‘যুদ্ধগুলো আমাদেরকেই লড়তে হবে, এবং বেশিরভাগ সময়ে আমরা একাই থাকব’
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2020/07/01/1._arundhti_raayy_0.jpg)
[অরুন্ধতী রায়ের সাক্ষাৎকারটি ইমেইলের মাধ্যমে দলিত ক্যামেরার পক্ষ থেকে নেওয়া]
প্রশ্ন: আমরা কিভাবে আমেরিকায় চলমান বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে সমর্থন জানাতে পারি আর কিভাবে ভারতে প্রতিবাদরত মানুষদের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে পারি?
অরুন্ধতী রায়: আমি ধরে নিচ্ছি, আপনি জর্জ ফ্লয়েডকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করার ঘটনাটির বিরুদ্ধে যে বড় ধরনের প্রতিবাদ চলছে, তার ব্যাপারে বলছেন। এটা ছিল শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান পুলিশ দ্বারা আফ্রিকান-আমেরিকানদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত ধারাবাহিক হত্যাযজ্ঞের সর্বশেষ ঘটনা।
আমি বলবো যে এই আন্দোলনকে সমর্থন করার জন্য সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে প্রথমে অনুধাবন করা এর উৎপত্তি কোথায়। তার সাথে জানতে হবে দাসপ্রথার ইতিহাস, বর্ণবাদ এবং নাগরিক অধিকারের আন্দোলন সম্পর্কে এবং এদের সাফল্য ও ব্যর্থতার বিস্তারিত ইতিহাস। উত্তর আমেরিকায় আফ্রিকান আমেরিকানরা বিভিন্ন সূক্ষ্ম ও স্থুল ধরনের বর্বরতা, বেআইনি কারারুদ্ধকরণ এবং বঞ্চনার শিকার হয়, এবং তা প্রতিষ্ঠিত "গণতন্ত্রের" সীমারেখার মধ্যে থেকেই।
আমাদেরকে সাথে এটাও বুঝতে হবে, এসব ঘটনায় আমেরিকায় বসবাসরত ভারতীয় সম্প্রদায়ের ভূমিকা কতটুকু। ঐতিহ্যগতভাবে কারা এ ধরনের আন্দোলনে শরীক হয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদেরকে নিজেদের সম্প্রদায় সম্পর্কে আরো ভাল করে জানার সুযোগ করে দেবে।
সাম্প্রতিক ঘটনার জন্য যে বিশাল আকারের আক্রোশের প্রদর্শনী হচ্ছে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও গোষ্ঠী জুড়ে- আমরা তাতে সমর্থন জানাতে পারি। যদি আগে আমরা আমাদের নিজেদের বিশ্বাস এবং কাজগুলো সততার সাথে সামনে নিয়ে আসতে পারি। আমরা নিজেরাই একটি অসুস্থ সমাজে বাস করি; যেখানে কেউ ভ্রাতৃত্ববোধ ও সংহতি অনুভব করে না।
প্রশ্ন: আমেরিকার কু ক্লাক্স ক্ল্যান এর মতাদর্শ ও চর্চাগুলো এবং জাত হিন্দুদের দ্বারা আয়োজিত কথিত গোহত্যা জনিত গণপিটুনিতে সংখ্যালঘু হত্যা কি একই ধরনের কার্যক্রম?
অরুন্ধতী: অবশ্যই মিল আছে এ'দুয়ের মাঝে। বড় পার্থক্য একটাই- যেটা হলো; কু ক্লাক্স ক্ল্যান কাউকে খুন করার সময় একটি নাটকীয় আবহ তৈরি করতো। আজকের দিনের আরএসএস এর মতো। ওই সময়ে, ক্ল্যান ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক প্রভাবশালী সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম।
ক্ল্যানের সদস্যরা পুলিশ ও বিচার বিভাগসহ সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানেই ঢুকে পড়েছিল। ক্ল্যানের সংঘটিত সকল খুনগুলো শুধু খুনই ছিল না, সেগুলো ছিল ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মত। এগুলোর উদ্দেশ্য ছিল আতংক ছড়ানো এবং মানুষকে শিক্ষা দেয়া। কেকেকে (ক্লু ক্ল্যাক্স ক্ল্যান) যেভাবে আমেরিকান কালো মানুষদের হত্যা করেছিল- একইভাবে হিন্দু ভিজিলান্টিরাও দলিত এবং মুসলমানদেরকে হত্যা করছে।
সুরেখা ভটমাঙ্গে এবং তার পরিবারের কথা মনে আছে? অবশ্যই সুরেখা ভটমাঙ্গে এবং জর্জ ফ্লয়েড ভিন্ন মানুষ এবং তাদের জীবন সংগ্রামও ভিন্ন। সুরেখা এবং তার পরিবারকে তারই গ্রামের লোকজন নির্মভাবে হত্যা করেছিল।
পুলিশ সদস্য ডেরেক শভিন- জর্জ ফ্লয়েডকে বেশ নাটকীয় ভাবে হত্যা করেছিল। তার এক হাত পকেটে ঢোকানো ছিল আর সে ফ্লয়েডের গলার ওপর তার হাঁটু চেপে ধরে রেখেছিল। অন্য পুলিশরা তাকে সাহায্য করছিল; তারা পাশে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিল। সে জানতো তাকে অনেকেই দেখছে এবং ভিডিও করছে। তারপরেও সে কাজটা করে। কারণ সে বিশ্বাস করতো যে সে সুরক্ষিত, আইন তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এই মুহুর্তে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী এবং হিন্দু আধিপত্যবাদী উভয় দলের প্রতি সহানূভুতিশীল প্রচুর মানুষ রয়েছে (হালকা করে বলতে গেলে)—এবং তাদের অনেকেই বেশ উঁচু পদে আসীন। এ কারণে উভয় দলই বেশ সরব।
প্রশ্ন: আমরা দেখছি ভারতীয়রা ব্ল্যাকলাইভসম্যাটার হ্যাশট্যাগকে ট্রেন্ডিং বানিয়েছে। কিন্তু এই একই দেশে তাহলে আমরা কেন দেখি কালোদের ওপর উপর্যুপরি আক্রমণ? কিভাবে ভারতীয়রা কালোদেরকে দেখে, অথবা তাদের ব্যাপারে ভারতীয়দের গৎবাঁধা ধারণাটি কি?
