লোহিত সাগর সংকট: রপ্তানিতে এয়ার ফ্রেইট চার্জ বেড়েছে ১৫০%, দিনে বাড়তি খরচ ২০ কোটি টাকা
রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আকাশপথে কনটেইনার পরিবহনের জন্য এয়ার ফ্রেইট চার্জ ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। লোহিত সাগরে সংকটের কারণে রপ্তানিকারকেরা এ নিয়মিত রুটের পরিবর্তে পণ্য পরিবহনে তুলনামূলক ব্যয়বহুল আকাশপথ বেছে নিচ্ছেন। এতে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদেরকে দৈনিক প্রায় ২০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে।
বিভিন্ন গন্তব্যে একাধিক সরাসরি ফ্লাইট থাকা ও তুলনামূলকভাবে খরচ কম হওয়ায় অনেক রপ্তানিকারক তাদের পণ্য পরিবহনের জন্য বর্তমানে ভারতীয় বিমানবন্দর ব্যবহার করছেন বলে জানিয়েছেন।
তবে ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে চাহিদা বাড়া নিয়ে অসন্তুষ্ট ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা। তারা বলছেন, এর ফলে বাংলাদেশ থেকে অতিরিক্ত চাহিদার কারণে তাদের নিজস্ব মালামাল পরিবহন ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে।
বিজিএমইএর নবনির্বাচিত পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন বলেন, লোহিত সাগর সংকটের কারণে চালানে অতিরিক্ত ১৪ দিন বিলম্ব হচ্ছে, যার ফলে ক্রেতাদের সময়মতো ডেলিভারির দাবি মেটাতে আকাশপথে পণ্য পরিবহন বেড়ে গেছে।
উচ্চ চাহিদার কারণে কিছু ব্র্যান্ডও আকাশপথে পণ্য পাঠানোর অনুরোধ করে। এ ধরনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত খরচ তারা নিজেরাই বহন করতে পারে বলে জানান তিনি।
অনিরাপদ লোহিত সাগর: উচ্চ ফ্রেইট চার্জ
গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণের জেরে লোহিত সাগরে হুথিদের হামলার কারণে সৃষ্ট নিরাপত্তা উদ্বেগের ফলে সমুদ্রপথে মালবাহী প্রধান সংস্থাগুলো বর্তমানে লোহিত সাগর এবং সুয়েজ খাল এড়িয়ে আফ্রিকার দীর্ঘ পথে পণ্য পরিবহন বেছে নিয়েছে।
রপ্তানিকারকেরা বলছেন, এ পথে বাড়তি দুই সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় লাগে যা ক্রেতাদের দেওয়া সাধারণ ডেডলাইনের চেয়ে অনেক বেশি।
তারা বলন, বেশিরভাগ ক্রেতা লিড টাইমে [ক্রয় আদেশের পর থেকে ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত সময়] ৭–১০ দিনের বিলম্ব গ্রহণ করে। কিন্তু এখন বাড়তি পথ ভ্রমণের কারণে তা সম্ভব নয়। তাই রপ্তানিকারকেরা লিড টাইম বজায় রাখতে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিমানে পণ্য পরিবহনের ওপর বেশি নির্ভর করছেন।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা থেকে ইউরোপে প্রতি কিলোগ্রাম কার্গোর এয়ার ফ্রেইট খরচ সাম্প্রতিক অতীতের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে সাড়ে চার থেকে পাঁচ ডলার হয়েছে। মাত্র তিনমাস আগেও এ খরচ দুই ডলার ছিল। একইভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নির্ধারিত শিপমেন্টের জন্য এয়ার ফ্রেইট খরচ ডিসেম্বরের তিন ডলারের তুলনায় প্রতি কিলোগ্রামে বেড়ে সাড়ে ছয় থেকে সাত ডলার হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, রপ্তানিকারকেরা এখন ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাধ্যমে প্রতিদিন ৬০০ মেট্রিক টন বা ছয় লাখ কিলোগ্রাম পণ্য পাঠান। তিন মাস আগে একই পরিমাণ পণ্য পরিবহনে তাদের খরচ হতো ১২ লাখ ডলার। ফ্রেইট চার্জ কেজিতে তিন ডলার বেড়ে যাওয়ায় তাদেরকে এখন প্রতিদিন অতিরিক্ত ১৮ লাখ ডলার খরচ করতে হচ্ছে যা টাকার হিসেবে প্রায় ২০ কোটি টাকা [প্রতি ডলার ১২০ টাকা হিসেবে]।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফএ) মতে, ঢাকা বিমানবন্দরের দৈনিক কার্গো হ্যান্ডলিং বেড়ে গড়ে ৬০০ মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে, যা তিন মাস আগের ১৫০ থেকে ২০০ মেট্রিক টনের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।
বিজিএমইএর পরিচালক আশিকুর রহমান বলেন, উৎপাদনকারীরা যদি তাদের নিজেদের বিলম্বের কারণে এয়ার শিপমেন্ট বেছে নেন, তাহলে সে খরচ তাদেরকে দিতে হয়।
আমান গার্মেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, তারা ইতোমধ্যেই একটি মার্কিন গ্রাহকের ৬০ হাজার ডলার মূল্যের পণ্য পাঠানোর জন্য এয়ার ফ্রেইট খরচ বাবদ ৩৪ হাজার ডলার পরিশোধ করেছেন।
তিনি বলেন, 'ঢাকা বিমানবন্দরে আমাদের পণ্য গুদামে ২০ দিনের মতো থাকার কারণে আমাদেরকে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টাকা গুদামভাড়া দিতে হয়েছে। প্রথম সাতদিন বিনামূল্যে রাখার সুযোগ ছিল।'
বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে তিনি বলেন, 'কার্গো ঘাটতির কারণে আমাদের দুইবার ফরওয়ার্ডার পালটাতে হয়েছিল। এতে প্রতি কিলোগ্রামে খরচ প্রায় এক ডলার বেড়েছে। প্রাথমিকভাবে আমরা প্রথম ফরওয়ার্ডারকে প্রতি কিলোগ্রামে তিন ডলার ২৫ সেন্ট পরিশোধ করেছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত খরচ বেড়ে দাঁড়ায় চার ডলার ৬৫ সেন্টে।'
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বাংলাদেশি রপ্তানিকারকেরা সবসময় তাদের পণ্য সময়মতো পাঠানোর চেষ্টা করেন। 'লিড টাইম বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন হলে তারা এয়ার ফ্রেইট অবলম্বন করেন,' বলেন তিনি।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে এয়ার কার্গো ব্যবহারকারীদের প্রায় ৯০ শতাংশই পোশাক রপ্তানিকারক। অল্প পরিমাণে সবজিও আকাশপথে রপ্তানি হয় বলে জানান তিনি।
চালানের জন্য ভারতীয় বিমানবন্দর
বিএফএফএ-এর সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, সময়মতো পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে পোশাক প্রস্তুতকারীরা ডিসেম্বরের শেষ থেকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছেন। ফলে ঢাকা বিমানবন্দরে রপ্তানি-কার্গোর লোড উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, তার ওপরে তুর্কি, আমিরাতি, কাতারি ও সৌদি কিছু এয়ার ফ্রেইট সেবাদাতা বাংলাদেশে তাদের কার্গো অপারেশন কমিয়ে দেওয়ায় ঢাকা বিমানবন্দরের কার্গো হ্যান্ডেলিং ক্ষমতায় চাপ তৈরি হয়েছে। 'ডেডিকেটেড কার্গো ফ্লাইট না থাকায় আমাদেরকে প্রায়ই যাত্রীবাহী ফ্লাইটের ওপর নির্ভর করতে হয়।'
এ পরিস্থিতির মধ্যে অনেক রপ্তানিকারক চালানের জন্য ভারতীয় বিমানবন্দর ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে আহমেদ জানান। 'তাদের বিমানবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য পরিবহনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে; প্রতি মাসে এটি ১৫০–২০০ মেট্রিক টন থেকে ৩৫০–৫০০ মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে।'
কিউট ড্রেস ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ এইচএম মুস্তাফিজ বলেন, বাংলাদেশের তুলনায় বিমান পরিবহন খরচ কম হওয়ায় কিছু রপ্তানিকারক ভারতীয় বিমানবন্দর বেছে নিচ্ছেন।
তিনি বলেন, ভারতের মাধ্যমে শিপমেন্টের আরেকটি সুবিধা হচ্ছে বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশে সরাসরি ফ্লাইট থাকা। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে রপ্তানির জন্য দ্বিতীয় দেশের মাধ্যমে ট্রানজিটের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশ।
নাখোশ ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা
ভারতীয় বিমানবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় প্রতিবেশী দেশটির রপ্তানিকারকেরা বাংলাদেশ থেকে ট্রান্স-শিপমেন্ট কার্গো বন্ধের দাবি জানাচ্ছেন। তাদের যুক্তি, বাংলাদেশি শিপমেন্ট বৃদ্ধি তাদের বিমানবন্দরের সক্ষমতায় চাপ ফেলছে এবং অপারেশনাল খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
