ছয় মাস চলছে, ইসরায়েল হামাসকে নির্মূল করার কতটা কাছাকাছি?
গত ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধাদের ইসরায়েলে হামলার প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। ওই হামলায় ইসরায়েলে ঢুকে প্রায় ১২০০ মানুষকে হত্যা ও শত শত মানুষকে জিম্মি করে হামাস বাহিনী। ইসরায়েলও চুপ করে বসে থাকেনি, চালিয়েছে পালটা হামলা। ইসরায়েল 'হামাসকে ধ্বংস করার' হুমকি দেয় যাতে তারা আর কোনও হুমকি সৃষ্টি না করে এবং সমস্ত জিম্মিকে ঘরে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয়।
হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, পরবর্তী নৃশংস যুদ্ধে কমপক্ষে ৩৩ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে এবং গাজা উপত্যকার বিশাল একটা অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।
ইসরায়েলের দাবি, তারা হাজার হাজার হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে এবং গাজার নিচে সুড়ঙ্গের বিশাল নেটওয়ার্কের বেশিরভাগই ধ্বংস করেছে। এই সুড়ঙ্গ দিয়েই নাকি হামাস বাহিনী ইসরায়েলের ওপর হামলা চালাত।
বিবিসি ভেরিফাই ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) প্রকাশ্য বিবৃতি এবং সামাজিক মিডিয়া পোস্টগুলো বিশ্লেষণ এবং ইসরায়েলের দাবির পেছনে প্রমাণগুলো মূল্যায়ন করেছে।
হামাসের কতজন নেতা নিহত হয়েছেন?
আইডিএফ কমান্ডারদের উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭ অক্টোবরের আগে গাজায় হামাসের প্রায় ৩০ হাজার যোদ্ধা ছিল বলে ধারণা করা হয়েছিল।
হামাসের অনেক জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যেমন-ইসমাইল হানিয়াহ; যাকে ব্যাপকভাবে দলটির সামগ্রিক নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, বিদেশে বসবাস করেন। তবে তাদের অনেক সামরিক নেতা গাজার ভেতরেই অবস্থান করছেন বলে ধারণা করা হয়।
সম্প্রতি এক বিবৃতিতে আইডিএফ জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তারা প্রায় ১৩ হাজার হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে, যদিও তারা কীভাবে এই সংখ্যা নির্ধারণ করেছে তা স্পষ্ট করেনি।
ইসরায়েল নিহত হামাস নেতাদের নামও প্রকাশ করেছে। অক্টোবর থেকে এভাবে মোট ১১৩ জনের নাম প্রকাশ করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই যুদ্ধের প্রথম তিন মাসে নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। বিপরীতে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এই বছরের মার্চ পর্যন্ত গাজায় কোনও সিনিয়র হামাস নেতার নিহত হওয়ার খবর দেয়নি।
২৬ মার্চ আইডিএফ জানায়, তারা হামাসের সামরিক শাখার ডেপুটি কমান্ডার মারওয়ান ইসাকে হত্যা করেছে। ইসা, ইসরায়েলের মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তিদের একজন হিসেবে বিবেচিত। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে নিহতদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ নেতা ।
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে তারা বিশ্বাস করে, কিন্তু হামাস তা নিশ্চিত করেনি।
আইডিএফ এমন ব্যক্তিদেরও নাম প্রকাশ করেছে যাদের তারা দাবি করছে যে, তারা নিহত হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা। তবে তারা আসলেই এই গোষ্ঠীর সদস্য কিনা তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
প্রকাশিত নামের মধ্যে একজন হলেন মুস্তাফা থুরায়া, যিনি দক্ষিণ গাজায় একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছিলেন। পেশাগত কাজে নিয়োজিত থাকে অবস্থায় জানুয়ারিতে তার গাড়িতে আক্রমণ করা হয়।
এছাড়া একের অধিক বার থাকা নামগুলো তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
গাজার বাইরে হামাসের রাজনৈতিক নেতা সালেহ আল-আরোরি জানুয়ারিতে বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহরতলি দাহিয়েতে বিস্ফোরণে নিহত হন। ইসরায়েল এই হামলার জন্য ব্যাপকভাবে দায়ী বলে মনে করা হয়।
তবে বিশেষজ্ঞরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, ইয়াহিয়া সিনওয়ারসহ গাজায় গোষ্ঠীটির অনেক প্রভাবশালী নেতা এখনো জীবিত আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়ক জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক মাইরাভ জোনসজেইন বলেন, 'আইডিএফ হামাস নেতৃত্বের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে যেতে পারেনি। উপরন্তু, তারা এই অঞ্চলে শাসক কর্তৃপক্ষ হিসেবে হামাসকে প্রতিস্থাপন করতেও সক্ষম হয়নি।'
গাজায় কতজন জিম্মি অবশিষ্ট আছেন?