অরুন্ধতী: ভারতীয়দের ফর্সা চামড়ার প্রতি দুনির্বার আকর্ষণের দিকে লক্ষ্য করুন। এটা আমাদের সমাজের সবচেয়ে বিরক্তিকর একটি বৈশিষ্ট্য। আপনি যদি বলিউডের কোন ছবি দেখেন, তাহলে আপনার মনে হবে ভারতে সবাই ফর্সা। ভারতীয়দের কৃষ্ণকায় মানুষদের প্রতি বর্ণবাদী আচরণ, সাদাদের বর্ণবাদী আচরণের চেয়ে কোন অংশে কম না। এটি প্রায় অবিশ্বাস্য একটি ব্যাপার।
আমি আমার কালো চামড়ার বন্ধুদের সাথে থাকা অবস্থায় রাস্তাঘাটে এ ধরণের আচরণ অবলোকন করেছি। মাঝে মাঝে এমন মানুষের কাছ থেকে এরকম আচরণের শিকার হতে হয়- যাদের নিজেদের চামড়ার রঙও তেমন একটা ভিন্ন নয়! খুব কম সময়ই আমি এর চেয়ে বেশি রাগান্বিত ও লজ্জিত হয়েছি। সেই বর্ণবাদ পরবর্তীকালে সরাসরি আক্রমণে রুপান্তরিত হয়। ২০১৪ সালে আম আদমি পার্টি দিল্লীর নির্বাচনে একটি বড় ধরনের জয় লাভের পর- আইনমন্ত্রী সোমনাথ ভারতী একদল লোককে নিয়ে মধ্যরাতের রেইডে খিরকিতে উগান্ডা ও কঙ্গোবাসী কিছু মহিলাকে শারীরিকভাবে আঘাত করেন এবং তাদেরকে অপমান করেন- "অনৈতিক এবং অবৈধ" কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগ তুলে।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2020/07/01/3._prtibaade_aandolne_arundhti.jpg)
২০১৭ সালে আফ্রিকান ছাত্রদেরকে একটি ভিজিলান্টি মব (আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া বিশৃঙ্খল জনতা) বৃহত্তর নোয়দাতে আক্রমণ করে পিটিয়েছিল; অবৈধ মাদক বিক্রী করার অজুহাত দেখিয়ে। কিন্তু ভারতে বর্ণবাদের স্বরূপ অনেক বিস্তৃত এবং বিচিত্র। কে ভুলতে পারবে নোয়দায় আক্রমণের পরে বিজেপির সংসদ সদস্য তরুণ বিজয়ের আক্রমণাত্মক বাণী—"আমরা যদি বর্ণবাদীই হতাম, তাহলে কেন গোটা দক্ষিণ ভারতের তামিল, কেরালা, কর্ণাটক এবং অন্ধ্রের বাসিন্দাদের সাথে একত্রে থাকতাম? তারা কেন আমাদের সাথে থাকে?"। তার উচিত কালো দক্ষিণ ভারতীয়দেরকে বিস্তারিত জানানো। এই প্রসঙ্গে আমরা তার যুক্তিগুলো শুনতে চাই।
প্রশ্ন: যখন আফ্রিকান আমেরিকানরা যুক্তি দেয় #ব্ল্যাকলাইভসম্যাটার, এশিয়ানরা বলে #এশিয়ানলাইভসম্যাটার এবং সাদারা বলে #অললাইভস ম্যাটার
অরুন্ধতী: এটা অর্থহীন ও গতানুগতিক কিছু উক্তির মাধ্যমে মূল প্রসঙ্গ থেকে রাজনীতিকে সরিয়ে দেওয়ার একটি চতুর উপায়। এশিয়ান এবং শ্বেতাঙ্গদেরকে আফ্রিকানদের মতো হত্যাকান্ড, জেল-হাজত, বঞ্চিতকরণ ও দারিদ্র্যের সম্মুখীন হতে হচ্ছে না। দাসপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক সামাজিক ব্যবস্থা ও আইনের গন্ডির মধ্যে থেকেই; কীভাবে কৃষ্ণাঙ্গ-আমেরিকানদেরকে বিকল্প উপায়ে, হিংস্রতার সাথে দমিয়ে এবং বন্দি করে রাখা যায়- সেটার একটি সমন্বিত প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ এবং যুদ্ধাংদেহী মনোভাবের আন্তর্জাতিক উপাখ্যান; ভিয়েতনামের গণহত্যা, জাপান, ইরাক এবং আফগানিস্তানের পৃথক পৃথক কাহিনী এসব কিছু মিলিয়ে মনে হয় না যে তারা #এশিয়ানলাইভসম্যাটার এবং #অললাইভসম্যাটার জাতীয় চিন্তাধারাকে সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করে।
