এস আলমের পোড়া চিনি কর্ণফুলী নদীতে, মরে ভেসে উঠছে মাছ
চট্টগ্রামের এস আলম সুগার মিলের গুদামে থাকা অপরিশোধিত চিনি আগুনে পুড়ে গলে লাভার মত হয়ে বেরিয়ে অসছে। এরসঙ্গে, আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ছিটানো পানি মিশে গিয়ে কারখানার পাশ দিয়ে পড়ছে পাশের কর্ণফুলী নদীতে। এতে নদীর পানি দূষিত হয়ে দেখা দিয়েছে মারাত্মক বিপর্যয়।
দূষণের ফলে পানিতে ভেসে উঠছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। সেই মাছ ধরতে কেউ ঝাকি জাল, কেউ প্লাস্টিকের ঝুড়ি, কেউবা খালি হাতেই নেমে পড়েছেন নদীতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পোড়া চিনির বর্জ্যের কারণে নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে গেছে। সে কারণে মাছ ও বিভিন্ন জলজ প্রাণী ভেসে উঠছে।
এস আলমের কারখানার পেছনে ইছানগর-বাংলাবাজার ঘাটের এক মাঝি আব্দুল জলিল বলেন, "৩০ বছর ধরে নদীতে সাম্পান বাইছি। কখনো নদীতে এভাবে মাছ ভেসে উঠতে দেখিনি। গতকাল সকাল থেকে এস আলমের সুগার মিলের বর্জ্য মিশ্রিত গাড় খয়েরী রঙের পানি অল্প অল্প করে নদীতে এসে পড়তে শুরু করে। গতকাল রাত ৩টা থেকে এর মাত্রা বাড়তে থাকলে সকালে মাছ ভেসে উঠতে শুরু করে।"
এ বিষয়ে পরিবেশবিদ ও রসায়ন বিদ্যার প্রফেসর ইদ্রিস আলী বলেন, "অগ্নিকাণ্ড থেকে সৃষ্ট বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে মারাত্মক বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমে ধ্বংস হতে পারে নদীর বাস্তুসংস্থান। এতে মরে যেতে পারে মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী। এছাড়াও পরিবেশে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে এই বর্জ্য।"
তিনি বলেন, "চিনি কার্বন, অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের পরমাণু দিয়ে তৈরি। তাপ দেওয়ার কারণে আগুনের সঙ্গে এ উপাদানগুলো বিক্রিয়া করে তরলে পরিণত হয়। এই বিক্রিয়ায় চিনি কালো হয়ে ধোঁয়া ও শক্তি বের করে দেয়। এ থেকে সৃষ্ট বর্জ্য ও বাতাস পরিবেশের ক্ষতি করে।"
বুধবার সকাল থেকে মাছ ভেসে উঠতে দেখে নদীর পাড়ে শতশত কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধ নদীতে নেমে মাছ ধরতে শুরু করেন। কেউ এক কেজি, কেউ দুই কেজি, কেউবা তারও বেশি মাছ নিয়ে ঘরে ফিরছেন। সেই মাছ ধরা দেখতে আবার ভিড় করেছে উৎসুক জনতা।
মোহাম্মদ ইসমাইল নামের যুবক বলেন, "শুরুতে বড় টেংরা, বড় চিংড়ি ও কাঁকড়া পেয়েছি। দুপুরের দিকে ছোট সাইজের মাছ পাচ্ছি। বেশিরভাগই জীবিত মাছ। কিছু মাছ পানির উপরের দিকে কিছুক্ষণ ভেসে আবার ডুব দিচ্ছে। ভাসার সময় হাত দিয়েও মাছ ধরা যাচ্ছে। আমি প্লাস্টিকের একটি ঝুড়ি দিয়ে দুই ঘন্টায় প্রায় দেড় কেজি মাছ ধরেছি।"
ইছানগর ইছানগর-বাংলাবাজার ঘাট সাম্পান মালিক সমিতির সভাপতি লোকমান দয়াল বলেন, "মঙ্গলবার রাতে এস আলম সুগার মিলের দেওয়াল কেটে পোড়া লাভা মিশ্রিত পানি পাশের নালাতে ছেড়ে দিলে, গলগল করে তা নদীতে এসে পড়তে শুরু করে। এ সময় নদীতে জোয়ার থাকায় এই বর্জ্য জোয়ারের পানিতে ভেসে কালুরঘাট পার হয়ে হালদা নদী পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। এতে সকাল থেকে নদীর পানিতে মাছ ভেসে উঠতে শুরু করায় নদীর দুই পাড়ে শতশত মানুষ মাছ ধরতে নেমে পড়ে।"
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়ক মুনিরা পারভিন বলেন, "পুড়ে যাওয়া অপরিশোধিত চিনি মিশ্রিত পানি নদীতে কী প্রভাব ফলতে পারে, তা খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। মাছ মরে ভেসে উঠছে। অন্য জলজ প্রাণীদের কী অবস্থা তা বলাই বাহুল্য। নদীর বাস্তুসংস্থান রক্ষা করতে এখনই এই কেমিক্যাল বর্জ্য নদীতে ছাড়া বন্ধ করতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, "এই নদীর পানি পরিশোধন করে নগরবাসীকে সরবরাহ করে ওয়াসা। এই দূষিত পানি খেলে নগরবাসীর কী অবস্থা হয়, তা নিয়ে আমরা শঙ্কিত।"
দুপুর ২ টার দিকে পরিবেশবাদিরা নদীতে কেমিক্যাল বর্জ্য মিশ্রিত পানি ফেলা বন্ধ করার অনুরোধ জানাতে এস আলম সুগার মিলের ফটকে গেলে তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন একজন কর্মকর্তা। এ সময় ফটক বন্ধ করে দিয়ে সাংবাদিকদের প্রবেশেও বাধা দেয়া হয়।
পরে এস আলম গ্রুপের ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা আদিলুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, "আগুন লাগার পর থেকে গলে যাওয়া অপরিশোধিত চিনি ডাম্প ট্রাকে করে কারখানার পাশে একটি খালি জায়গায় গর্ত করে রাখা হচ্ছে। কিছু লাভা লিক করে বেরিয়ে নালায় পড়ছে, যা বন্ধ করার চেষ্টা আমরা করছি।"
তবে, দেওয়াল ফুটো করে লাভা মিশ্রিত পানি নালায় ছাড়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "আগুন এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আছে। ফায়ার সার্ভিসসহ বেশ কয়েকটি সংস্থা আগুন নেভাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।"
তিনি আরও বলেন, "গুদামে থাকা এক লাখ টন অপরিশোধিত চিনি নষ্ট হয়ে গেছে। এটি একটি জাতীয় দুর্যোগ। এ সময় সবার সহযোগিতা কাম্য।"
উল্লেখ্য, গত সোমবার বিকেল ৪টার দিকে এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজের একটি গুদামে আগুন লাগে। ৪৮ ঘন্টা পার হয়ে গেলেও এই আগুন নেভাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস।