হারাতে পারেননি। রুবিনা খানের কথায়, "তাঁদের প্রতিটি দমনপীড়ন আমার ভাইকে আরও জনপ্রিয় করেছে। তাঁরা ওকে হত্যার চেষ্টা করেছিল, এরপর হাস্যকর সব অভিযোগে কারাগারে ভরেছে। তাঁরা ওর সহকর্মীদের জেলে পুরেছে, এমনকী ক্যান্সার এক আক্রান্ত এক নারীকেও ছাড়েনি।"
রুবিনা মনে করেন, এত অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে শেষ রায় পাকিস্তানের জনগণই দিয়েছে।
সংক্ষেপিত অনুবাদ: নূর মাজিদ