বগুড়ার তিন জমজের মেডিকেল জয়
প্রায় এক যুগ আগে স্বামী হারানো আর্জিনা বেগম তার তিন জমজ সন্তানের মাধ্যমে যেন স্বপ্ন জয় করেছেন। রত্নগর্ভা এই মায়ের জমজ তিন সন্তানই মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। অভাবের সংসারের হাল ধরা আর্জিনা জমি বিক্রি করে সন্তানদের মানুষ করার প্রয়াস আলোর মুখ দেখেছে।
আর্জিনা জানালেন, তার তিন জমজ সন্তান শিক্ষকের ছেলে। তিন ছেলে যেন শিক্ষকের মান রক্ষা করতে পারেন, সেই লক্ষ্যে তাদের সমর্থন দিচ্ছেন তিনি।
তিন সন্তানকে আগলে রাখা রত্নগর্ভা মা আর্জিনা বেগম বলেন, 'এরা ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় ভালো ছিল। ভালো রেজাল্ট করেছে। আলাদা কোনো গাইড দেওয়া লাগেনি। নিজের ইচ্ছায় তারা পড়ালেখা করেছে। পাইলট স্কুল থেকে গোল্ডেন এ প্লাস পায়। তখন ঠিক করলাম, লেখাপড়া ভালোমতোই করাব। শিক্ষকের ছেলে, যেন তার নাম থাকে। তখন তাদের পিছে টাকা খরচ করেছি, যাতে মানুষের মতো মানুষ হয়। তারপর তারা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। এজন্য আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শোকর।'
সন্তানদের পড়ালেখা করাতে নিজের জমি বিক্রি করেছেন আর্জিনা বেগম। বললেন, 'আমার শেরপুরে জমি ছিল, সেটা বিক্রি করেছি। বাপের বাড়ির জমি ছিল, সেটাও বিক্রি করেছি। জমি বিক্রি করেই এতদূর পড়াইছি। এখন সরকার যদি আমার ছেলেদের পড়ালেখার খরচটা দেখে তাহলে উপকার হয়।'
ঘটনা বগুড়ার ধুনট উপজেলার বথুয়াবাড়ী গ্রামের। মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়া তিন ভাই হলেন: মো. মাফিউল হাসান, মো. সাফিউল ইসলাম ও মো. রাফিউল হাসান। তাদের মধ্যে গত বছর মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পান মাফিউল। এবার পরীক্ষা দিয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন শফিউল ও রাফিউল। তাদের বাবা গোলাম মোস্তফা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। ২০০৯ সালে মারা যান তিনি। এরপর থেকে মা আর্জিনা বেগম তাদের আগলে রাখেন। নিজের সর্বস্ব দিয়ে সন্তানদের সুশিক্ষিত হিসেবে গড়তে করে গেছেন লড়াই সংগ্রাম। তার ফলও পেয়েছেন।
সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে বথুয়াবাড়ী গ্রামে মেডিকেল কলেজে ভর্তি ও তাদের অধ্যাবসায় নিয়ে কথা হয়। তিন ভাই মাধ্যমিক পড়ালেখা করেছেন ধুনট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। ২০২০ সালে সেখান থেকে তিন ভাই এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস নিয়ে পাশ করেন। এরপর উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য তারা ভর্তি হন বগুড়ার সরকারি শাহ সুলতান কলেজে। ২০২২ সালে গোল্ডেন এ প্লাস পান এই তিন ভাই্।
তবে ২০২৩ সালে প্রথমবারের চেষ্টায় তিন ভাইয়ের মাঝে শুধু মো. মাফিউল হাসান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এবার সেই আফসোস পুষিয়ে নিয়েছেন বাকি দুভাই। এবারের ভর্তি পরীক্ষায় মো. সাফিউল ইসলাম দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল ও মো. রাফিউল হাসান নোয়াখালীর আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।
উচ্চমাধ্যমিকে থাকার সময় মেডিকেলে পড়ার স্বপ্ন বোনার শুরু বলে জানান রাফিউল হাসান। বললেন, 'মূলত ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার জন্য বগুড়ায় থাকা শুরু। তখন দেখতাম বায়োলজি পড়তে ভালোই লাগত। তারপর দেখলাম ডাক্তারি একটা মহান একটা পেশা। এ পেশার মাধ্যমে মানুষকে সরাসরি সেবা করা যায়। একেবারে হাতেকলমে বলা যায়।'
মেডিকেলে ভর্তির জন্য পরিশ্রমের পাশাপাশি ভাগ্যও লাগে, বললেন রাফিউল। তিন ভাই চিকিৎসাশাস্ত্রের পড়ার সুযোগ পেয়ে অনেক খুশি তিনি।
রাফিউল জানান, 'তিন ভাইয়ের একসাথে মেডিকেলে পড়ার সুযোগ সাধারণত দেখা যায় না। অনেক সময় এক গ্রামে হয়তো একজন সুযোগ পায়। সেখানে তিন ভাই এমন সুযোগ পাওয়া বিরল ঘটনা। প্রথমবার না হতে পেরে খারাপ লাগেনি। আমাদের তো আরেকবার সুযোগ ছিল, তাই ভেঙে পড়িনি।'
প্রথমবার পরীক্ষায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের দন্ত বিভাগে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন মাফিউল হাসান। তবে ভর্তি হয়েও মন খারাপ ছিল বাকি দুই ভাইয়ের জন্য। মাফিউল বলেন, 'নিপীড়িত মানুষের সবচেয়ে খারাপ সময়ে সেবা দেওয়ার একটা জায়গা হলো ডাক্তারি পেশা। সেখান থেকে মূলত ডাক্তারি পেশায় আসার প্রবল ইচ্ছা ছিল। সেই কারণে তিন ভাই মেডিকেল প্রিপারেশন নেয়া শুরু করি।
'কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রথমবার আমার হলেও দুই ভাইয়ের অল্পের জন্য মিস হয়। ওইজন্য আমার মন খারাপ ছিল। তারপর পরবর্তী সময়ে তারা পুনরায় প্রস্তুতি শুরু করে। সেই ধারাবাহিকতায় দুই ভাইও সরকারি মেডিকেলে চান্স পায়। যারা আমাদের দুঃসময়ে পাশে থেকেছেন, তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।'
সাফিউল ইসলাম বলেন, 'আমার ইচ্ছা আছে, আমার গ্রামের মানুষ যারা গরিব, দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, হুজুর, তাদের নিয়ে কাজ করা। আমি যখন ভালো ডাক্তার হব, ছুটিতে এলে তাদের ফ্রি চিকিৎসা দেব।'
মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পাওয়া তিন ভাইয়ের চাচা ও ধুনট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলাম ফারুক বলেন, 'ওদের বাবা তো ২০০৯ সালে মারা যান। তিনি ছিলেন হাইস্কুলের শিক্ষক। ওদের মা এই সংসারের হাল ধরেছেন। ওদের মা অনেক কষ্টে সন্তানদের পড়ালেখা করিয়েছেন। অর্থনৈতিক সমস্যা ছিল, অনেক সমস্যা ছিল। কিন্তু পড়ালেখা চালিয়ে গেছে। আমরাও তাদের উৎসাহিত করেছি।'