প্রশ্ন: যখন দলিতরা বলে #দলিতলাইভসম্যাটার এতে কি শত শত বছর ধরে কালোরা যে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তাকে ছোট করা হয় না? এই আন্দোলনটি কি বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
অরুন্ধতী: জাত-বৈষম্য এবং বর্ণবাদ, দু'টোর ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস থাকলেও এদের মাঝে খুব বেশি পার্থক্য নেই। শুধু জাত-বৈষম্যতে একটি দৈব আদেশ প্রাপ্তির দাবি করা হয়- যা বর্ণবাদের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। আমার মতে, দলিতদের আন্দোলনকে আফ্রিকার কালো মানুষদের শত বছরের সংগ্রামের সাথে এক কাতারে বসানোকে কিছুটা রুঢ় মনে হয়। তবে আমার এমনও মনে হয় এটা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশের পাশাপাশি- সেই সুতীব্র আন্দোলন থেকে কিছুটা শক্তি দলিতদের আন্দোলনে টেনে এনে তাকে আরো অর্থবহ করার একটি প্রয়াস। ভারতের জাত ভিত্তিক বৈষম্য আন্তর্জাতিক নজরদারিতে আসেনি দীর্ঘদিন। এমনকি সবচেয়ে উচ্চ সম্মানপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবি এবং শিক্ষাবিদরাও এ ব্যাপারে খুব বেশি উচ্চবাচ্য করেননি।
তবে এটা বলা যায় যে, বর্ণবাদের উর্ধ্বে কেউই নন। বিভিন্ন জায়গায় এটি ভিন্ন ভিন্ন চেহারায় দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ; দক্ষিন আফ্রিকার কালোরা নাইজেরিয়ান এবং অন্যান্য আফ্রিকানদের প্রতি জাতিবিদ্বেষ অনুভব করে। আর আমরা জানি যে, ভারতে শুধু ব্রাক্ষণরাই নয়, সকল "জাত" এর সদস্যরাই তাদের নিচে থাকা জাতগুলোকে কম বেশি অবদমন করে থাকে। এবং এই চর্চা শুধু দলিতদের সাথেই হয়, কথাটি সঠিক না।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2020/07/01/2._arundhti_raayy_0.jpg)
প্রশ্ন: ভারতে কেন এখনও কালোদেরকে সবাই মাদক সরবরাহকারী, হিংস্র এবং মানুষখেকো মনে করে এবং কেনই বা ভারতীয় সংবাদ এবং বিনোদন মিডিয়াতেও তাদেরকে সেভাবেই উপস্থাপন করা হয়?
অরুন্ধতী: কারণ আমরা ঐতিহ্যগত ভাবেই বর্ণবাদী। গত বছর আমি একটি মালায়ালাম সিনেমা দেখেছিলাম, যার নাম ছিল আবরাহামান্দে সান্থাথিকাল (আব্রাহামের ছেলেরা)। সিনেমার হিংস্র এবং নির্বোধ খলনায়কগুলোর প্রত্যেকেই ছিল কালো আফ্রিকান এবং যথারীতি মালায়ালি সুপারহিরো তাদের দফারফা করে দিয়েছিল। কেরালায় আফ্রিকানদের কোনো গোষ্ঠী নেই, তাই চিত্রপরিচালক তাদের কল্পনার জগতে আমদানী করে এনেছিলেন, বর্ণবাদের ধারণাকে প্রচার করার জন্য! এটা কোন জাতিগত নৃশংসতা নয়। এটা সমাজ, মানুষ, শিল্পী, চিত্রনির্মাতা, নায়ক এবং লেখকদের ব্যাপার—এখানে যে কারণে উত্তর ভারতের লোকেরা দক্ষিন ভারতের লোকদেরকে তাদের কৃষ্ণ চামড়ার জন্য অপমান করে, সেই একই কারণেই দক্ষিণ ভারতে আফ্রিকানদেরকে অপমানিত করা হয়েছে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এ যেন একটি অতল গহ্বরে প্রবেশের মত ব্যাপার।
প্রশ্ন: আমেরিকায় আন্দোলনের সময় গান্ধীর মূর্তিকে ভাংচুর করা হয়েছে। এর পেছনে কারণ কি থাকতে পারে?