দিল্লির সিক্সটিনথ জুলাই নামক একটি পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে অন্যান্য দেশে তাদের পণ্য রপ্তানি করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য কোরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা দর্পণ ঠাকার বলেন, প্রতি কিলোগ্রাম কার্গোর ভাড়া ২৫০ রুপি থেকে বেড়ে ৪৬৫ রুপি হয়েছে এবং বিমানবন্দরের অপেক্ষার সময় উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি বলেন, 'আগে চালান বুক করার পরদিন আমাদের কার্গো পাঠানো হতো। কিন্তু এখন পণ্য রপ্তানি করার জন্য আমাদের প্রায় দশ দিন অপেক্ষা করতে হয়।'
লজিস্টিক পরিষেবাদাতা এয়ার কার্গোর পরিচালক রুবি আবিদি বলেন, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির চালান দিল্লিতে আসতে শুরু করার পর তারা কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলায় পড়েননি এবং গত নভেম্বর পর্যন্ত সক্ষমতা পর্যাপ্ত ছিল।
'তবে ডিসেম্বরে সাগরপথে পরিবাহিত পণ্য আকাশপথে পরিবহন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রভাব পড়তে শুরু করে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা ইন্ডিটেক্স কার্গো আমাদের সক্ষমতার অনেকটুকু নিয়ে নিচ্ছে,' দ্য কোরকে বলেন তিনি।
ভারতের অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিলের (এইপিসি) চেয়ারম্যান সুধীর সেখরি বলেন, তার সংস্থা ইতোমধ্যে বাংলাদেশি কার্গোর ট্রান্স-শিপমেন্ট স্থগিত করার জন্য সরকারকে চিঠি দিয়েছে।
আবিদি বলেন, 'আমি মনে করি আমাদের হয় আরও সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত, নয়তো সাময়িকভাবে ট্রান্স-শিপমেন্ট কার্গো স্থগিত রাখা উচিত। এটি ফ্রেইট চার্জ বাড়িয়ে তুলছে। তার জেরে পণ্যের দামও বাড়ছে। এটি ভারত থেকে রপ্তানি ক্রয়াদেশকে বাধাগ্রস্ত করবে।'
তবে ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্টস অর্গানাইজেশনের ডিরেক্টর জেনারেল এবং সিইও অজয় সাহাই বিষয়টিকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশি চালান পরিবহনের বিষয়টির বৃহত্তর উদ্দেশ্যকে দেখতে হবে।
'আমি আশা করি এ সমস্যাটি সমাধান করা হবে এবং সম্ভবত এতে বিমান চালানেও অনেকটা স্বস্তি ফিরে আসবে,' সাহাই বলেন।
তৃতীয় টার্মিনাল সক্ষমতা বাড়াবে
বিএফএফএ-এর সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, দেশের এয়ার কার্গো স্ট্যান্ডের চাহিদা প্রতিদিন এক হাজার থেকে ১,২০০ মেট্রিক টন। কিন্তু বর্তমান সক্ষমতা এ চাহিদার অর্ধেকেরও কম।
তিনি বলেন, একবার ঢাকা বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে এটির কার্গো হ্যান্ডেলিং ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। একটি জাপানি কোম্পানি নতুন টার্মিনালের স্থল এবং কার্গো অপারেশন পরিচালনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা আরও দক্ষতা বাড়াবে।
চলতি বছরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশ নতুন টার্মিনালের বাকি কাজ শেষ করতে পারে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান এ অনুভূতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলেন, তৃতীয় টার্মিনালটি চালু হলে কার্গো হ্যান্ডলিং ক্ষমতা বাড়বে।
জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একজন পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ফারুক হাসান বলেন, সরকার তার এয়ারলাইন বহরের সম্প্রসারণ এবং নতুন সরাসরি রুট চালু করার পরিকল্পনা করছে, যার ফলে কার্গো সক্ষমতা বাড়বে।
বাংলাদেশ ও ইতালির মধ্যে যোগাযোগ সহজতর করে বিমান সম্প্রতি নয় বছর পর ঢাকা–রোম–ঢাকা রুটে সরাসরি ফ্লাইট চালু করেছে। হাসান বলেন, এ রুটটি সরাসরি পণ্য পরিবহন করতে সক্ষম হবে, যাতে বাড়বে বাণিজ্য দক্ষতা।