রমজানে দুর্ভিক্ষের মুখে গাজা, অনাহারে ১.১ মিলিয়ন মানুষ
এক সপ্তাহ আগে যখন রমজানের প্রথম ভোর হলো, সেই মুহূর্তটি গাজার বহু বাসিন্দাদের জন্য যে সুখকর ছিল না তা বলাবাহুল্য।
টানা পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা বর্ষণের মধ্যে গাজায় দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে বেশ আগেই। এর মধ্যে গত সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে রমজান মাস। কিন্তু বহু গাজাবাসীর কাছে খাবার নেই, যা খেয়ে তারা রোজা রাখবেন। বাঁচার জন্য খাদ্য সহায়তাই তাদের একমাত্র ভরসা। খবর বিবিসির।
গাজা সিটির আল-শিফা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের উপ-পরিচালক ডা. আমজাদ এলিওয়া বলছিলেন, 'এখানকার মানুষ কয়েক মাস আগে থেকেই রোজা রাখছেন। বেঁচে থাকার জন্য খাবারের সন্ধানে শহরের এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছেন, কিন্তু কোথাও খাবার খুঁজে পাচ্ছেন না।'
গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার জবাবে গাজায় নির্বিচার বোমা হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এতে গাজাজুড়ে খাদ্য ব্যবস্থা ও কৃষিজমি ধ্বংস হয়ে যায়।
মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো বলছে, ইসরায়েলি বাহিনী মানবিক সহায়তা সামগ্রী বহন করা ট্রাকগুলোতেও তল্লাশি চালাচ্ছে। এতে গাজার মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।
দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা বৈশ্বিক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) সোমবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, উপত্যকাটির ১.১ মিলিয়ন বাসিন্দা (গাজার প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা) ইতোমধ্যেই অনাহারে ভুগছেন। আগামী জুলাইয়ের মধ্যে বাকি মানুষগুলোরও দুর্ভিক্ষে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সবচেয়ে তীব্র খাদ্য সংকট উত্তর গাজায়। আগের রমজানগুলোর মতো সেখানকার বাসিন্দারা সেহরি করতে পারছেন না, এমনকি খাবার সামনে নিয়ে ইফতারের অপেক্ষা করাটাও এখন তাদের কাছে অনেকটাই স্বপ্নের মতো।
প্রতিবার রমজানে যেখানে গাজার সড়কগুলো বাহারি সব খাবারের দোকানে ভরে যেত, এখন সেখানে কেবল ধ্বংসস্তূপ, মৃত্যু আর খাবার সন্ধানের লড়াই। বাজারে যে আটা বা গম যা-ও কিছু পাওয়া যাচ্ছে, সেটির দামও স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি।
গাজা সিটির বাসিন্দা নাদিয়া আবু নাহেল (৫৭)। তার পরিবারে ১০টি শিশু। তিনি বলছিলেন, 'গতবারের রমজানের কথা মনে আছে। ভালো ভালো খাবার ছিল। যেমন- জুস, খেজুর, দুধ সবকিছুই যা আপনি চান। আর এ বছর, এটি যেন স্বর্গ আর নরকের মতো।'
তিনি বলেন, 'বাচ্চারা এক টুকরা রুটির আকাঙ্ক্ষা করছে। ওরা এটি খাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। ওদের শরীরের হাড় নরম হয়ে যাচ্ছে, দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং হাঁটার শক্তিটুকুও পাচ্ছে না। দিন দিন ওরা আরও রোগা-পাতলা হয়ে যাচ্ছে।'
দাতব্য সংস্থা কেয়ারের মতে, গত কয়েক সপ্তাহে উত্তর গাজায় অপুষ্টি বা ডিহাইড্রেশনে (পানিশূন্যতা) ২৩ শিশুসহ অন্তত ২৭ জন মারা গেছেন। উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে।
এদের মধ্যে গত সপ্তাহে অপুষ্টিতে ভোগা ১০-১২ বছর বয়সী এক শিশু আল-শিফা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। এ ছাড়াও নিহত এক নারীর প্রায় চার মাস বয়সী শিশু দুধের অভাবে রয়েছে। শিশুটি কেনার মতোও কেউ নেই। ১৮ বছর বয়সী আরেকটি মেয়ে মৃগীরোগে ভুগছেন।
ডা. এলিওয়া বলেন, 'মেয়েটি ইতোমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং তার জন্য আর কোনো ওষুধও আমাদের কাছে নেই। মেয়েটিরও পরিবারেও কোনো খাবার নেই। মেয়েটির শরীরে এখন হাড় আর চামড়া ছাড়া আর কিছুই নেই।'
ইসরায়েলি বোমা হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে রাফিক দুগমুশ ও তার বোন রাফিফ দুগমুশ (১৫)। হারিয়েছে মা ও চার ভাই-বোনসহ পরিবারের ১১ সদস্যকে।
শুক্রবার আল-শিফা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ছিল রাফিক। তারও শরীরের হাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল এবং হাঁটু থেকে পায়ের নিচ অংশ কেটে ফেলা হয়েছে।