অরুন্ধতী: এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, মূর্তি ভাংচুর করা হয়েছিল এবং তার উপর স্প্রে করে গ্রাফিতি এঁকে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ছবিতে দেখা যায় যে মূর্তিটি ঢেকে রাখা হয়েছে। তাই কেউ সঠিক করে জানে না যে, গ্রাফিতিতে আসলে কি লেখা হয়েছিল। এটা কি ঘানা ও অন্য কিছু দেশে সংগঠিত ধারাবাহিক ভাংচুরের অংশ; যা ঘটিয়েছিল কিছু মানুষ যারা জানতো দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকা অবস্থায় গান্ধী কালো আফ্রিকানদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী মন্তব্য করেছিলেন। নাকি এটি তারাই ঘটিয়েছে যারা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখার কারণে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি প্রচন্ড রকম বিতৃষ্ণ? আমার আসলে জানা নেই। আবার এটাও সত্য যে অনেক প্রতিবাদী গান্ধীর ছবি টুইট করেছে অণুপ্রেরণার উৎস হিসেবে; যিনি অহিংস এবং সভ্য প্রতিবাদের কৌশলের ক্ষেত্রে একাধারে তাদের শিক্ষক এবং পরামর্শদাতা। গান্ধীর উপস্থিতি পাওয়া যায় পথেঘাটে; বিভিন্ন ব্যানারে ও প্ল্যাকার্ডে।
প্রশ্ন: কেন ভারতীয় সরকার গান্ধী-মূর্তি তৈরির জন্য টাকা স্পন্সর করে? আলোচ্য মূর্তিটির অর্থায়ন করেছিলেন অটল বিহারী বাজপায়ী এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এরকম আরো বেশ কিছু মূর্তি নির্মিত হয়েছে। একদিকে ভারত রাষ্ট্র বিভিন্ন দেশে গান্ধী-মূর্তির প্রচারণা চালাচ্ছে, আর আরেকদিকে নিজের দেশেই সর্ব বৃহৎ সামরিক জোন বানানো হয়েছে আর দেশীয় সম্প্রদায় দিনে দিনে আরো অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছে—এই ব্যাপারটা কিভাবে অনুধাবন করা যায়?
অরুন্ধতী: ভাল হোক কিংবা খারাপ হোক, গান্ধী ভারতের সবচেয়ে বড় রপ্তানিযোগ্য পণ্য। তার অহিংস বাণীগুলো দেশজুড়ে অবলম্বন করা ভারত সরকারের চরম সহিংস সামরিক নীতির পাশেই আরামে উপবিষ্ট রয়েছে। তাদের কাছে গান্ধী একটি যন্ত্র ব্যতিত কিছুই নন। উনি একটি সেবা। একটি ধোঁয়াশা। টিয়ারগ্যাসও হতে পারেন। এমনকি সামাজিকভাবেও, একজন নিজেকে "গান্ধী মতাবলম্বী" বলে দাবি করলেও- সে জাত বৈষম্য থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। আমরা এখনও এই জাত বৈষম্যের সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে নিয়ে চলছি, এটা জানা স্বত্তেও যে এরকম একটা ব্যবস্থা পাকাপাকিভাবে সহিংসতাকে উৎসাহিত করে।
প্রশ্ন: আপনার কি মনে হয় লকডাউন এবং স্টেট অফ এক্সেপশান অ্যাক্টটি ভারতে কোভিড-১৯ মোকাবেলার জন্য সঠিক কৌশল ছিল? নাকি সেগুলো তাড়াহুড়া করে নেয়া সিদ্ধান্ত ছিল- যা অনেকের জীবনকে শঙ্কার মুখে ঠেলে দিয়েছে? এবং হঠাৎ করে সবকিছু নতুন করে খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তের ব্যাপারেও আপনার মন্তব্য কি?
