'দুনিয়া বদলে দেওয়ার সমাধান আফ্রিকানদের কাছে আছে'
নিজ দেশের আবহাওয়ায় উষ্ণতা বৃদ্ধির ব্যাপারে সতর্ক, ২৩ বছর বয়সী উগান্ডিয়ান জলবায়ু আন্দোলনকর্মী ভানেসা নাকাতে দেশটির রাজধানী কামপালায়, জাতীয় সংসদ ভবনের গেটের সামনে মাসের পর মাস অবস্থান নিয়ে, একা একা প্রতিবাদ করে গেছেন। তার 'রাইজ আপ মুভমেন্ট' বা জাগরণের আন্দোলন আফ্রিকা থেকে এমন কণ্ঠস্বর ছড়ানোর রাস্তা খুঁজছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সাপ্তাহিক 'টাইম' ম্যাগাজিনের জন্য তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হলিউড অভিনেত্রী ও মানবাধিকারকর্মী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।
সাক্ষাৎকারটি 'টাইম'-এর ২০ জুলাই ২০২০ সংখ্যায় ছাপা হয়েছে। সাপ্তাহিকটির ওয়েবসাইট থেকে সেটির সংক্ষিপ্ত ও সম্পাদিত সংস্করণ বাংলায় হাজির করা হলো:
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি: আপনি যা করছেন, সেটি আমাদের সবাইকে সত্যিকার অর্থেই শিক্ষা দিচ্ছে; কেননা, জলবায়ু সংকট নিয়ে মুখ খোলার মানুষ খুবই কম- এ কথা তো অন্য যে কারও চেয়ে আপনিই ভালো জানেন। এ কাজে নিজেকে জড়ালেন কীভাবে?
ভানেসা নাকাতে: স্নাতকের আগে আমি একটা গবেষণা শুরু করেছিলাম, আমার কমিউনিটির লোকজন কোন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি- সেটা বোঝার জন্য। এই মুহূর্তে জলবায়ু পরিবর্তনই মানুষের সামনে সবচেয়ে বড় হুমকি- তখন এটা জানতে পেরে আমি সত্যি চমকে গিয়েছিলাম। বুঝতে পারলাম, আমার দেশ- উগান্ডার প্রতিটি অংশ জলবায়ু সংকটের প্রভাবে ইতোমধ্যেই ভুগছে: আপনি যদি উত্তরাঞ্চলে যান, দেখবেন, লোকেরা দীর্ঘ খরায় ভুগছে; দেশটির পূর্বাঞ্চলে গেলে দেখবেন, লোকেরা ভূমিধ্বস ও বন্যায় ভুগছে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি নিজেই হয়ে ওঠব জলবায়ু আন্দোলনের একটা কণ্ঠস্বর; সুবিচার পাওয়ার চেষ্টা চালাব।
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি: সংঘাত কিংবা বাজে রাষ্ট্রশাসনের কারণে ক্ষুধায় ভুগছে মানুষ, এমন কথা তো হরদমই শোনেন। তবে আপনি যেমনটা বললেন, এটিও কিন্তু অনেকটাই জলবায়ুর সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ভানেসা নাকাতে: কিছু সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে সম্পদ ঘাটতির কারণে। যেমন ধরুন, আফ্রিকার লেক চাদের আয়তন স্রেফ ৫০ বছরে কমে ১০ ভাগের এক ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছেই। ফলে, ওখানে সম্পদ নিয়ে একটা সংঘাত লাগবেই, এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলা যায়। আর সেটি ওই অঞ্চলের শান্তি নষ্ট করে দেবে। আপনি যদি এসবের একদম শিকড়ে তাকান, দেখবেন, কখনো কখনো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এর সূচনা ঘটে।
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি: অনেক দেশেই জলবায়ু আন্দোলন মোটেও সহজ কাজ নয়; আপনি এমন এক জায়গায় থাকেন, যেখানে যেকোনো মুহূর্তে গ্রেপ্তার হতে পারেন। তাই যা করছেন, সত্যিই খুব সাহস আছে আপনার।
