চর্বি, চিনি, বর্জ্য: ২০৫০ সাল নাগাদ যেসব অদ্ভুত জিনিস থেকে তৈরি হতে পারে বিমানের জ্বালানি
চর্বি ও চিনি থেকে তৈরি জ্বালানি পুড়িয়ে একটি বিমান গত বছর প্রথমবারের মতো আটলান্টিক মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়েছে। ভবিষ্যতে কোনো এক সময় হয়তো বিমানের জ্বালানি হিসেবে আর পেট্রোলিয়াম ব্যবহার করা হবে না। বরং চর্বি, শর্করা, চিনি, বর্জ্য, ঘাস ও খরগোশের অন্ত্রে পাওয়া এক বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়ার মতো অপরিচিত সব উৎস থেকে তৈরি হবে উড়োজাহাজের জ্বালানি।
অন্তত আমেরিকান, ডেল্টা ও ইউনাইটেডের মতো এয়ারলাইনগুলো এমন লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এগোচ্ছে। এ কোম্পানিগুলো ২০৫০ সালের মধ্যে তাদের কার্বন নিঃসরণ শূন্যের পর্যায়ে নিয়ে আনতে চায়।
বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণরর ২ শতাংশের জন্য দায়ী বিমানসংস্থাগুলো। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার ক্ষেত্রে গাড়ি ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাপেক্ষে এখনো অনেক পিছিয়ে আছে বিমানপরিবহন ব্যবসা। কারণ বাণিজ্যিক বিমানকে বিদ্যুৎশক্তিতে চালানোর জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী ও হালকা কোনো ব্যাটারির নকশা করা খুবই কঠিন।
তাই কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে বিমানপরিবহন খাতে এখন সবচেয়ে বাস্তবসম্মত উপায় হচ্ছে তুলনামূলক পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উৎস ব্যবহার করা। এ ধরনের জ্বালানি সাসটেইনেবল এভিয়েশন ফিউয়েল (সাফ) নামে পরিচিত।
কিন্তু সমস্যা হলো, বিমানপরিবহন শিল্পের জ্বালানি চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত সাফ একদমই নেই। গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের টেকসই জ্বালানি যতটুকু তৈরি করতে পেরেছিল, তা এ পরিবহন খাতটির জ্বালানি চাহিদার ০ দশমিক ২ শতাংশেরও কম।
২০৫০ সালের মধ্যে এ হারকে ১০০ শতাংশ করতে চায় বাইডেন প্রশাসন। এ লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বিমানের জ্বালানি পরিশোধন কোম্পানিগুলোকে নতুন ও ক্ষেত্রবিশেষে অদ্ভুত কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে জেট ফিউয়েল তৈরির জন্য।
কিন্তু এসব জ্বালানি উৎসের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন, কোনোটি তৈরি করতে দীর্ঘ কয়েক বছরের গবেষণার দরকার হবে। কোনোটির জন্মানোর পরিসর সীমিত। আবার কোনো কোনো উৎসের নিজস্ব পরিবেশগত সমস্যা তৈরি হতে পারে।
আবার এসব জ্বালানি উৎসের কোনোটির একার পক্ষে চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে না। আসন্ন বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি নতুন বস্তু ব্যবহার করে জ্বালানি তৈরি করার চেষ্টা করতে পারে সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলো।
মার্কিন বাজারে পরবর্তী টেকসই জেট জ্বালানিটি তৈরি হতে পারে ভুট্টা ও আখের মতো ফসল থেকে। রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে এসব ফসল থেকে ইথানল তৈরি করছে। এ ইথানল গ্যাসোলিন ও ডিজেলে মিশ্রিত করে গাড়ি ও ট্রাকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
বর্তমানে বিভিন্ন পরিশোধনাগার ইথানলকে জেট ফিউয়েলে রূপান্তরিত করতে কারখানা স্থাপন করছে। এ ধরনের একটি বিকল্প উদ্যোগ লাঞ্জাজেট সম্প্রতি নিজেদের কারখানায় অ্যালকোহলকে বিমানের জ্বালানিতে রূপ দিয়েছে। লাঞ্জাজেট ব্যাকটেরিয়া দিয়ে গাঁজন প্রক্রিয়ায় অ্যালকোহলে পরিণত করা মার্কিন ভুট্টা, ব্রাজিলীয় আখ এবং কারখানার ধোঁয়া থেকে তৈরি ইথানল ব্যবহার করে বিমানের জ্বালানি উৎপাদন করবে।