অরুন্ধতী: ভারতে প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্তের খবরটি রিপোর্ট করা হয়েছে গত ৩০ জানুয়ারিতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মার্চের ১১ তারিখে কোভিড-১৯ কে মহামারি হিসেবে আখ্যা দেয়া স্বত্বেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছিল; এটি কোন জরুরি অবস্থা নয়। অথচ তখনই তাদের উচিত ছিল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে বন্ধ করে দেয়া এবং যাত্রীদেরকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো। তখন এসব তারা করেনি। হয়তো এটি এ কারণেই করা হয়নি কারণ তখন ট্রাম্প এসেছিলেন। তিনি এসেছিলেন ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে। হাজার হাজার মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুম্বাই এবং আহমেদাবাদে উড়ে এসেছিল "নামাস্তে ট্রাম্প" র্যালিতে অংশ নেয়ার জন্য। শেষ পর্যন্ত যেটাতে শত সহস্র মানুষ অংশ নিয়েছে। এখন এই দু'টি শহর করোনাভাইরাস দ্বারা বিধ্বস্ত।
এটা কি একটি কাকতালীয় ঘটনা? কিভাবে একজন তাবলিগ জামাতের উপর কালিমালেপন এবং একই সাথে নামাস্তে ট্রাম্পকে মহিমান্বিত করাকে সমর্থন করতে পারে? শুরুতে সমাজের উঁচু শ্রেণীতে বসবাসকারী মানুষ- যারা বিমানযাত্রী, তাদেরকে কোয়ারান্টাইন না করে সরকার অপেক্ষা করেছে। তাদের এই ভূল নীতির কারণে এখন কর্মী শ্রেণীকে কড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। যখন মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়, তখন ৫৪৫টি আক্রান্তের ঘটনা এবং ১০টি মৃত্যু ছিল মাত্র। এটি ছিল উন্নত বিশ্বকে অনুকরণ বা "কাট-পেস্ট' করা লকডাউন; ইতালি ও স্পেনে যা করা হয়েছিল সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাকে বাধ্যতামূলক করার জন্য।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2020/07/01/4._chbi_melaar_aamntrnne_ddhaakaayy_esechilen_arundhti_raayy_4_maarc_2019.jpg)
পরিকল্পনার অভাবে সবার উপর যে দুর্যোগ নেমে এসেছে তা একটি অপরাধমূলক কাজ; এটি এক ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন। ভারতে শুধু উচ্চবিত্তরাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পেরেছে। গরীবরা সংকীর্ণস্থানে যেমন; বস্তি, ছোট ছোট বাসা এবং অবৈধ কলোনিতে বসবাস করার কারণে এই সুবিধাটি উপভোগ করতে পারেনি। একদিকে যেমন "অপারেশান বান্দে ভারাত" এর মাধ্যমে বিদেশে আটকে থাকা ভারতীয় নাগরিকদেরকে উড়িয়ে আনা হয়েছে দেশে, অপরদিকে লাখ লাখ কর্মী শ্রেনির মানুষ বিভিন্ন শহরে অসহায় অবস্থায় আটকে ছিল কোনো খাদ্য, আশ্রয় ও অর্থ ব্যাতিরেকে। কোনো যানবাহন না থাকায় তারা বাধ্য হয়েছিল হাজার হাজার কিলোমিটার হেঁটে নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যেতে। আরও শত সহস্র্ মানুষকে জোর করে কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছিল। আর যখন তাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল, তখন তারা বাসে ও ট্রেনে গাদাগাদি করে- ভাইরাসকে সাথে নিয়ে অবশেষে নিজ নিজ গ্রামে ফিরতে পেরেছিল। এখানে উন্মোচিত হয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর অপারগতা। তারপরও এ ব্যর্থতার পাশাপাশি তার আছে সুবিশাল অহমিকা। যার কারণে তিনি বিশেষজ্ঞদের অভিমত চাওয়ার কোন প্রয়াস নেননি।
তিনি ১৩৮ কোটি মানুষকে চার ঘন্টার নোটিশে লকডাউন করে ফেলেন। কিন্তু কেন? কীভাবে? কারণ তিনি তা পারেন। কারণ সবাই—রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং এমনকি বিজেপিতে তার নিজের সহকর্মীগণ—সকলেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার পরিণতিকে ভয় পান। সবার মস্তিষ্ক ভীতির কারণে বরফাচ্ছাদিত হয়ে আছে। অথবা তাকে কীভাবে খুশি করে কোনো সুবিধা আদায় করে নেয়া যাবে- সেই চিন্তায় মশগুল হয়ে আছে । আমরা নিজেরাই তার হাতে সেই ক্ষমতা তুলে দিয়েছি।
পুরো লকডাউনের সময়টাতে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছিল। এখন যখন গ্রাফটি উঁচু পাহাড়ের চূড়ার মত। আর আমাদের আক্রান্তের সংখ্যা লাখ লাখ এবং সাথে সাথে অর্থনীতিও পুরোপুরি ধ্বসে পড়েছে—তারা লকডাউন উঠিয়ে নিয়েছে। ভাগ্যক্রমে, বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই তেমন কোন উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না, এবং মৃত্যুর সংখ্যা এখনো আমেরিকার তুলনায় কম—যদি আমরা সরকারিভাবে প্রকাশিত উপাত্তের উপর ভরসা রাখতে পারি। কিন্তু লাখো মানুষ কর্মহীন। ক্ষুধা তাদেরকে গ্রাস করছে। সেই গ্রামগুলোতে কি হচ্ছে, যেখানে অনেক মানুষ ফিরে গেছে? এই ভীতি, হতাশাবোধ এবং চাহিদার সময়ে মানুষ কিভাবে জাত বিদ্বেষ, সামন্ততন্ত্র ও পুরুষতান্ত্রিকতার মত জটিল ব্যাপারগুলোকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখবে?
