ভিসা স্থগিতের ফলে ইসরায়েল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন মানবাধিকার কর্মীরা
ইসরায়েলের দখল করা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে কর্মরত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মানবাধিকার কর্মীদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। এর ফলে গাজায় খাদ্যসহ বিভিন্ন জরুরি পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।
এই কারণে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রধানসহ অনেক কর্মীকে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড ছাড়তে হয়েছে অথবা নির্বাসনের ঝুঁকি নিয়েই মানবিক সহায়তা চালিয়ে যেতে হচ্ছে।
গাজার পশ্চিম তীরবর্তী অঞ্চলে মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিজের সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর ফারিস আরৌরি জানিয়েছেন, গাজার বর্তমান প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জরুরি সহায়তা প্রধানকারী দলগুলোর উপর এর প্রভাব বেশী পড়েছে।
অপ্রত্যাশিত সংকট মোকাবেলা করার জন্য আঞ্চলিক সদর দপ্তর থেকে সংক্ষিপ্ত নোটিশে তাদের মোতায়েন করা হলেও ভিসা স্থগিত রাখার জন্য সহায়তা প্রদানকারী দলগুলো জেরুজালেমে কোন বিশেষজ্ঞ আনতে সক্ষম হয়নি। জেরুজালেম থেকেই গাজাতে অধিকাংশ মানবিক সহায়তামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়।
ইসরায়েল এবং দখলকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চলে প্রবেশ করার জন্য ভিসার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ইসরায়েলের মিনিস্ট্রি অব ওয়েলফেয়ার এন্ড স্যোশাল এফেয়ারস নতুন করে ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। অতীতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে থেকে সুপারিশ পত্র নিয়ে ভিসা নেওয়া গেলেও ৭ অক্টোবরে হামাস ইসরাইলে হামলা চালানোর পর থেকে সেটি বন্ধ আছে।
সেই সময়ে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছিল, জরুরি পরিস্থিতির কারণে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে এবং সব ধরনের মানবিক সেবা প্রদানকারীদের ভিসার মেয়াদ ২০২৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। কিন্তু মেয়াদ শেষ হয়ে আসার পর মন্ত্রণালয় সুপারিশ পত্র দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে এবং জানিয়েছে, ভিসা কার্যক্রমের বিষয়টি নিয়ে 'বিভিন্ন সরকারি কর্তৃপক্ষ' আলোচনা করছে।
ফারিস আরৌরি বলেছেন, "গাজায় প্রবেশের চেষ্টা করার বদলে আমাদের এখন শুধু জেরুজালেমেই প্রবেশ করার চেষ্টা চালাতে হচ্ছে।" তিনি আরো জানিয়েছেন, ভিসা স্থগিত করা একটি নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত।
তিনি আরো বলেন, "সবসময়েই এই নিয়ে জটিলতা ছিল, বিশেষ করে ২০০০ সাল থেকে শুরু করে ২০০৫ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় (ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদ বোঝাতে এই আরবি শব্দটি ব্যবহার করা হয় যেটিকে বাংলায় 'অভ্যুত্থান' বলা যায়) ভিসা জটিলতা বেশী ছিল। বিভিন্ন সময়ে সীমাবদ্ধতার জন্য এই অঞ্চলে প্রবেশ করা কঠিন কাজ ছিল। কিন্তু এত বড় পরিসরে নিষেধাজ্ঞা আগে কখনো দেওয়া হয়নি।"
পশ্চিম তীর থেকে ফিলিস্তিনি মানবাধিকার কর্মীদের জেরুজালেম বা গাজায় প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে বিদেশি মানবাধিকার কর্মীদের ভিসা স্থগিত হওয়ার বিষয়টি আরো জটিলতা সৃষ্টি করেছে। ফিলিস্তিনের এই রকম মানবিক সংকটের সময় ভিসা জটিলতার জন্য মানবিক সহায়তা প্রদানকারী দলগুলো পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং মৌলিক চিকিৎসার তীব্র ঘাটতি দূর করতে গাজায় চলমান সহায়তা যথেষ্ট নয় এবং চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শিশুরা অপুষ্টিতে মারা যেতে শুরু করেছে।
আরৌরি বলেন, "আমাদের ১৫ জন কান্ট্রি ডিরেক্টর আছেন যারা ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য চলে গেছেন অথবা চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি জানিয়েছেন, কর্মীরা বিচ্ছিন্নভাবে কাজ চালিয়ে গেলেও প্রধান কর্মকর্তাদের চলে যাওয়ার কারণে চলমান মানবিক সহায়তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, "তাদেরকে গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া সহ সরাসরি মাঠে কাজ করাতে হবে।"
আরৌরি জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (এআইডিএ) অংশ এই রকম ৩৫ টি সংস্থার উপর চালানো একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৫০টির বেশী চাকরি এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৫৭ জন কর্মীর ভিসা ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছে, ৪০ জনের বেশী কর্মীর ভিসার মেয়াদ কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে এবং ৫০ জনের বেশী মানবাধিকার কর্মীকে গাজায় মানবিক সহায়তা প্রদানের কাজে যুক্ত করা যাচ্ছে না।
ইসরায়েল পুনরায় ভিসা দেওয়া শুরু না করলে সব মানবাধিকার কর্মীকে দ্রুত এই অঞ্চল ত্যাগ করতে হবে কারণ তাদেরকে ২০২৩ সালে দেওয়া ভিসার মেয়াদ শরতের শুরুতে শেষ হয়ে যাবে।
যুক্তরাজ্যের ছায়া পররাষ্ট্র সচিব ডেভিড ল্যামি মঙ্গলবার পার্লামেন্টে বিষয়টি উত্থাপন করেছেন এবং যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি এই নিয়ে ইসরায়েলকে চাপ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, "মানবাধিকার কর্মীদের ভিসা পুনরায় নবায়ন করতে হবে। কোন ধরনের ভিসা নবায়ন না করার ফলে এই মানবিক সংকটের সময় মানবাধিকার কর্মীরা ফিলিস্তিন থেকে নির্বাসিত হচ্ছেন।"
ভিসা জটিলতার প্রভাব জাতিসংঘের মানবাধিকার কর্মীদের উপরও পড়েছে কারণ অনেকেই শুধু অল্প সময়ের জন্য ইসরায়েল এবং গাজায় প্রবেশের অনুমতি পাচ্ছে।
প্রায় এক মাস ধরে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য নিয়োজিত জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্মবিষয়ক সংস্থাকে (ইউএনআরডব্লিউএ) গাজার উত্তরাংশে ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না এবং সংস্থাটি জানিয়েছে, এই অঞ্চলে সহায়তা প্রদান করা আর সম্ভব নয়।
একজন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মী জানিয়েছেন, ভিসা জটিলতার জন্য জরুরি পণ্য সরবরাহ যেমন গাজার সমুদ্র উপকূলে বিমান থেকে খাদ্য সরবরাহ ফেলার কাজ এই সপ্তাহে ব্যাহত হয়েছে।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্রকে চলমান ভিসা জটিলতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানিয়েছেন, "সরকারি কর্মকর্তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।"
ইসরায়েলের ইন্টেরিয়র মিনিস্ট্রি এবং ওয়েলফেয়ার মিনিস্ট্রি এই বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়