ভানেসা নাকাতে: কাজটা এখানে মোটেও সহজ নয়; বিশেষ করে, যখন নিজে নিজে সেইসব ধর্মঘটের মাধ্যমে শুরু করেছিলাম, তখনকার বিচারে। আমি যে কী করছি- বাবার মাথায় একদম ঢুকত না। বেশির ভাগ বন্ধু-বান্ধবের কাছে এটাকে একেবারেই উদ্ভট কাজ বলে মনে হয়েছে। তবে পরে তাদের অনেকেই বুঝতে পেরেছে, আমি আসলে করছিটা কী। তাদের কেউ কেউ সম্পৃক্ত হওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে।
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি: আপনি শুধুই মুখ খোলেননি বা সচেতনতা বাড়াননি, বরং বাস্তবিক সমাধানেরও রাস্তা খুঁজছেন, এ নিয়ে তরুণ প্রজন্ম ও স্কুলগুলোতে কাজ করছেন।
ভানেসা নাকাতে: স্কুলগুলোতে সৌর শক্তি ও ইনস্টিটিউশনাল স্টোভ বসানোর একটি প্রকল্প শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি। নবায়নযোগ্য শক্তির (এনার্জি) জন্য আমাদের একটা রূপান্তর দরকার। ওইসব স্কুলের অনেকগুলোই গামীণ জনপদে; সোলার প্যানেল বা স্টোভ এবং সেগুলো বসানোর যাবতীয় খরচ বহন করার সামর্থ তাদের নেই। তারা ওই স্কুলগুলোতে জ্বালানি কাঠের ব্যবহার কমাতে সাহায্য করেছে। যেমন ধরুন, আগে যেখানে একটা স্কুলে পাঁচ ট্রাক জ্বালানি কাঠ ব্যবহার হতো, এখন তারা স্টোভে দুই ট্রাক জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করে। এভাবে জ্বালানি কাঠ ব্যবহারের পরিমাণ কমছে। আর এ থেকে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বাবা-মায়েরাও অভিজ্ঞতার শিক্ষা পাচ্ছেন।
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি: আমি জানি, মেয়েদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে আপনি ভীষণ আবেগতাড়িত। (করোনাভাইরাস মহামারির কারণে) প্রচুর মেয়েই স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে, যা একইসঙ্গে বিষাদ ও ভীষণ বিপজ্জনক ব্যাপার।
ভানেসা নাকাতে: এই সময়কালে, বিশেষভাবে আমি খেয়াল করেছি, এই লকডাউনের সময়কালে মেয়েরা তুলনামূলক বেশি মাত্রায় গর্ভবতী হচ্ছে। কন্যাশিশুর জন্য এটা যে কত ভয়ঙ্কর ব্যাপার, ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যায়। ভীষণ, ভীষণ, ভীষণ রকমের ভয়ঙ্কর ব্যাপার এটা। টেবিলে খাবার পরিবেশন করে নারীরা। পরিবারে এসব জিনিসের ব্যবস্থা তারাই করে। তবু যেকোনো দুর্যোগে তাদেরই ভোগান্তি বেশি।
আমার দেশে মেয়েদের কোনোদিনই গাছে চড়তে দেওয়া হয় না; এর মূল কারণ, এতে নাকি তাদের মর্যাদা ও মূল্য কমে যাবে- এমনটাই শেখানো হয়েছে আমাদের। কিন্তু এরপর যখন বন্যা হলো, আপনি যদি সাঁতার না জানেন, কিংবা পালানোর কোনো উপায় না থাকে, সেক্ষেত্রে প্রাণ বাঁচানোর সবচেয়ে ঝটপট পথ হলো- সাহায্য আসার আগ পর্যন্ত কোনো গাছে চড়ে বসে থাকা। আর এ ঘটনাই আমাকে শিখিয়েছে, জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার আসলে নারীরাই হবে।
নারীরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, সেগুলো আমরা শনাক্ত করতে না পারলে, জলবায়ুর ন্যায়বিচার পাব না।
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি: আমি থাকি যুক্তরাষ্ট্রে। এখানে 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার' ঘিরে অনেক কিছুই হচ্ছে। এ ধরনের বৈশ্বিক বিষয়গুলো সামলানোর ক্ষেত্রে কোন কোন বৈষম্যের দেখা পান?