নিশ্বাস নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে খুব ধীর গলায় রাফিক বলছিল, 'আমি ক্ষত-বিক্ষত। আমি এতটাই দুর্বল যে শরীরকে একপাশ থেকে অন্য পাশ করাতে পারি না।'
যদিও হামলায় আহত হওয়ার আগে থেকেই অপুষ্টিতে ভুগছিল রাফিক। সে বলল, 'আমরা খাওয়ার মতো কোনো ফল পাইনি। না আপেল, না পেয়ারা, না কোনো মাংস। কিছুই ছিল না। বাজারে যেসব খাবার ছিল সেগুলোর দামও ছিল চড়া।'
ইসরায়েলি হামলায় রাফিফের পা ভেঙেছে। সেও হাসপাতালের কর্মীদের কাছে সবজি কিংবা ফল চেয়েছিল। কিন্তু পায়নি।
রাফিফ বলল, 'রমজান ছিল খাঁটি আনন্দের একটি সময়। এখনকার তুলনায় যেন স্বর্গ। এই সময়গুলো হয়ত আর ফিরে আসবে না। আমাদের জীবন থেকে সবচেয়ে ভালো মানুষগুলো হারিয়ে গেছে।'
এদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আল-শিফা হাসপাতাল থেকে অপুষ্টিতে ভোগা বহু শিশু কামাল আদওয়ান হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে আরও বেশি শিশু মারা গেছে।
কামাল আদওয়ান হাসপাতালে শিশু বিভাগের প্রধান ডা. হুসসমা আবু সাফিয়া জানান, গত চার সপ্তাহে অপুষ্টি ও পানিশূন্যতায় এ হাসপাতালে ২১ শিশু মারা গেছে। আশঙ্কাজনক অবস্থা আরও ১০ শিশুর।
এই চিকিৎসক আরও বলেন, 'আমি শিশুদের বাঁচাতে পারছি না। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। এটি কঠিন ও লজ্জার অনুভূতি।'
তিনি বলেন, 'আমার কর্মীদের জন্যও একই অনুভূতি। তারা পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না। এমনকি কোনোদিন না খেয়েও থাকছে।'
তিনি আরও বলেন, ইসরায়েল 'অনাহারের যুদ্ধ' চালাচ্ছে।
'বিশ্বের এমন কোনো আইন নেই যা দখলদারদের ইচ্ছাকৃতভাবে শিশুদের খাদ্য থেকে বঞ্চিত করা ও ক্ষুধা দিয়ে মেরে ফেলার বৈধতা দেয়।'
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজাবাসীকে ইচ্ছাকৃতভাবে অনাহারে রাখার অভিযোগ এনেছেন।
সোমবার তিনি বলেছেন, 'গাজায় আমরা আর দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে নেই, আমরা দুর্ভিক্ষের মধ্যে আছি। এটা মেনে নেওয়া যায় না। ক্ষুধাকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ইসরায়েল দুর্ভিক্ষকে উসকে দিচ্ছে।'
তবে ইসরায়েল এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত সপ্তাহে গাজাবাসীর অনাহারে থাকার বিষয়ে বলেছেন, 'এ ধরনের কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই এবং তারা বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।'
মধ্যপ্রাচ্যের জন্য বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির জ্যেষ্ঠ মুখপাত্র আবীর ইতেফা বলেছেন, 'গাজাবাসী অনাহারে রয়েছেন। আমাদের কাছে যেসব তথ্য রয়েছে, সেগুলো অন্তত তা-ই বলছে। সেখানকার ১.১ মিলিয়ন মানুষ আইপিসি ফেজ ফাইভে (অনাহারের বিপর্যয়কর পরিস্থিতি) রয়েছেন। দুই বছরের কম বয়সী এক তৃতীয়াংশেরও বেশি শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। যার অর্থ ওরা মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে।'
এদিকে শুক্রবার গাজা উপকূলে ২০০ টন খাদ্য সহায়তা নিয়ে দাতব্য সংস্থা সেন্ট্রাল কিচেনের জাহাজ ভিড়েছে। আশা করা হচ্ছে এতে উত্তর ও মধ্য গাজার মানুষের কিছুটা হলে এই রমজানে স্বস্তি মিলবে।
শুক্রবার যখন গাজা উপকূলে খাদ্য সহায়তার ওই জাহাজ পৌঁছায়, তখন মধ্য গাজার দেইর আল-বালায় নিজেদের বাড়ির ধ্বংসস্তূপের মাঝে স্ত্রীকে রাতের খাবার তৈরিতে সাহায্য করছিলেন ছয় সন্তানের জনক খালেদ নাজি।
তিনি জানালেন, তাদের এই সহায়তা খুবই দরকার।
গাজার অনেক পরিবারের মতো নাজি ও তার পরিবারও রমজানের রোজা পালনের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু খাবারের অভাবে তারা সেটি করতে পারছেন না।
নাজি বললেন, 'আমরা আল্লাহর জন্য রোজা রাখি, কিন্তু এ বছর পারছি না।'
তিনি বলেন, 'সেহরি নয়, নয় ইফতারের মুহূর্ত কিংবা সেই রীতিনীতি যা আমরা সচরাচর পালন করি। আপনি কেবল আপনার বাচ্চাকে সামান্য কিছু খাওয়ান এবং সর্বদা আতঙ্কে থাকেন এই বুঝি মাথায় শেল পড়ল।'
শেষে তিনি বললেন, 'আমরা এ বছর রমজানের মধ্যে নেই, আমাদের নামটি পরিবর্তন করা উচিত। আমরা মৃত্যুর মাসে রয়েছি।'
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক