পালকি চলে হুনহুনা: সিকি শতাব্দী ধরে বিয়েতে পালকি সরবারাহ করেন তিনি
'বাক বাকুম পায়রা, মাথায় দিয়ে টায়রা/ বউ সাজবে কাল কি, চড়বে সোনার পালকি'। শৈশবে এ ছড়াটি আমরা অনেকে পড়েছি বটে, বাস্তবে কজনই বা দেখেছি বিয়ের পালকি? অথচ একটা সময় ছিল যখন বঙ্গদেশে পালকি ছাড়া বিয়ে কল্পনাই করা যেত না। আজ এই আধুনিক যুগে এসে সুদূরে হারিয়ে গেছে সে ঐতিহ্য! এ প্রজন্মের অনেকেরই তাই দেখা হয়নি বিয়ের পালকি।
তবে কেউ কেউ এমন থাকেন, যারা অল্প সময়ের জন্য হলেও অতীতের সেসব সোনালি দিনে ফিরতে চান, আধুনিক কালের বিয়েতেও ফিরিয়ে আনতে চান পুরনো সব ঐতিহ্য। তাদের জন্যই হয়তো কোথাও কোথাও গুটিকতক পালকিওয়ালার দেখা মেলে আজও। এই যেমন কেরানীগঞ্জের মাহিদুল ইসলাম। নব্বইয়ের দশকে শুরু করে পালকির ব্যবসা করছেন আজ ২৫ বছর! প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো দিন দিন যতই আধুনিক হচ্ছে, চিরায়ত ঐতিহ্যের প্রতি মানুষের আগ্রহও বাড়ছে। আর তাই পালকির কদরও বাড়ছে ধীরে ধীরে। পৌষের এক সকালে নিজের পালকি রাখার ঘরে বসে পালকিওয়ালা মাহিদুল ইসলাম শোনালেন তার জীবনের গল্প, সাথে পালকির ব্যবসার যাবতীয় হালচাল।
পালকির সাথে ২৫ বছর
মাহিদুল ইসলামের জন্ম বরিশালে। তবে গ্রামে বাস করা হয়নি তার। শৈশবেই বাবা সপরিবারে চলে এসেছিলেন ঢাকায়। এখানেই একটু বড় হয়ে মাহিদুল কাজ শুরু করেন বিভিন্ন পেশায়। একসময় যে তিনি পালকির ব্যবসায় জড়িয়ে পড়বেন, তখনও জানতেন না। এক বড় ভাইয়ের দেখাদেখি অনেকটা শখের বশেই একবার সিদ্ধান্ত নিলেন পালকি বানাবেন। যেই ভাবা, সেই কাজ, বানালেন দুটি পালকি।
কাঠের তৈরি সে দুটি পালকিই পাল্টে দিল মাহিদুলের জীবন। সেই থেকে শুরু করে আজ ২৫-২৬ বছর পর তিনি এক সফল পালকি ব্যবসায়ী। যেকোনো অনুষ্ঠানে ডাক পড়লেই হাজির হন পালকি নিয়ে, নতুন বর কিংবা বউকে চড়িয়ে নিয়ে যান গন্তব্যে।
শুরুটা অবশ্য এমন ছিল না। দুটি পালকি বানিয়েছিলেন বটে, তবে জানতেন না ব্যবসা চলবে কি না। এটা যে সময়ের ঘটনা, পালকির সোনালি দিন তখন অতীত এবং আজকের মত ঐতিহ্যগত কদরও বাড়েনি। ফলে খুব বেশি আয় হলো না শুরুতে। কিন্তু বিয়েতে পালকি দেখে অন্যরা যে আনন্দ পায়, সে আনন্দ পেয়ে বসল তাকেও।
প্রাচীন এ ঐতিহ্যবাহী পেশা মাহিদুল ছাড়লেন না। আস্তে আস্তে প্রচারণা বাড়ল। একসময় তিনি হয়ে উঠলেন ঢাকা শহরের নামকরা বেহারা। তার নামডাক আজ দেশজোড়া। শহরের যেকোনো বিয়ের সামগ্রী কিংবা ফুল বিক্রির দোকানে চোখে পড়ে মাহিদুলের 'কোহিনুর পালকি'র বিজ্ঞাপন। এখন শুধু পালকি নয়, বিয়ের আমোদ-প্রমোদের অন্য অনেক কিছুই সরবারহ করেন তিনি।
কেরানীগঞ্জের মনুবেপারির ঢাল এলাকায় মাহিদুলের বাড়ি। নিজের পালকি রাখার ঘরটিতে বসে পালকির সাথে দীর্ঘদিনের কাহিনি শোনালেন তিনি। বললেন, 'প্রত্থমে দুইটা বানাইছিলাম, দেহি দি চলেনি। পরে আস্তে আস্তে এহন ২০টার মত পালকি আছে। বউ পালকি, ময়ূর পালকি, চেয়ার পালকি, ডিম পালকিসহ আরও অনেক পালকি বিয়েতে দেই।'
ঢাকার নামি-দামি সব কমিউনিটি সেন্টারের বিয়েগুলোতে এখন নিয়মিতই ডাক পড়ে মাহিদুল ও তার পালকির। কখনও আবার ছুটে যেতে হয় ঢাকার বাইরে। বর ও কনেকে চড়িয়ে কখনো হাঁটতে হয় কিছু পথ, মাঝেমধ্যে দাঁড়াতে হয় ছবি তোলার ভঙ্গিতে। নববধূকে গাড়িতে চড়িয়ে দিয়ে সমাপ্ত হয় তাদের কাজ। এভাবেই আনন্দের সাথে নিজের কাজ উপভোগ করে চলেছেন মাহিদুল ইসলাম।
শীতকাল তাদের মৌসুম
শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশে শীতকালকে ধরা হয় বিয়ের মৌসুম। তাই সে সময়েই ব্যস্ততা বাড়ে মাহিদুলদের। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি তাদের সর্বাধিক কাজের মাস। এ সময়ে যেমন চাহিদা বেশি থাকে, আয়ও বাড়ে সমান গতিতে। বর্ষা মৌসুম প্রায় বসে কাটাতে হয় বলে সারা বছরের জীবিকার বেশিরভাগই সংগ্রহ করতে হয় এ সময়।
কেরানীগঞ্জ ও পুরান ঢাকার বিয়েগুলোতে একটি পালকি ও চারজন বেহারার জন্য মাহিদুলকে পারিশ্রমিক দিতে হয় তিন হাজার টাকা। ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীতে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা নিয়ে থাকেন তারা। ভালো পারিশ্রমিকের প্রতিশ্রুতি পেলে ঢাকার বাইরেও যান মাহিদুল। সেক্ষেত্রে পালকি ও তার লোকেদের যাতায়াত খরচ বহন করতে হয় বিয়েবাড়ির লোকেদের।
মাহিদুলের বউ পালকিগুলো মূলত চার বেহারার। মাহিদুল ছাড়াও অনেকেই বেহারা হিসেবে তার সাথে কাজ করেন। এই ব্যবসার কারণে নিজের পাশাপাশি অন্যদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে বলে জানালেন মাহিদুল।
তিনি বললেন, 'আমার বেহারার অভাব নাই৷ ফোন দিলেই চলে আসে। লোক বুইঝা ওদের কাজ দেই। যে অনুষ্ঠানে বেশি লোক লাগে, সেইখানে বেশি লইয়া যাই৷ মানে আমার কারণে ওরাও কাজ পাইয়া যায়। কাজ কইরা ওরা মজাও পায়। একটা কাজ শেষ করলে পরের কাজের জন্য পাগল হইয়া যায়।'
সব কাজের কাজি
মাহিদুলের সংগ্রহে পালকির সংখ্যা এখন প্রায় ২০টি। নিজেই এক এক করে বানিয়েছেন ওগুলো। পালকির জন্য দরকার হয় হালকা অথচ শক্ত কাঠামো। স্টিলের দোকান থেকে সেই কাঠামো বানিয়ে এনে কাঠ ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে নকশা করেছেন তিনি। তাতে কোনো কোনো পালকির পেছনে লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানালেন।