কিন্তু মোদি এখনও চাইছেন রাফায়েল ফাইটার জেট বিমান কিনতে। চাইছেন বিশ হাজার কোটি টাকা খরচ করে দিলির কেন্দ্রীয় ভিস্তাকে পুনঃবিন্যাস করতে। এবং এর মাধ্যমে নিজস্ব একটি স্থাপত্যের নিদর্শন রেখে যেতে। আমার ধারণা, এর মাঝে তিনি এই দুর্যোগ মোকাবিলার ভার রাজ্য সরকারের উপর ছেড়ে দেবেন। যাদের সাথে তিনি লকডাউন চালু করার আগে একবারও শলাপরামর্শ করেননি। কিন্তু এখন ঠিকই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য তাদেরকে দোষারোপ করবেন।
তিনি এবং তার অনুগত গণমাধ্যম এই দ্বৈত বিপর্যয়কে তার নিজস্ব সাফল্য হিসেবে মানুষের কাছে প্রচার করবে। ৭২,০০০ এলইডি স্ক্রিনের ভার্চুয়াল নির্বাচনী প্রচারণার মাধ্যমে বিহারে এই কাজটি শুরু হয়ে গিয়েছে। মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে, কিন্তু এরকম একটি কাজের জন্য তাদের কাছে অর্থ রয়েছে। এর মাঝেই বর্ণনাগুলো সাম্প্রদায়িকতার দিকে ফিরে যাচ্ছে দ্রুত। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া এবং জেএনইউ-এর ছাত্রদেরকে গ্রেফতার করা হচ্ছে- যাদেরকে পুলিশ এবং হিন্দুত্ববাদী দুর্বৃত্তরা নির্মমভাবে আক্রমণ করেছিল তাদের নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই। তাদেরকে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে সংঘটিত নৃশংসতার পরিকল্পনাকারী হিসেবে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এর মূলে আসলে ছিল পুলিশের মদদপুষ্ট হিন্দু ভিজিলান্টি দলগুলো এবং তারাই নিরীহ মুসলমানদের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। এটা ভিমা-করেগাঁও কাণ্ডের দিল্লি সংস্করণ। এ দু'টি ঘটনার প্রেক্ষিতে ভারতের কিছু শ্রেষ্ঠ আইনজীবি, আন্দোলনকারী কর্মী, শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবিগণ এখন জেলখানায়। তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোও বেশ অভিনব।
প্রশ্ন: ভারত সরকার নিজে গোড়াপত্তন করেছে ডিজিটাল ভারত প্রকল্পের। "ডিজিটাল প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো" এবং "বেগবান অর্থনৈতিক উন্নতি ও নাগরিক ক্ষমতায়ন" এর উদ্দেশ্যে। 'আরোগ্য সেতু অ্যাপ' এবং 'মাইগভকরোনাহাব'কে উন্মোচিত করা হয়েছে এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে। আপনার মতে, ভারত সরকার ডিজিটাল প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো বলতে ঠিক কী বোঝাচ্ছে? কে ঠিক করবে যে, কোন ভারতীয় নাগরিকেরা ক্ষমতায়নের আওতায় আসবে, এবং কীভাবে? এবং কাদেরকে এই প্রকল্প থেকে জাতীয়ভাবে বাদ দেয়া হবে- যেখানে বেশিরভাগ বাসিন্দাই দেশের আইনগত নাগরিক?
অরুন্ধতী: বর্তমান হার অনুযায়ী, ২০২২ সালে ভারতে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা হবে প্রায় ৪৪ কোটি। এটা অনুমিত জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ। এখন, এমনকি শিশুদের ক্ষেত্রেও প্রত্যাশা করা হচ্ছে যে- অনলাইন শিক্ষার জন্য তাদের কাছে স্মার্টফোন থাকবে। এই বিশ্লেষণ থেকে পরিষ্কার দেখা যায়, ডিজিটাল ভারত প্রকল্পে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ বাদ থেকে যাবে। যে আ্যপগুলোর কথা আপনি বললেন, সেগুলো এখনও পুরোপুরি কার্যকার নয়। এবং তাদেরকে অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় উন্মোচিত করা হয়েছে। বিল গেটসের মত চিন্তা করা বিপদজনক; তিনি বিশ্বাস করেন যে, প্রযুক্তি ও কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বিশ্বের বড় বড় সমস্যা যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং দারিদ্র্যকে দূরীভূত করবে। কিন্তু আমাদের দরকার রাজনৈতিক সমাধান। অবিচার, ক্ষুধা, বর্ণবাদ, জাত বিদ্বেষ, ইসলাম ভীতি এবং পরিবেশগত ধ্বংস এসব নব্য-উদার প্রকল্পের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এভাবে চলতে থাকলে আমরা একটি বেসরকারিকরণ করা পুঁজিবাদী ও নজরদারিপ্রবণ রাষ্ট্রে পরিণত হব।
প্রশ্ন: সম্প্রতি, দেভিকা নামের একজন দলিত ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে কারণ তার কাছে অনলাইন শিক্ষাগ্রহণ করার কোন উপায় ছিল না। কেরালা সরকার অনলাইন শিক্ষাকে সব ছাত্রছাত্রীদের জন্য নিয়মতান্ত্রিক এবং বাধ্যতামূলক বানানোর চেষ্টা করছিল। ঐতিহাসিকভাবে, প্রযুক্তিকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ভারতে, প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা হচ্ছে আরো বিভাজন তৈরি এবং মানুষকে আওতার বাইরে রাখার উপলক্ষ হিসেবে, যেমনটা আমরা দেভিকার ক্ষেত্রে দেখলাম। আমরা এই অসঙ্গতিকে কিভাবে দূর হবে?