ভানেসা নাকাতে: আমরা যে ধরনের সিস্টেমের মধ্যে জীবন কাটাই, এই বৈষম্যের শুরু সেটি থেকেই। এই সিস্টেমকে পুরোদস্তুর ভেঙে ফেলা দরকার। কেননা, আমরা যদি এ ধরনের সিস্টেম চালু রাখি, তাহলে এ ধরনের বৈষম্যের দেখাও প্রতিনিয়ত পাব, এবং সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত মানুষগুলোর প্রতিনিয়ত ট্রমাটাইজ হওয়া, প্রতিনিয়ত ধ্বংস হওয়া এবং কপর্দকশূন্য হয়ে পড়া আমরা দেখতেই থাকব।
'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার'-এর কথা যখন আমি জানলাম, একেবারের মুষড়ে পড়েছিলাম; খুবই মর্মাহত হয়ে ভাবতে থাকলাম, বর্ণবাদের কারণে মানুষকে আসলে কতটা ভয়ঙ্করভাবে ভুগতে হচ্ছে। এটির অভিজ্ঞতা আমারও এক ধরনের হয়েছে; তবে যুক্তরাষ্ট্রে যেমনটা হচ্ছে, অত গভীর নয়। মনে পড়ে, জানুয়ারিতে অন্য জলবায়ু আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তোলা গ্রুপ ছবি থেকে আমাকে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছিল; আমার কাছে এটিকে বর্ণবাদ বলেই মনে হয়েছে; মনে হয়েছে, যেন আমাকে নিজের জায়গা থেকে সমূলে উপড়ে ফেলা হয়েছে। তবে সেটিই প্রথম ঘটনা নয়।
শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের তোয়াজ করা এই সিস্টেমের যদি শেষ না টানেন, এ ধরনের ঘটনা চলতেই থাকবে। রেসিয়াল জাস্টিস যদি আমরা শনাক্ত না করি, ক্লাইমেট জাস্টিসও উপলব্ধি করতে পারব না। এ কারণে প্রতিটি জলবায়ু আন্দোলনকারীরই উচিত রেসিয়াল জাস্টিস নিয়ে কথা বলা; কেননা, আপনার ক্লাইমেট জাস্টিস যদি সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত কমিউনিটিগুলোকে সম্পৃক্ত না করে, তাহলে সেটি আদৌ কোনো জাস্টিসই নয়।
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি: সেক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার, নাকি আফ্রিকা সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান বাড়ানোর তরিকার পরিবর্তন দরকার?
ভানেসা নাকাতে: আমি মনে করি, সবার আগে আসলে একটা জিনিস বুঝতে হবে- আফ্রিকা স্রেফ একটি দেশ নয়। এটি ৫৪টি দেশের একটি মহাদেশ। মনে পড়ে, স্কুলে আমরা যে ইতিহাস পড়েছি, সেখানে ক্রিতদাসত্ব ও ইত্যকার প্রসঙ্গেই বেশি লেখা ছিল। আমি মনে করি, ওই আখ্যানের এখন পরিবর্তন দরকার। আমাদের লোকেরা কী নিষ্ঠুরতার ভেতর দিয়ে গেছেন, সেগুলো শেখার দরকার আমাদের নেই; কেননা, এটিকে আমি একজন ব্যক্তিমানুষের জন্য সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।
আমি মনে করি, আফ্রিকান শিশু কিংবা পৃথিবীর যেকোনো শিশুকে আফ্রিকার ভেতরে নিহিত থাকা শক্তির কথা অবশ্যই শেখানো উচিত। আফ্রিকা মহাদেশ মানে শুধুই ক্রিতদাসত্বের ইতিহাস নয়। যারা এখানে বেড়ে উঠেছেন, যারা ডাক্তার হয়েছেন, যারা অন্যান্য পেশাজীবী হয়ে নিজ নিজ ক্যারিয়ার গড়েছেন, এটি তাদেরও মহাদেশ।
তাদের আরেকটা জিনিস জানা দরকার: যখনই কোনো আফ্রিকান কণ্ঠস্বর আওয়াজ তোলে, তখন সেটি সত্যকার অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে; কেননা, সুদীর্ঘকালের বিরতিতে আমরা আফ্রিকান মহাদেশ থেকে খুব অল্প কিছু কণ্ঠস্বরই শুনতে পেয়েছি, যেগুলো ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এমন আরও অনেকেই ছিলেন, যারা তাদের গল্প শোনানোর কোনো সুযোগ পাননি।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, যারা ন্যায্যতার দাবি তোলেন কিংবা নিজেদের কমিউনিটিতে পরিবর্তন আনার পক্ষ নেন, তাদের বলার মতো কোনো গল্প আছে। আমি আরও বিশ্বাস করি, তাদের গল্পের ভেতরই রয়েছে সমাধান। মানুষকে বুঝতে হবে, দুনিয়া বদলে দেওয়ার মতো সমাধান আফ্রিকান মানুষের কাছে আছে।
- টাইম ম্যাগাজিন থেকে অনুবাদ: রুদ্র আরিফ