অমর একুশের চেতনায় গুরুত্ব দরকার ভাষার বিকাশে
আমাদের বাংলা ভাষা আন্দোলনের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি এখন বিশ্বজোড়া ভাষা দিবস হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৫২ সনের এই দিনকে আমরা স্মরণ করি প্রতিবছর। কিন্তু, বাংলার ভাষা আন্দোলনের আগে ভারতীয় উপমহাদেশে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের আওতায় দাক্ষিণাত্য রাজ্যে। যে রাজ্য এখন কয়েকটি রাজ্যে বিভক্ত।
দাক্ষিণাত্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল তামিলনাড়ু। ১৯৩৭ সনের ভারত শাসন আইনের আওতায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১১টি প্রদেশের মধ্যে আটটি প্রদেশে জয়লাভ করেছিল কংগ্রেস।
তামিলনাড়ু রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেই ঘোষণা করে হিন্দি হবে রাজ্যের প্রধান ভাষা। যা নিয়ে তখন তীব্র প্রতিবাদ ও আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ওই অঞ্চলের ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠী ছিল- তামিল ভাষাভাষী; কিন্তু তারা দাবি তোলে– ইংরেজি হবে রাজ্যের আনুষ্ঠানিক ভাষা। রাজ্যের অন্যান্য ভাষাগুলোকে মাতৃভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিও তুলেছিল। এক বছরের মাথায় রাজ্যের ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ায় কংগ্রেস।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে ব্রিটিশ শাসিত ভারত সেই যুদ্ধে যোগদান করে। কংগ্রেস তখন সেই যুদ্ধে যোগদানকে বিরোধিতা করে। যদিও মুসলিম লীগ যুদ্ধে যোগদানকে সমর্থন করে। কংগ্রেসের বক্তব্য ছিল, বিশ্বযুদ্ধে ইন্ডিয়ার কোন ভূমিকা নেই– তাহলে কেন আমরা এই যুদ্ধে যোগ দেব? প্রতিবাদ হিসেবে কংগ্রেস সবকটি রাজ্য থেকে পদত্যাগ করে, এবং পরবর্তীতে সেখানে গভর্নর শাসন চালু করা হয়। এর ফলে তামিলনাড়ুর ভাষা আন্দোলন স্থিমিত হয়ে যায়। কিন্তু, পরবর্তীতে সেই আন্দোলন আরও ব্যাপক আকারে ফিরে আসে ১৯৬৫ সালের দিকে।
১৯৬৫ সালের তামিলনাড়ুর ভাষা আন্দোলনের আগেই বাংলায় ভাষা আন্দোলন হয় ১৯৫২ সালে। ১৯৬৫ সালে তামিলনাড়ুর ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয় ভারতের উত্তর অঞ্চলের হিন্দি ভাষাভাষী রাজ্যগুলো ছাড়া বাকী সবকটি রাজ্য। পশ্চিমবাংলা, আসাম, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র সর্বত্রই ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। কারণ আম্বেদকারের নেতৃত্বে রচিত ভারতীয় সংবিধানে উল্লেখ ছিল যে, ১৯৬৫ সালের প্রজাতন্ত্র দিবস থেকে ভারতের সবকটি রাজ্যে হিন্দিকে প্রধান ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
কেন্দ্রে তখন কংগ্রেসদলীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। আন্দোলনের তীব্রতার ফলে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়। রেডিও বক্তৃতায় তিনি প্রস্তাব করেন, কেবল হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে না। বিষয়টি পুনরায় বিবেচনা করা হবে।
ভারতের সেই আন্দোলনে বহু মানুষ জীবন দেয়। শোনা যায়, তামিলনাড়ুর স্কুলের ছাত্ররা নিজ দেহে অগ্নিসংযোগ করে আত্মহুতি দিয়েছে ভাষার দাবিতে। লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সেই ঘোষণার মাধ্যমে পরবর্তীকালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ভাষা হিসেবে হিন্দি এবং ইংরেজিকে গ্রহণ করে, এবং সবকটি রাজ্যের নিজস্ব ভাষাগুলোকেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
আমাদের দেশে ১৯৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন হয়, তখনকার পোস্টারে আমরা দেখতে পাই, লেখা আছে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'। এর অর্থ দাঁড়ায়, বাংলাকেই প্রধান ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। যদিও তখন পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষাভাষী ছিল। আর মাত্র সাত শতাংশ মানুষ উর্দু ভাষায় কথা বলতো– যারা প্রধানত ভারত থেকে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছিল। আমরা যখন রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আন্দোলন করেছি, তখন পূর্ব বাংলায় ছোট ছোট জাতি গোষ্ঠীর অবস্থান ছিল। চাকমা, মারমা, লারমা, সাঁওতাল ইত্যাদি অনেক ভাষার মানুষ। আমরা তখন ওই মানুষদের সম্পর্কে কিছু ভেবেছিলাম কিনা– সেটিও একটি প্রশ্ন।
বাংলা ভাষার বিকাশের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি, বাংলা সম্ভবত একমাত্র ভাষা পৃথিবীতে যা শ্রেণি ধারা বিভক্ত করা হয়েছে। সাধু ভাষা আর চলতি ভাষা। উচ্চ শ্রেণির মানুষরা সাধু ভাষা ব্যবহার করতেন। তখন সাহিত্য রচিত হতো দুইভাবে। বঙ্কিমচন্দ্ররা সাহিত্য লিখতেন সাধু ভাষায়, আর প্রমথ চৌধুরীরা চলতি ভাষায় সাহিত্য লেখা শুরু করেন। বাংলা ভাষার ব্যাকরণ সৃষ্টি হয়েছে সাধু ও চলতি ভাষায়– যা পৃথিবীর অন্য কোন ভাষায় নেই।
বাংলা ভাষায় ব্যাকরণে তৎসম শব্দ হিসাবে অন্য ভাষা থেকে সংযোজিত শব্দের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যা বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত শব্দ হিসেবে বাংলায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু, বর্তমানে বাংলা ভাষায় শব্দ সংগ্রহের জন্য আমাদের বাংলা একাডেমি বিভিন্ন শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ তৈরি করছে, যা অনেক ক্ষেত্রে বেশি জটিল ও কঠিন করা হয়েছে। ওই শব্দগুলোকে বাংলা ভাষায় গ্রহণ করলে– কোনো সংকট হতো কিনা তাও ভেবে দেখার বিষয়। পৃথিবীর অন্য সকল ভাষায় এ বিষয়টি এখনো চালু আছে। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে বহু শব্দ সংযোজিত হয়েছে ইংরেজি শব্দ হিসেবে। যেমন এখনকার পন্ডিত শব্দটি অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে ইংরেজি শব্দ হিসাবে গৃহীত হয়েছে। বাংলা ভাষায় অন্য ভাষার শব্দকে গ্রহণ না করার ফলেই– আরো জটিল করে তোলো হয়েছে বাংলা ভাষাকে।
ইংরেজি ভাষাটির উৎপত্তি দশম শতাব্দীতে। প্রথমে এই ভাষা নানা ভাষার সংমিশ্রণে শুরু হয়। জার্মানিক গোত্রগুলোর দ্বারা বর্তমান ইংল্যান্ডে ভাষাটির যাত্রা শুরু হয়। এতে রোমান ভাষার প্রভাব ছিল বহুদিন। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে ইংরেজি ভাষা।
অন্যদিকে, বাংলা আজ জাতীয় ভাষা হিসেবে বাঙালির মাঝে টিকে আছে। কিন্তু, এ ভাষার বিকাশের ধার দুর্বল হয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি পেয়েছে, কিন্তু দুই বাংলায় কেবলমাত্র একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের মধ্যেই বাংলা ভাষা বিকাশের পথ সীমিত হয়ে রয়েছে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।