কর বহির্ভূত আয় বাড়াতে সরকারি সেবার মূল্য বাড়ানোর পরিকল্পনা
রাজস্ব আয়ে প্রত্যাশার চেয়ে হচ্ছে কম প্রবৃদ্ধি। এরমধ্যেই সরকারি বিভিন্ন সেবার ফি ও মূল্য প্রদান বাড়িয়ে কর বহির্ভূত উৎস থেকে আয় বাড়ানোর উপায় খুঁজছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আগামী অর্থবছরে সরকারের আয় ও ব্যয়ের ব্যবধান কমিয়ে আনতেই এমন পরিকল্পনা।
অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা তাঁদের সাম্প্রতিক বৈঠকগুলোর বরাত দিয়ে জানান, যেসব সেবার ফি গত তিন বছরে পরিবর্তন হয়নি, সেগুলো বাড়িয়ে নতুন করে নির্ধারণ করতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে অনুসারে, ইতিমধ্যে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ জনগণকে দেওয়া তাদের সেবার ফি ও চার্জ পুনঃনির্ধারণে কমিটিও গঠন করেছে।
কিছু বিভাগ প্রায় এক দশক ধরে তাদের সেবা মূল্য বা ফি বাড়ায়নি। আগামী অর্থবছরে (২০২৪-২৫) তারা এটি সংশোধন করলে জনসাধারণ, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের বেশি খরচ করতে হবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ডিভিডেন্ড, আমানতের সুদ, সেবা মূল্য ও অন্যান্য চার্জ থেকে কর বহির্ভূত আয় হয়, যা কর রাজস্বের পর সরকারের আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস। কিন্তু, এটি মোট বার্ষিক রাজস্বের দশ ভাগের এক ভাগের সামান্য বেশি, যা অন্যান্য উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশের তুলনায় অনেকটাই কম।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সক্ষমতা এবং সেবা প্রদানের উন্নতি না করতে পারলে– শুধু মূল্য বাড়িয়ে কর-ব্যতীত আয় তেমন বাড়বে না। অন্যথায়, সরকারি সেবার ফি ও চার্জ বাড়ানোর ফলে জনসাধারণের খরচই কেবল বাড়বে; এরমধ্যেই যাদের জমি ও গাড়ির গাড়ির নিবন্ধন বা পাসপোর্ট এর মতোন সেবা নিতে বেশ বড় 'উপরি' মূল্যও চুকাতে হচ্ছে।
বড় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সেবামূল্য কি খুবই কম?
সম্ভাবনার চেয়ে অনেক কমই রয়ে গেছে কর বহির্ভূত উৎস থেকে রাজস্ব আয়। এতে ডলার সংকটে দেশে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড যখন স্তিমিত হয়ে পড়েছে, তারমধ্যেই শুল্ক ও কর রাজস্ব আয় বাড়ানোর ক্রমাগত চাপের মধ্যে রয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
জাতীয় বাজেটে কর-বহির্ভূত এবং নন-এনবিআর উত্স থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও, আরও বেশি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর রাজস্ব অর্জনের জন্য মূলত এনবিআরের ওপরই সমস্ত মনোযোগ দেওয়া হয়।
আমদানি হ্রাস এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ধীরগতি সত্ত্বেও, এনবিআর জানুয়ারি পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে কর ও শুল্ক থেকে আয়ে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। কিন্তু, সারা বছরের জন্য যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে– সেটি অর্জন করার পক্ষে যথেষ্ট বৃহৎ।
কর বহির্ভূত আয়ের অংশ– সরকারি প্রতিষ্ঠানের ডিভিডেন্ট, আমানতের সুদ, সেবামূল্য থেকে আয় – বাংলাদেশে ১১ শতাংশের মধ্যে আটকে থাকছে। অথচ এটি উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর সরকারি আয়ের একটি প্রধান উৎস।
চীনের মোট রাজস্বের ৪০ শতাংশ হচ্ছে কর বহির্ভূত আয়। মালয়েশিয়ায় যা ২৭ শতাংশ, এমনকি ছোট অর্থনীতির দেশ ভূটানে তা ২৮ শতাংশ।
