একুশে আগস্ট: যে দিন পাল্টে যায় বাংলাদেশের রাজনীতি
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের কালো রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের কৃষ্ণতম অধ্যায় মঞ্চস্থ হয়েছে এ দিন।
দিনটি ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। গ্রেনেড হামলার সেই দিন।
যারা এ হামলার বীভৎসতা দেখেছেন তারা একে নৃশংসতম বলতেও ইতস্তত করবেন। কারণ এটি যে ছিল আরও নিকৃষ্ট— আরও বেশি কিছু।
দেশের রাজনীতিতে যে কটি পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে নানা সময়ে, তার মধ্যে ছকের দিক থেকে এটি সবচেয়ে কুৎসিত। দেশের প্রধান ও জনপ্রিয় একটি রাজনৈতিক দলের ওপর চালানো এ হামলার নেপথ্য কুশীলব ছিল রাষ্ট্র স্বয়ং! নিখাদ জ্বাজল্যমান হিংস্রতার এ যেন এক জ্বলন্ত ছোবল।
সুপরিকল্পিত অথচ চরম নিন্দনীয় এক সহিংসতার চরম রূপ এটি। যার পেছনে কাজ করেছে নৃশংসতা, ফ্যাসিবাদী মনোভাব ও বিরোধীকে সমূলে উৎপাটনের ঘৃণ্য মতবাদ। যে ঘটনার তুলনা হতে পারে কেবল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজিদের দ্বারা সংঘটিত বর্বরতারই।
সেদিন আওয়ামী লীগের সমাবেশে একের পর এক গ্রেনেড হামলায় কেবল চব্বিশটি প্রাণ ঝরে যায়নি, আহত হয়েছেন শত শত। সে সঙ্গে ঘটনাটি এদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রেও এমন একটা ছাপ রেখে গেল কখনও প্রত্যাশিত ছিল না। বিএনপির নেতৃত্বাধীন তদানীন্তন চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে গুজরে ওঠা এক ষড়যন্ত্রের ঝড়েরই ঘৃণ্য প্রকাশ দেখা গেল এই গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে।
একুশে আগস্টের হামলা কি ইতিহাসের কোনো এক বিচ্যুতির স্বাক্ষর? মোটেই তা নয়। দেশকে সহিংসতার পথে নিয়ে যাবার জন্য বদলে ফেলার সেই পুরনো চক্রান্তেরই অংশ এটি।
১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে প্রয়াত এইচ এম এরশাদের স্বৈরশাসন একটি গণতান্ত্রিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে শেষ হবার পর, ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন তদানীন্তন বিএনপির এমনতর ঘৃণ্য কাজ করতে পারে বলে মনে হয়নি। অনেকের মতে, তখন দলটি ছিল মধ্য ডানপন্থী। সেই মেয়াদে দলটি বাজেটে দাতাদের অনুদান চেয়ে বেড়ানো ছাড়া আর কিছু করেনি।
তখন মাঝে মাঝেই আওয়ামী লীগের মিছিলে-সমাবেশে পুলিশের লাঠিচার্জের ঘটনা ঘটত। এমন একটি ঘটনায় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা মতিয়া চৌধুরীর ওপর আক্রমণ করেছিল পুলিশ। তাতেও বোঝা যায়নি যে, বছর কয়েকের ব্যবধানে দলটি এক রক্তখেকো দানবে পরিণত হবে।
কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে দলটির আবার বিজয়ের পর তাদের ছায়াতলে বেড়ে উঠল একটি দৈত্য। যার নাম হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী বাংলাদেশ (সংক্ষেপে, হুজি)— সহিংস চরমপন্থী একটি গ্রুপ। ১৯৯২ সালে ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ ঘটল দলটির। যে ঘটনায় বিএনপি সরকার বিস্ময়করভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
তাতে যে কারও পক্ষে এটা অনুমান করাই স্বাভাবিক যে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এমন একটি গ্রুপ এত নির্বিঘ্নে নিজেদের উপস্থিতির কথা জানান দিতে পারত না।
বিএনপির প্রথম জমানায় এমন ধারায় চরমপন্থী তোষণ ও পোষণের ফলেই, ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও, দেশে একটির পর একটি বোমা হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে।
যশোরে বাম ঘরানার সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচির সম্মেলনে হামলার ঘটনা ঘটে ১৯৯৯ সালে। যে ঘটনায় মারা যান ১০ জন। আহত হন আরও অসংখ্য। ২০০০ সালে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় তখনকার ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলে বোমা পুঁতে রাখা হয়। সে সময় ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) ঘটনার তদন্ত করে হরকাতুল জিহাদকে এজন্য দায়ী করেছিল।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশে এলেন ২০০০ সালেরই মার্চে। এটাই প্রথম ও একমাত্র কোনো মার্কিন রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফর। সে সময় তাঁর মানিকগঞ্জ সফরের কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছিল হরকাতুলের হুমকির মুখে। এর পরই হরকাতুল বাংলাদেশের প্রধান মুফতি হান্নানের ভয়ংকর নামটি উঠে আসে পাদপ্রদীপের আলোয়।
আওয়ামী লীগের শাসনামলের শেষদিকে, ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে ছায়ানটের শিল্পীদের সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ বরণের ঐতিহ্যবাহী আয়োজন শুরু হতেই সেখানে ঘৃণ্য বোমা হামলা হয়। আবারও রক্ত ঝরল। আর চরমপন্থীরা এর মাধ্যমে প্রমাণ করে দিল যে, তাদের কাছে যা কিছু 'ইসলামবিরোধী' সেসবই তারা সমূলে তুলে ফেলবে।
২০০১ সালে বিএনপি দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এলে, সব কিছু হঠাৎ বদলে গেল। সেটা ঘটল দলের ওপর দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের নিরংকুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর।
এখন এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, তারেক চেয়েছিলেন ফ্যাসিস্ট কায়দায় দল পরিচালনা করতে। সে সঙ্গে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের বিনাশ ঘটাতে তিনি ইসলামি উগ্রপন্থীদের পেছনে অর্থের জোগান দিতে লাগলেন।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তখন দেশের ভেতরে অস্ত্রের প্রবাহ চলছিল অবাধে। একটি দুটি নয়, অসংখ্য একসঙ্গে—ট্রাকভর্তি-- এবং এমন ঘটনা ঘটল বারবার— বিপজ্জনকভাবে। অস্ত্রের জোগানদাতাদের এসব মহড়ায় মিডিয়া ছাড়া আর কারও যেন মাথাব্যথা ছিল না।
নানা নামের নানা কিসিমের ইসলামপন্থী দল দেশজুড়ে ডালপালা মেলতে লাগল। আল-বাইয়্যিনাত, হরকাতুল জিহাদ, জামিয়াতুল মুজাহিদিন, শাহাদাত-ই-আল-হিকমা, হিজবুত তাওহিদ— আরও কত কী!
কিন্তু সরকারের তরফে এদের উপস্থিতির কথা নিয়মিতভাবেই অস্বীকার করা হয়েছে। কেবল শাহাদাত-ই-আল-হিকমাকে পরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
ইতোমধ্যে, জঙ্গি দলগুলো আরও শক্তি সঞ্চয় করে ফেলেছে। আর দেশ ডুবে গেল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ঘটে যাওয়া একের পর এক বোমা-সন্ত্রাসের পঙ্কিল জলে।
একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার মাত্র মাস চারেক আগে চট্টগ্রাম বন্দরে দুর্ঘটনাবশত আটক হল দশ ট্রাকভর্তি অস্ত্র। পরের নানা তদন্তে ধরা পড়ল কীভাবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের বড় বড় কর্মকর্তারা এসব অস্ত্র পাচারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাদেরই একজন ছিলেন স্বয়ং তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, লুৎফুজ্জামান বাবর।
আর গ্রেনেড হামলার ঘটনার মাস তিনেক আগে হুজির কিছু সদস্য সিলেটে হজরত শাহজালালের মাজারে তখনকার ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর বোমা হামলার চেষ্টা চালায়। অল্পের জন্য বেঁচে যান আনোয়ার চৌধুরী।
হুজি এ ঘটনার মাধ্যমে তাদের নীরবতা ভাঙে।
তারপরেই এল একুশে আগস্ট। ২০০৪ সালের এ কালো দিন।
ঘটনায় মারা গেলেন চব্বিশ জন। তাদের অনেকে ঘটনাস্থলে, যাদের মৃত্যু এত সহজ ছিল না। বাংলাদেশ মহিলা লীগের প্রেসিডেন্ট, প্রয়াত আইভি রহমানের দুটি পা হাঁটু থেকে উড়ে গেলে তিনি রক্তের বন্যায় স্থবির হয়ে পড়েছিলেন দীর্ঘক্ষণ। তিন দিন বাদে, ২৪ আগস্ট করুণ মৃত্যু হল তাঁর।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তখনকার বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন মুল টার্গেট। অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর কানের বেশ ক্ষতি হয়েছিল এ ঘটনায়।
সেদিনের ঘটনায় বেঁচে যাওয়া শত শত দলীয় কর্মী এখনও রোজকার জীবন যাপন করেন শরীরে গ্রেনেড হামলার ক্ষত আর স্প্লিন্টারের শত শত টুকরো গেঁথে থাকার বেদনা নিয়ে।
এখন তো আমরা জানি কারা এসব ঘটিয়েছিল। তখনকার বিএনপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সরকার ও ইন্টেলিজেন্স বিভাগের বেশ কজন হোমড়া-চোমড়া।
কিন্তু ঘৃণ্য এই আক্রমণের ঘটনা অন্য খাতে চালিয়ে দিতে সরকার যা যা করেছিল তাতে প্রমাণ হয় তাদের রাজনৈতিক আদর্শ কতটা ভয়ানক।
অদ্ভুত ফ্যাসিবাদী কায়দায় সরকার আওয়ামী লীগের ঘাড়েই চাপাল ঘটনার দায়। ধ্বংস করে দিল যাবতীয় প্রমাণাদি। জজ মিয়ার মতো এক ছিঁচকে সন্ত্রাসীকে ঘটনার নায়ক বানিয়ে সামনে তুলে আনা হল। বলা হল, সেদিন সমাবেশে গ্রেনেড ছুঁড়েছে এই জজ মিয়াই!
জনগণকে ধোঁকা দিতে এক বিচারপতিকে নিয়ে এক-ব্যক্তিক তদন্ত কমিশন গঠন করা হল। যিনি তদন্ত শেষে বললেন যে, ঘটনাটির পেছনে ভিন্ন একটি দেশ জড়িত।
অবেশেষে, ক্ষমতার পালাবদলের ফলে নতুন তদন্তের মাধ্যমে জানা গেল, পুরো ঘটনা নিখুঁতভাবে সাজানো হয়েছে হাওয়া ভবন থেকে-- তারেক রহমান ও তার সঙ্গীদের দ্বারা।
হামলার মূল হোতারা ঘটনাটির কোড নেম দিয়েছিলেন এভাবে— "শেখ হাসিনাকে হালকা নাশতা করানো হবে।"
পুরো ঘটনাটি আমাদের জাতীয় রাজনীতির দেয়ালে একটা গভীর ফোকর তৈরি করল— সম্ভবত চিরতরেই। এ ঘটনা যেন দেখিয়ে দিল, গণতন্ত্র, নির্বাচন বা জনগণের রায় পাবার জন্য রাজনীতি নয়; রাজনীতি করতে হয় বিপক্ষ দলের রক্ত ঝরাতে, তাদের টুঁটি টিপে ধরতে— বিপজ্জনকভাবে। শত্রু সম্পর্কে নতুন ধারণা ও ব্যাখ্যা যেন তৈরি হল এভাবে।
জঙ্গিদের সাহস দিতে, মদদ দিতে এরকম একগাদা প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল যা এখন চিহ্নিত করা যাচ্ছে।
এই যেমন আরেক জঙ্গি গ্রুপ জামিয়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) প্রতিষ্ঠার বিষয়টি। দলটির ভয়ানক হিংস্র নেতার নাম ছিল বাংলা ভাই। দলটি প্রকাশ্যে ইসলামি বিপ্লবের কথা বলত। আর যাদেরকে তাদের কাছে ইসলামের শত্রু বলে মনে হত তাদের নিধন করত। ক্ষমতা দেখাতে ওরা প্রকাশ্যে প্রদর্শনী করলেও বিএনপি নেতারা ও তদানীন্তন প্রশাসন তাদের সমর্থন দিয়ে গেছেন।
এমনকি জেএমবি নিয়ে মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরগুলো বানানো গল্প বলে উড়িয়ে দেওয়া হত। বাংলা ভাইয়ের অস্তিত্বই মেনে নেওয়া হয়নি। যদিও মিডিয়াতে বাংলা ভাইয়ের সাক্ষাৎকার প্রকাশ হয়েছিল। নিজের অফিস কক্ষে বসে বাংলা ভাই সেসব সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন যাতে তার পেছনে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছিল তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছবি টানানো।
সৌভাগ্যবশত, আওয়ামী লীগকে নির্মূল করতে চাইলেও ঘটনার আকস্মিকতা সামলে উঠে দলটি খুব দ্রুত তাদের সমস্ত শক্তি ও সংহতি ফিরে পায়।
সেদিনের ঘটনাক্রমে চোখ বুলিয়ে দেখা যাবে, বিএনপি নামের দলটি, তাদের বর্তমান নেতৃত্বসহ, এককভাবে দায়ী এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্য। তারা ব্যর্থ হয়েছিল ঘটনাটি ঠেকানোর ক্ষেত্রে-- সেটির নিন্দা জানানোর ক্ষেত্রে-- নৃশংস এই অপরাধের আগে-পরের ঘটনাবলীর নিয়ন্ত্রণে।
নিজেদের এই ঘৃণ্য অতীত থেকে দলটির বেরিয়ে আসা উচিত ছিল। তা তারা পারেনি।
আর এজন্যই, আজও আমরা সেদিনের ঘটনার বেদনা বয়ে বেড়াই। একুশে আগস্টের আগে বিএনপি আর আওয়ামী লীগের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যে নির্বাচনী লড়াই হত, সেখান থেকে দু' দলের সম্পর্কটি রূপান্তরিত হয়েছে অস্তিত্ববাদী লড়াইতে। এরপর থেকে ঘটে যাওয়া যাবতীয় রাজনৈতিক ঝড়ে সেদিনের সে ঘটনার বর্বরতার শিকড় খুঁজে পাওয়া যায়।
তা সে ২০০৭ সালের নির্বাচন বানচাল হোক কী পরের দু'বছর ধরে চলা সামরিক শাসনেই হোক। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুতে ২০১৩ সালের সহিংসতা, ২০১৪ সালে বিএনপির নির্বাচন বর্জন আর তার পরের বছরে চার মাসের অবরোধের সময় চলা পেট্রোল বোমা হামলা— সব রকম বর্বরতার মূলেই আসলে প্রোথিত রয়েছে কোনো এক একুশে আগস্টের ঘৃণ্যতা।