অরুন্ধতী: আমার ধারণা আমি পূর্বের প্রশ্নগুলোর উত্তরে এই প্রশ্নটির বেশিরভাগ অংশেরই উত্তর দিয়ে দিয়েছি। অনলাইন শিক্ষা সেসব শিশুদের জন্য বিপর্যয়মূলক হতে পারে যারা অবস্থাপন্ন পরিবার থেকে আসেনি। দেভিকা আত্মহত্যা করেছিল কারণ সে নিজেকে অপসৃত অবস্থায় দেখতে পাচ্ছিল। তার ছিলনা কোন স্মার্টফোন, এবং তার পরিবার এতটাই গরীব ছিল যে নষ্ট টিভি ঠিক করানোর মত অর্থও তাদের ছিল না। তার মত লাখ লাখ মানুষ আছে। কিন্তু যাদের স্মার্টফোন আছে, তাদের জন্যেও স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, এবং ক্লাসের বাইরে যা যা হয়, তার সব কিছুই অনেক গুরুত্বপূর্ণ—ক্লাসের ভেতরের ঘটনাগুলোর মতই। দলিত, আদিবাসী এবং মুসলমানেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে অনেক বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। কিন্তু এসব যুদ্ধে আমাদেরকে জয়ী হতে হবে এবং সম্মিলিতভাবে। অনলাইনে আটকে থাকা আমাদের সমাজের জন্য সবচেয়ে বিপদজনক ব্যাপার হতে পারে। আমি গভীরভাবে ভীত এই অনলাইন শিক্ষার বিস্তারে—ক্ষমতাসীন সরকারগুলো অনেকদিন ধরেই ইচ্ছা পোষণ করে আসছে শিক্ষাখাত থেকে অর্থায়ন তুলে নেয়ার ব্যাপারে, এবং এই খাতকে বেসরকারিকরণ করে ফেলার। তারা এ পথেই এগোবে। আমরা যা হতে দিতে পারি না।
প্রশ্ন: সম্প্রতি আপনি, এবং আরো অনেক আন্তর্জাতিক সক্রিয় কর্মী এবং শিক্ষাবিদগণ "প্রোগ্রেসিভ ইন্টারন্যাশনাল" নামক একটি প্রয়াস চালু করেছেন। আমরা এর আগেও এরকম বিভিন্ন উদ্যোগ দেখেছি। কিন্তু সেগুলো বেশিরভাগ সময়ই খুব দ্রুত অকেজো হয়ে পড়ে এবং রাজনীতিকদের দেখা স্বপ্নগুলোও খুব দ্রুতই জাতীয়তাবাদ আর গোষ্ঠিবাদের কাছে হারিয়ে গেছে। জাতীয় পপুলিজম এবং বৈশ্বিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে কিভাবে প্রগতিশীল আন্তর্জাতিকীকরণ সামনে এগিয়ে যাবে?
অরুন্ধতী: আন্তর্জাতিক উদ্যোগগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা আমাদেরকে একটি পরিপ্রেক্ষিত, বোধশক্তি এবং সামান্য পরিমাণে প্রতিরক্ষা প্রদান করে- যা আমাদের সংহতি প্রতিষ্ঠার পথে সহায়ক হয়। এটা এই মুহুর্তে বিশেষ জরুরি, যখন আমাদের মত দেশের মূল রাজনৈতিক আদর্শ হচ্ছে হিন্দু জাতীয়তাবাদ। কিন্তু আন্তর্জাতিকীকরণ কখনোই আমাদের অভ্যন্তরীণ প্রতিবাদ এবং আন্দোলনের স্থলাভিষিক্ত হতে পারবে না। এভাবে চিন্তা করাটা একটি বড় ভুল হবে। আমাদের নিজেদের যুদ্ধগুলো আমাদেরকেই লড়তে হবে, এবং বেশিরভাগ সময়ে আমরা একাই থাকবো। কেউ আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবে না।
প্রশ্ন: চলমান এনআরসি-সিএএ-এনপিআর বিরোধী আন্দোলনে আমরা দেখছি সংবিধান এবং ভারতের জাতীয় পতাকাকে বেশ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আমাদের প্রশ্নটি সংবিধান সংক্রান্ত। আপনার কি মনে হয় যে সংবিধানকে ব্যবহার করা হচ্ছে দলিত-বাহুজান-মুসলমান সংক্রান্ত মূল ইস্যু থেকে মানুষের মনোযোগকে অন্যদিকে সরানোর জন্য? এর পরিণাম কি হতে পারে?