ভারতের সামগ্রিক রাজস্বের মধ্যে কর বহির্ভূত আয় বাংলাদেশের প্রায় কাছাকাছি। তবে চলতি অর্থবছরে যখন কর রাজস্ব কমে গিয়েছিল, তখন ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয় কর-বহির্ভূত রাজস্বের ব্যাপক বৃদ্ধি। যা ভারতের রাজস্ব ঘাটতি কমাতে অবদান রাখে।
বাংলাদেশেও কোনো কোনো সময় কর বহির্ভূত রাজস্ব বেড়েছে। যেমন ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়েছিল মোবাইল অপারেটরদের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার স্পেকট্রাম বিক্রি এবং রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে জমে থাকা বাড়তি তহবিল ফেরত নেওয়ায়।
২০১৯-২০ অর্থবছরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ১৬ হাজার কোটি টাকার বাড়তি তহবিল ফেরত নেওয়া হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যা এই দুই অর্থবছরের কর বহির্ভূত আয়ের যথাক্রমে অর্ধেকের বেশি ও এক-তৃতীয়াংশ ছিল।
কিন্তু, এই ধরনের আয় সব বছরেই হয় না। এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে ফি ও সেবামূল্য থেকে আয় বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করার অনুরোধ করেছে।
এরই প্রতিক্রিয়ায় সরকারের বিভিন্ন বিভাগ তাদের সেবামূল্য বাড়ায়, এতে সরকারি সেবা পেতে জনগণের ব্যয় বাড়লেও কর বহির্ভূত আয় বাড়াতে সামান্যই ভূমিকা রাখে। একারণে প্রতি অর্থবছরেই কর-বহির্ভূত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা হ্রাস করা হয়।
গতবছরও সরকারের বিভিন্ন পার্কে প্রবেশ ফি, হাসপাতালের আউটডোরে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার টিকেটের ফি, বিভিন্ন যানবাহনের জন্য সেতুগুলোর টোলের পরিমাণ বাড়ানোসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরপরও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এ খাতের রাজস্ব সংগ্রহ হবে না বলে মনে করছেন খোদ অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।
২০২৩ এ সমাপ্ত অর্থবছরে কর বহির্ভূত আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যা পরে সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা করা হয়। কিন্তু, প্রকৃত আয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতের লক্ষ্যমাত্রা ৫০ হাজার কোটি টাকা– যা মোট রাজস্বের মাত্র ৭ শতাংশ। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, উচ্চ মূল্যষ্ফীতির কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কম হওয়ায় এটি পাঁচ হাজার কোটি টাকা হ্রাস করা হবে বলে ধারণা করছেন কর্মকর্তারা।
অবশ্য, কর বহির্ভূত আয় প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৬৪.৫ শতাংশ বেড়ে ১৭ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা হয়েছে, যা এই সময়ের মধ্যে অর্জিত মোট রাজস্বের ১৮ শতাংশের বেশি। এই ঘটনা হয়তো অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের আরও উচ্চ লক্ষ্যমাত্রার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহিত করেছে, আগামী অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে ৫৫ হাজার কোটি টাকা।
এছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে অটোমেশন বা অনলাইন সেবা চালু হওয়ায় গ্রাহকের পরিশোধ করা অর্থ সাথে সাথে সরকারের কোষাগারে জমা হচ্ছে। এতেও আগামী অর্থবছরে আয় বাড়বে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
কর বহির্ভূত আয় বাড়ানো কি সম্ভব?
সেবার মান উন্নত করার পাশাপাশি, দুর্নীতি বা অনিয়ম রোধ করা গেলে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সেবা থেকে আয় বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে বলে আর্থিক বিশ্লেষকরাও মনে করেন।
তাঁরা বলেছেন, সরকারি ফি ও সেবামূল্য দেখতে কম মনে হলেও সেবা গ্রহীতাদের তাঁর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি খরচ করতে হয়। কর বহির্ভূত আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো– যাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, ক্রমাগত লোকসানের ধারাবাহিকতা থেকে বেরিয়ে আসা ও আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দেন বিশেষজ্ঞরা।
নাম না প্রকাশের শর্তে অর্থ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দাবি করেন, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। আবার দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির ফলে রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে মানুষের ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সেবা গ্রহণের হার বেড়েছে। "ফলে নন ট্যাক্স রেভিনিউ সংগ্রহ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেবা মূল্য বাড়ানো ও নতুন ফি বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে" বলেও জানান তিনি।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, রাষ্ট্রীয় সংস্থার সেবার মান উন্নত না হওয়া, নতুন উৎস চিহ্নিত না হওয়া এবং অনিয়মের কারণে কর বহির্ভূত উৎস থেকে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ছে না। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্যের মতো দেশ উন্নত সেবা নিশ্চিত করে এই খাত থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, কর বহির্ভূত রাজস্বে সর্বোচ্চ অবদান রাখে সুদ আয়, তারপরেই আছে প্রশাসনিক বিভিন্ন ফি, ডিভিডেন্ট ও রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর আমানতের সুদ আয় এবং সরকারি সম্পত্তি ভাড়া বা ইজারার মাধ্যমে পাওয়া আয়।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান টিবিএসকে বলেন, সরকারি সম্পত্তি লীজ (ইজারা) দেওয়ার পদ্ধতি আরও প্রতিযোগিতাপূর্ণ করতে হবে। কারণ অনেক ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রতিযোগিতার অভাবে সরকার ন্যায্য মূল্য পায় না। একইসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও দক্ষতার সাথে পরিচালনা করতে হবে, যা ব্যয় কমিয়ে এনে এসব প্রতিষ্ঠান আরও বেশি আয় করতে পারে।
একইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় সংস্থার সেবা দেওয়ার দক্ষতা আরও বাড়াতে হবে, যাতে মানুষ বেশি সেবা গ্রহণ ও ফি আদায় স্বচ্ছ হয়।
অন্তত ৩০টি মন্ত্রণালয়ের বিভাগ বিভিন্ন সেবা প্রদানের মাধ্যমে কর-বহির্ভূত আয় করে। আগামী অর্থবছরে এসব উৎস থেকে আরও বেশি আয় সংগ্রহের চেষ্টা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো এতে সাড়া দিয়েছে। সড়ক পরিবহন বিভাগ চারটি জাতীয় মহাসড়কে টোল আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এবং এজন্য একটি কমিটিও গঠন করেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ তাদের অধীনস্থ বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও কারা অধিদপ্তরের কাছে কোন কোন সেবার ফি পুনঃনির্ধারণ করা যেতে পারে তা জানতে চেয়েছে। এ বিষয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলার ও যান্ত্রিক নৌযানের নিবন্ধন ফি বাড়ানোসহ বিভিন্ন খাতের সেবামূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যদিকে, বিআরটিএ, বিআইডব্লিউটিসি, বিএসটিআই'র মত সংস্থাগুলোও তাদের কিছু সেবা মূল্য বাড়ানোর বিষয়ে পর্যালোচনা করছে বলে অর্থ বিভাগ সুত্রে জানা গেছে।
স্থানীয় সরকারের কর্তৃপক্ষগুলোও নানান সেবার বদলে নাগরিকদের থেকে কর বহির্ভূত আয় করার গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ২০১৮ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কমপক্ষে বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার অনুসারে সিটি কর্পোরেশনগুলোর জন্য টোল, ফি এবং ভাড়া বাড়ানোর একটি গাইডলাইন তৈরি করেছিল।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, সরকারি সেবা যদি সুষ্ঠুভাবে কোনো ধরনের হয়রানি ছাড়া নাগরিকদের দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে সেবা মূল্য বাড়ানো হলেও নাগরিকরা তা মেনে নেবে।
সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের কর বহির্ভূত রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। সেজন্য রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অনিয়ম দূর করে ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে। একইভাবে জনসাধারণকে হয়রানিমুক্তভাবে সেবা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে, বলছিলেন তিনি।
পাসপোর্ট অফিসে নাগরিকদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার বিষয়টি উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, "অনলাইনে আবেদন করে বাড়িতে বসেই পাসপোর্ট ডেলিভারি পেয়ে গেলে যে কেউ সানন্দে কিছুটা বেশি ফি দিতে রাজি হবে।