কিন্তু ফসল থেকে জ্বালানি তৈরির অন্যতম সীমাবদ্ধতা হলো এটি বর্জ্য থেকে তৈরি জ্বালানির মতো টেকসই হবে না। পৃথিবীতে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ সীমিত। জৈবজ্বালানি তৈরিতে চাষজোগ্য জমির পরিমাণ বাড়ালে তার ফলে বাড়তি পানির ব্যবহার ও বন ধ্বংসের মতো বিভিন্ন পরিবেশগত প্রভাব তৈরি হতে পারে।
যেমন, কেবল যুক্তরাষ্ট্রের বিমানপরিহন শিল্পের সম্পূর্ণ জ্বালানি চাহিদা ভুট্টার তৈরি ইথানল থেকে মেটাতে হলে দেশটিকে ১১৪ মিলিয়ন একর জমিতে ভুট্টা চাষ করতে হবে। এ পরিমাণ জমি ক্যালিফোর্নিয়ার আয়তনের চেয়েও বেশি।
অলাভজনক সংস্থা এনভায়রনমেন্টাল ডিফেন্স ফান্ড-এর জ্বালানি রূপান্তর বিভাগের প্রধান মার্ক ব্রাউনস্টেইন বলেন, 'এভিয়েশন খাতের চাহিদা মেটাতে আপনি যদি প্রচুর পরিমাণে ইথানল তৈরি শুরু করেন, তাহলে ব্যাপারটা হবে এমন: আপনি একধাপ এগোচ্ছেন তো দুই ধাপ পিছিয়ে যাচ্ছেন।'
এ কারণে ইউরোপীয় নীতিমালায় ফসল থেকে তৈরি বেশিরভাগ জৈবজ্বালানিকে 'টেকসই' হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ভবিষ্যতের জ্বালানি উৎসের অন্যতম বড় আরও দুটি উৎস হতে পারে বর্জ্য ও ঘাস।
'সেলুলসিক কভার ক্রপস' হচ্ছে ঘাসের দানার এক ধরনের জাত যা মাটিকে উর্বর রাখার জন্য জমির মূল ফসলি মৌসুমের মধ্যবর্তী সময়ে জন্মে। এ ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ থেকে জেট জ্বালানি তৈরির চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ফসলের মৌসুম শেষ হওয়ার পরে যেহেতু এ ঘাসগুলো জমিতে জন্মায়, তাই মূল ফসলের সঙ্গে এগুলোর কোনো প্রতিযোগিতা তৈরি হবে না এবং ফলে এর থেকে সৃষ্ট জ্বালানিও বেশি টেকসই হবে।
কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান বর্জ্য পদার্থকেও উড়োজাহাজের জ্বালানিতে পরিণত করছে। এরকম একটি পরিশোধনাগার হলো ফুলক্রাম বায়োএনার্জি। ২০২২ সালে এটি বর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরি করার একটি প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে।
এক্ষেত্রে একটি সীমাবদ্ধতা হলো সবধরনের বর্জ্য পদার্থ থেকে জ্বালানি তৈরি করা যায় না। সবচেয়ে ভালো জ্বালানি তৈরি হয় কাগজ, টেক্সটাইল ও প্যাকেজিং বর্জ্য থেকে। কৃষিবর্জ্য থেকেও জেট ফিউয়েল তৈরি করা সম্ভব।
এ পদ্ধতিতে বিমানের জ্বালানি তৈরি করা খুবই ব্যয়বহুল। এছাড়া এ ধরনের জ্বালানি বিক্রি করার মতো কোম্পানির সংখ্যাও বেশি নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ক্ষেত্রটি এখনো গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে।
ভবিষ্যতে হয়তো কোম্পানিগুলো বাতাস, পানি ও বিদ্যুৎ থেকেই জেট জ্বালানি তৈরি করতে পারবে। এ ধরনের জ্বালানি তৈরির মূল উপাদান হলো সবুজ হাইড্রোজেন। এ পদ্ধতিতে পানির অণুকে বিদ্যুতায়িত করে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনকে আলাদা করা হয়। সৌর বা বায়ু শক্তি থেকে যদি এ বিদ্যুৎ তৈরি করা যায়, তাহলে এ পদ্ধতিতে কার্বন নিঃসরণ প্রায় শূন্য পর্যায়ে নেমে আসবে।
এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো বাতাস থেকে কার্বন সংগ্রহ করে তা হাইড্রোজেনের সঙ্গে মিশ্রিত করে জেট ফিউয়েল তৈরি করতে পারবে।
তবে ২০৩০-এর দশকের আগে হাইড্রোজেন থেকে খুব বেশি পরিমাণে জেট ফিউয়েল তৈরির সম্ভাবনা নেই। অবশ্য এ পদ্ধতিতে উৎপাদন বাড়তে থাকলে এটিই ভবিষ্যতে সবচেয়ে টেকসই জেট জ্বালানির উৎস হয়ে উঠতে পারে।