বিয়েতে শুধু পালকিই সরবারহ করেন না মাহিদুল। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বিয়ে শেষ হওয়া পর্যন্ত যাবতীয় আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা তিনি করে থাকেন। আর সেজন্য গড়ে তুলেছেন 'কোহিনূর পালকি ও সাজঘর'। গায়ে হলুদের জন্য ময়ূর ও চেয়ার পালকি, বউকে বয়ে নেয়ার জন্য বউ পালকি রয়েছে তার। এছাড়া প্রাচীনকালের বিয়েতে ব্যবহৃত নানা সরঞ্জামও তিনি সরবরাহ করে থাকেন।
শখ করে যারা প্রাচীন রাজ-রাজড়াদের মতো বিয়ে করতে চান, তাদের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা আছে মাহিদুলের কাছে। বরের জন্য সুসজ্জিত ঘোড়া কিংবা হাতি, বরের হাতের তলোয়ার, মাথার রাজকীয় মুকুট, কী নেই! প্রয়োজন হলে তিনি ব্যবস্থা করে দিতে পারেন সানাই বাদক, ব্যান্ড পার্টি কিংবা অন্য যেকোনো ক্রীড়াকৌতুকের সরঞ্জাম। দুইজন সানাইবাদককে সম্মানী দিতে হয় দশ হাজার টাকা। অন্যদিকে ৫ জনের একটি ব্যান্ড পার্টি নিতেও খরচ সমপরিমাণ।
আজকাল শুধু বিয়ের অনুষ্ঠান নয়, সুন্নতে খৎনা কিংবা বিভিন্ন মাজারের বার্ষিক ওরশ শরীফেও পালকি ডাকা হয়। জন্মদিনের অনুষ্ঠানের জন্য টেডি পোশাকও ভাড়া দেন মাহিদুল। তাদের রয়েছে মিকি মাউস, মোটু-পাতলু, বাঘ, বেড়ালের মাস্কটক বা টেডি পোশাক। এগুলোর জন্য হাজার টাকা খরচ করতে হয় খদ্দেরদের। তবে পালকি ও নানা ধরনের আমোদ-প্রমোদের সরঞ্জামের সেট মাত্র দশ হাজার টাকায় দেন তারা।
অনুষ্ঠানগুলোতে ফুচকা, ঝালমুড়ি, চটপটির মতো মুখরোচক খাবারের দোকানের ব্যবস্থা মাহিদুল করতে পারেন। করে দিতে পারেন নাগরদোলার মতো আনন্দ-আয়োজনের। এগুলো বাইরে থেকে আনতে হয় বলে ভাড়াও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এছাড়া তার রয়েছে বায়স্কোপের মতো ঐতিহ্যবাহী সংগ্রহ, যার ভাড়া দিনপ্রতি আট হাজার টাকা। এতসব আয়োজন নিজে করতে পারেন বলে মাহিদুল নিজেই যেন একটা প্যাকেজ!
পালকি এখনও বিত্তশালীদের
প্রাচীনকালে পালকিকে মনে করা হতো দেবতার বাহন। পরে একসময় সমাজের বিত্তশালীরা তাদের নিত্যদিনের যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করতেন এটি। প্রযুক্তির উন্নয়নে সবকিছু পাল্টে একসময় পালকি হয়ে ওঠে জনসাধারণের বাহন, বিয়ের অংশ। কিন্তু সে রীতিও হারিয়ে যায় কালে কালে। এই আধুনিক যুগে এসে পালকি আবার হয়ে উঠেছে বিত্তশালীদের বাহন।
আজকের বাজার হিসেবে পালকি ভাড়া খুব বেশি না হলেও, সমাজের সচ্ছল ব্যক্তিরাই মূলত বিয়েতে পালকির আয়োজন করে থাকেন, জানালেন মাহিদুল। আর তাই শহরের কমিউনিটি সেন্টারগুলোতেই বেশি দেখা মেলে তাদের। বললেন, 'ঢাকার মধ্যে অফিসার ক্লাব, লেডিস ক্লাব, হোটেল শেরাটন, বড় বড় সেন্টারে কাজ করি। পুরান টাউনে খোকা কমিউনিটি সেন্টার, লালবাগ পুরান ঢাকার সব কমিউনিটি সেন্টারেই আমাদের পাবেন।'
