২ বছরেরও বেশি সময় ধরে আটকে আছে দেশের প্রথম খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পনগরী প্রকল্পের কাজ
কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য ও বৈচিত্রায়নের মাধ্যমে কৃষি পণ্যের বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঠাকুরগাঁওয়ে দেশের প্রথম খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পনগরী প্রকল্প কাগজে কলমে শুরু হয় আড়াই বছরেরও বেশি সময় আগে। প্রকল্পের সময়সীমা ধরা হয় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত। কিন্তু বাস্তবে এ কাজের দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই বললেই চলে।
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ গুরুত্বে হাতে নেওয়া এই প্রকল্পের ফের নতুন উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) জমা দেওয়া হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। সেখানে আগামী ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে। ব্যয়ও বেড়েছে ১৮ শতাংশ।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ ও ভূমি অধিগ্রহণের অনুমোদন প্রক্রিয়ায় বিলম্বের কারণে প্রকল্পের কাজ শুরুতেই পিছিয়ে গেছে।
কৃষি পণ্যের বাণিজ্য বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের মার্চে ঠাকুরগাঁও সফরকালে জেলায় খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল স্থাপনের ঘোষণা দেন। ২০২১ সালে প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৯৮ লাখ টাকা।
পরে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে জেলার সদর উপজেলায় ৫০ একর জমিতে বিসিক খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পনগরী স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনকে (বিসিক) নির্দেশ দেওয়া হয়।
বিসিকের কর্মকর্তারা জানান, উত্তরাঞ্চলে প্রচুর আলুসহ বিভিন্ন সবজি উৎপাদন হয়। ঠাকুরগাঁওয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পনগরী হলে সেখানে আলুর চিপস, টমেটো সস, আম ও লিচুর জুসসহ নানা ধরনের খাবার তৈরির কারখানা গড়ে তোলা যাবে।
বর্তমানে প্রকল্পটির মেয়াদ প্রায় শেষপর্যায়ে। এ অবস্থায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত বাড়াতে এবং প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ১১৬ কোটি টাকা করে নতুন উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পটি শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালের জুলাইয়ে। কিন্তু এটি শুরু হতে ৯ মাস সময় লেগে যায়। পিডি (প্রকল্প পরিচালক) নিয়োগ হয় ২০২২ সালে মে মাসে। পিডি যোগদানের পর জমি অধিগ্রহণের জন্য ডিসিকে চিঠি দেওয়া হয়। পরে সেটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ওই বছরের ২২ নভেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয়ের পাঠানো হয়, যা গত বছরের জুলাইয়ে অনুমোদন পায়। এই অনুমোদন প্রক্রিয়ার কারণেই কাজের দেরি হচ্ছে।
ঠাকুরগাঁও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পনগরীর প্রকল্পের পিডি মো. হাফিজুর রহমান বলেন, প্রকল্পের জমির চূড়ান্ত মূল্যসহ ডিপিপি সংশোধন করা হয়েছে। নতুন নীতিমালার জন্য এটি সংশোধন করা জরুরি ছিল।
তিনি যোগ করেন, 'বিশেষায়িত শিল্পনগরী হওয়ার কারণে খাদ্য প্রক্রিয়াজতকণের সাথে যুক্ত উদ্যোক্তরা এখানে প্লট পাবেন।'
ঠাকুরগাঁও বিসিক বলছে, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ করা হবে। সব মিলিয়ে এক লাখ মানুষের এবং শুধু ঠাকুরগাঁওয়েই ২৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। প্রকল্পের কাজ শেষে এখানে ২৫১টি শিল্প প্লট থাকবে। ২৫ টি শিল্প প্লট সম্ভাবনাময় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ থাকবে।
কেন ঠাকুরগাঁও
বাংলাদেশ শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩.৬%। আর মোট শ্রমশক্তির ৪০.৬২ শতাংশ কর্মসংস্থানের যোগানও আসে কৃষিখাত থেকে। কৃষি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে প্রায় ৮ শতাংশ অবদান রাখে। দেশের অন্যান্য শিল্পের তুলনায় এ খাত উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট নথিতে বিসিক জানিয়েছে, দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। দেশের খাদ্য চাহিদার ৫০ শতাংশ আসে এই অঞ্চল থেকে। আর কৃষিভিত্তিক শিল্পের কাঁচামালের ৭০ ভাগ সরবরাহ পাওয়া যায় ওই জেলাগুলো থেকেই।
এসব জেলায় প্রচুর পরিমাণে আলু, টমেটো, পেঁয়াজ, রসুন, আম, কলা, লিচু, কাঁঠাল, শাকসবজি, ফলমূল ও ধান উৎপন্ন হয়। কিন্তু খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পনগরী না থাকায় এই অঞ্চলের কৃষক পণ্যের যথাযথ দাম পায় না। আবার বিপুল পরিমাণ পণ্য নষ্টও হয়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে ভোক্তা পর্যায়ে।
জেলায় আশির দশকে ১৫ একর জায়গায় বিসিকের একটি শিল্পনগরী স্থাপন করা হয়। শিল্পনগরীটিতে ১০৫টি শিল্প প্লট রয়েছে। এখানে কোনো প্লট ফাঁকা নেই। কিন্তু কৃষি নির্ভর এই জেলায় উত্তরাঞ্চলের মধ্যে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি পরিমাণ সবজি ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুবিধার অভাবে এই অঞ্চল পিছিয়ে আছে।
ঠাকুরগাঁও চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির সদস্য রেজাউল প্রধান বলেন, 'আমাদের এই অঞ্চলে বড় বড় শিল্প কারখানা বলতে তেমন কিছু নেই। দুয়েকটি থাকলেও সেগুলো অচল। কিন্তু এই অঞ্চলে কৃষি খাত নিয়ে কাজের ব্যাপক সম্ভবনা আছে। উত্তরের মাটি কৃষির জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এখানকার আবহাওয়াও কৃষি পণ্যের উৎপাদন অনুকূলে থাকে।
তিনি বলেন, 'সব মিলে ঠাকুরগাঁওয়ে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পনগরী গড়ে উঠলে উত্তরাঞ্চল যেভাবে উপকৃত হবে, এর সুফল দেশও ভোগ করতে পারবে।'
ঠাকুরগাঁওয়ে মোজেরেল্লা পনির শিল্পের বিকাশ ঘটেছে উদ্যোক্তাদের হাত ধরে। তাদের বেশিরভাগই নারী।
ঠাকুরগাঁওয়ের নিশ্চিন্তপুর এলাকার গৃহবধূ মাসুমা খানম। তিনি জেলার সফল উদ্যোক্তাদের একজন। শহরের নিশ্চিন্তপুর এলাকায় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান ভাড়া নিয়ে তিনি পনির উৎপাদনের কারখানা গড়েছেন।
তিনি জানান, তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প এলাকায় প্লট খুবই দরকার।
আরেক পনির উদ্যোক্তা ও এমিনেন্ট অ্যাগ্রো ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেডের মালিক নাগিনা নাজনিন বানু বলেন, অনেকের মতো আমি এখানে প্লট নেওয়ার জন্য বিসিকের সঙ্গে এরই মধ্যে যোগাযোগ করে রেখেছি।