অরুন্ধতী: এটি একটি জটিল বিষয়। ভারতের সংবিধান প্রণেতা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ডক্টর আমবেদকার, আর সেই কমিটি এমন একটি সংবিধান তৈরি করেছিল যা সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। প্রথমবারের মত নৈতিক ও আইনগতভাবে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল যে সকল ভারতবাসীর একই অধিকার রয়েছে, এবং তাদের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। ভারতের মত একটি বৈচিত্র্যময় দেশ, যেখানে জাতপ্রথা বেশ ভাল করেই প্রচলিত, এবং যেখানে সমাজের উঁচু ও নিচু উভয় শ্রেণিতেই (কেবলমাত্র সবচেয়ে উঁচু আর সবচেয়ে নিচুর বাসিন্দারা ছাড়া) শাসক ও শোষক; উভয় ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হবার উপায় ও প্রচলন আছে, সে দেশের জন্য এরকম একটি নীতিবান সংবিধান প্রণয়ন বিরাট ব্যাপার ছিল।
দলিতদের জন্য এটি একটি ধর্মগ্রন্থের মত পবিত্র বইতে পরিণত হয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো যে আমবেদকার নিজেই এই সংবিধানের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে নাখোশ ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে এটি একটি জীবন্ত দলিলের মত হবে, এবং প্রতিটি প্রজন্ম কাজ করবে এটিকে আরো সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য। কিন্তু বাস্তবে যা হয়েছে তা হল এই সংবিধানকে হিন্দু আধিপত্যবাদের সাথে মিলিয়ে পরিবর্তন করার চাপ এসেছে, এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে এই চাপকে প্রতিহত করার পেছনেই বেশি সময় খরচ করতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট সবাইকে।
আমাদেরকে এখন সংবিধানের চারপাশে সমবেত হতে হবে এবং এটাকে রক্ষা করার জন্য কাজ করতে হবে। যারা আরএসএসের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সংবিধান প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত, তাদেরকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে এই কাজটি করতে হচ্ছে। ২০১৯ ছিল একটি বেদনাদায়ক বছর। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রদ করা এবং মুসলিম বিরোধী নাগরিকত্বের সংশোধিত আইন এটাই বুঝিয়েছে। নতুন করে সংবিধান লিখে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়ার চেয়ে; এই সরকার বরং একে অবজ্ঞা করে এমন আচরণ করছে যাতে মনে হয় যেন আমাদের কোন সংবিধানই নেই।
মুসলমানদেরকে দানবের রূপ দেয়া, দেশদ্রোহী ও পাকিস্তানের প্রতি সহানূভুতিশিল কিংবা সন্ত্রাসবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করে যে হিংস্র এবং অমানবিক ভাষা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে মূলধারার মিডিয়া, তা নজিরবিহীন। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ এবং কোর্টের পক্ষপাত এবং রাস্তাঘাটে তাদের বিরুদ্ধে ঘটানো অকারণ রক্তপাত—এসব কিছু বিপ্লবী মুসলমানদেরকে একটা পথই দেখিয়েছে, আর তা হলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভারতের পতাকা হাতে নিয়ে সংবিধানের কথাগুলো সবাইকে মনে করিয়ে দেয়া। একদিকে যেমন মুসলমানদেরকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করা হচ্ছে, আবার অপরদিকে মূলধারার টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রকাশ্যে প্রচার করা হচ্ছে হ্যাশট্যাগ #coronajehad এবং #humanbombs, আর আমরা শুনছি মুসলমানদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে অপারগতা প্রকাশের ভয়াবহ গল্পগুলো। এসব কিছুই ঘটছে সিএএর প্রতিবাদ চলাকালীন সময়ে, এবং আমাদেরকে করোনা আঘাত করার পরে। এদিকে আবার বিজেপির কপিল মিশ্র বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর অনুরাগ ঠাকুর এখন রাজ্য অর্থমন্ত্রী; যিনি "দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক শালাদের গুলি করো" শ্লোগান মূখর মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন দিল্লি দাঙ্গার প্রাক্কালে।
এই ঘটনাগুলো নগ্ন-উস্কানিমূলক এবং তা উপর থেকে আসছে। আমরা কি কখনো ভুলতে পারবো সেই দৃশ্য, যেখানে পুলিশ ফাইজানের গলার ভেতর লাঠি ঢুকিয়ে তাকে বাধ্য করেছিল জাতীয় সংগীত গাইতে, আর সে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল? আপনি কি ধারণা করতে পারেন আমেরিকায় কোন আফ্রিকান-আমেরিকানের সাথে এরকম ঘটলে তার পরিণাম কি হতো? কোথায় আমাদের লজ্জা? সে যাই হোক, সংবিধান সংক্রান্ত আপনার প্রশ্নের উত্তরে বলতে পারি, ভারতে কে প্রতিবাদ করতে পারবে আর কে কী বলতে পারবে; তা তাদের জাত, ধর্ম, গায়ের রঙ এবং লিঙ্গের ওপর নির্ভর করে। এখানে সমতা বলে কোন কিছু নেই—সমতার কোন চিহ্নই নেই আসলে। এমনকি কেউ এরকম ভাবও নেয় না যে এখানে সমতা আছে। এটা আমাদের জাতিগত অভিশাপ, যা আমাদেরকে বুদ্ধিমত্তা, সামাজিক ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে। সবার জন্য ন্যায়, সুবিচার ও সম্মানের জন্য লড়তে পারার চেয়ে আনন্দদায়ক আর কিছুই হতে পারে না। এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আমাদেরকে শ্রেণি, জাত, ও লিঙ্গ বিভাজন এবং সাম্প্রদায়িকতার আতস কাঁচের ভেতর দিয়ে তাকাতে হবে। এটা আমাদের আন্দোলনসমুহ এবং যেসব শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হবে- উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমরা এটা না শিখতে পারলে, সবসময়ই পিছিয়ে থাকব।
- অনুবাদ: ই. খান