শুধু ঢাকায় নয়, মাঝেমধ্যে যেতে হয় ঢাকার বাইরেও। তবে সেক্ষেত্রেও শৌখিন আর বিত্তশালীরাই তাদের খদ্দের। 'পালকি লইয়া বরিশাল গেছি। তারপরে ভৈরব গেছি, কিশোরগঞ্জ গেছি, কয়দিন আগে গোপালগঞ্জ গেলাম, ফরিদপুর গেলাম। নরসিংদীও গেছি। ঢাকার বাইরে নিলে খরচ বেশি, সবাই তো নিতে পারে না,' বললেন মাহিদুল।
পালকি চলে হুনহুনা
আজকের দিনের পালকির ব্যবসা আগের তুলনায় অনেকটাই সহজ। আগের মতো আর পালকি নিয়ে মাইলের পর মাইল ছুটতে হয় না বেহারাদের, করতে হয় না হাড়ভাঙা পরিশ্রম। তবে একটি কাজ তাদের করতেই হয়—তা হলো, বিনোদনের ব্যবস্থা।
একসময় দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হতো বেহারাদের। শারীরিক পরিশ্রম ভুলতে তাই নানা ধরনের গান আর বোল আওড়ে সময় কাটত তাদের। এখন অবশ্য দূরত্ব বলতে বিয়ের মণ্ডপ থেকে গাড়ি, তবুও নানা রঙ্গ-রসিকতার বোল শোনা যায় মাহিদুল ও তার বেহারাদের মুখে। আগত অতিথিদের আনন্দ দিতেই এসব করেন বলে জানালেন তিনি।
'পালকি কান্ধে নিয়াই গান-টান গাই আমরা। আনন্দ না দিলে তো চলে না। আমরা আনন্দ দেই, মানুষও হ্যাভি খুশি হয়। সব লোক চইলা আসে। গ্রামের মানুষ চইলা আসে। সবাই খুশি হয় আগেকার জিনিস দেইখা। ছবি তোলে, ভিডিও তোলে,' বললেন মাহিদুল।
ব্যবসা ভালো, আরো ভালোর চিন্তা
পালকির দীর্ঘকালের ইতিহাস সম্পর্কে ভালোই অবগত মাহিদুল ইসলাম। তিনি জানেন, একসময় হারিয়েই গিয়েছিল পালকির ব্যবহার। তবে নতুন করে পালকির ঐতিহ্যগত কদর বাড়ায় এখন বেশ আনন্দেই ব্যবসা করছেন তিনি। বললেন, 'আগে অনেক বছর পালকি চলে নাই। এখন কিন্তু মানুষ সব অনুষ্ঠানেই পালকি নেয়। আমাদের এই ইয়াটা (ব্যবসা) হ্যাভি সুন্দর এখন। মানে কী, কম টাকার মধ্যে বিয়েটা সুন্দর হইয়া যায়। জাঁকজমক হয় আরকি।'
কেরানীগঞ্জ অঞ্চলে একসময় তিনি একাই করতেন এ ব্যবসা। এখন অবশ্য আরও কয়েকজন রয়েছেন যারা পালকি সরবারাহ করেন। তবে মাহিদুল ইসলামের মতো এত সংগ্রহ অনেকেরই নেই। বললেন, 'আমার একসময়ের কর্মচারী, যারা আমার লগে কাজ করছে, ওরা ছুইটা যাইয়া একটা-দুইটা বানাইছে। ওরাও ব্যবসা করতাছে। অতি ফাস্টে আমিই আছিলাম। এখন দেহি কোন পর্যন্ত যাইতে পারি। পালকি নিয়াই আছি, পালকি নিয়াই থাকতে চাই।'
ব্যবসার ভবিষ্যত নিয়েও আশাবাদী মাহিদুল। করোনার পর যে ভাটা পড়েছিল তা অচিরেই কাটিয়ে উঠবেন বলেও মত তার। 'আগের থেকে ব্যবসা অনেক ভালো চলতাছে। করোনার আগে আছিলো সবচেয়ে ভালো। মাসে নয়টা-দশটা পালকি ভাড়া গেছে। আবার সেই দিন শুরু হইতাছে,' জানালেন মাহিদুল। বললেন, আধুনিক কালে পালকি হারিয়ে গিয়ে আবার যখন আগ্রহ বাড়ছে মানুষের, তখন আমৃত্যু এ পেশা ধরে রাখতে চান তিনি।