ইসরায়েলি সরকারি হিসেব অনুযায়ী, ৭ অক্টোবর জিম্মি হওয়া ২৫৩ জনের মধ্যে ১০৯ জনকে বন্দী বিনিময় বা পৃথক চুক্তির মাধ্যমে মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং ৩ জনকে সরাসরি ইসরায়েলি সেনাবাহিনী উদ্ধার করেছে। ১১ জন জিম্মির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে তিনজন আইডিএফ তাদের অভিযানে নিহত বলে স্বীকার করেছে। জিম্মিদের বয়স ১৮ থেকে ৮৫ বছরের মধ্যে।
বাকি ১৩০ জন জিম্মির মধ্যে ইসরায়েল জানিয়েছে যে কমপক্ষে ৩৪ জন নিহত হয়েছে। অন্যদিকে হামাস দাবি করেছে যে আইডিএফ বিমান হামলার কারণে এই সংখ্যা আরও বেশি, যদিও এটি পুরোপুরি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
হামাসের হামলায় সর্বকনিষ্ঠ জিম্মি ছিল এরিয়েল এবং কাফির, যাদের অপহরণের সময় তাদের বয়স ছিল যথাক্রমে ৪ বছর এবং ৯ মাস। তাদের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, তবে তা নিশ্চিত করা হয়নি।
হামাস টানেল নেটওয়ার্ক বা সুড়ঙ্গের কতটুকু ধ্বংস হয়েছে?
হামাসকে নির্মূল করার অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে ইসরায়েল গাজার নিচে গোষ্ঠীটির বিস্তৃত সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা তারা পণ্য ও মানুষ চলাচলের জন্য ব্যবহার করে।
আইডিএফের মুখপাত্র জোনাথন কনরিকাস অক্টোবরে বলেছিলেন, গাজা উপত্যকাকে বেসামরিক নাগরিকদের জন্য এক স্তর এবং তারপর হামাসের জন্য আরেকটি স্তর হিসেবে চিন্তা করুন। আমরা হামাস যে দ্বিতীয় স্তরটি তৈরি করেছে সেটি ধ্বংস করার চেষ্টা করছি।
এর আগে হামাস জানিয়েছিল, তাদের টানেল নেটওয়ার্ক ৫০০ কিলোমিটার (৩১১ মাইল) পর্যন্ত বিস্তৃত, এটিও অবশ্য যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
আইডিএফকে কতগুলো টানেল এবং মোট টানেল নেটওয়ার্কের কত অনুপাত তারা ধ্বংস করেছে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে তারা জানায়, তাদের বাহিনী গাজায় সন্ত্রাসী অবকাঠামোর একটি বড় অংশ ধ্বংস করে দিয়েছে।
আইডিএফ মাঝেমধ্যেই হামাসের সুড়ঙ্গের প্রমাণ দেখিয়েছে। যেমন, গত নভেম্বরে, আইডিএফ গাজা সিটির আল-শিফা হাসপাতালের নীচে একটি টানেল নেটওয়ার্কের অংশের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে। তাদের মতে এটি হামাসের কমান্ড সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
ইসরায়েলি বাহিনী দ্বারা উন্মোচিত সামগ্রিক নেটওয়ার্কের ব্যাপ্তি নির্ধারণের চেষ্টা করার জন্য, বিবিসি ভেরিফাই ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে ২৬ মার্চ ২০২৪ এর মধ্যে গাজায় টানেলের উল্লেখ করে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম টেলিগ্রামে আইডিএফের সমস্ত বার্তা পর্যালোচনা করেছে।
এই বার্তাগুলোর মধ্যে, ১৯৮টি সুড়ঙ্গ আবিষ্কারের কথা উল্লেখ পাওয়া গেছে, যেখানে সেনাবাহিনী টানেল বা সুড়ঙ্গ শ্যাফ্ট সন্ধানের কথা জানিয়েছে। আরও ১৪১টি বার্তায় দাবি করা হয়েছে যে একটি সুড়ঙ্গ ধ্বংস বা ভেঙে ফেলা হয়েছে।
তাদের বেশিরভাগই সুনির্দিষ্ট বিবরণ বা নির্দিষ্ট অবস্থান দেয়নি, তাই আইডিএফ যে টানেল নেটওয়ার্কটি উন্মোচন করেছে বা ধ্বংস করেছে তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
গাজার নীচের এই টানেল নেটওয়ার্কটি বেশ কয়েকটি উপাদান নিয়ে গঠিত, যার মধ্যে রয়েছে টানেল রুট এবং বিভিন্ন আকারের কক্ষ, পাশাপাশি যে অংশে টানেলটি পৃষ্ঠের সাথে মিলিত হয়—এটি টানেল শ্যাফ্ট হিসেবে পরিচিত।
বিশ্লেষণ করা বার্তাগুলোর মধ্যে ৩৬টি বার্তায় ৪০০টিরও বেশি টানেল শ্যাফ্টে আঘাত করার কথা উল্লেখ রয়েছে।
তবে ইসরায়েলের রাইখম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগর্ভস্থ যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ ড. ডাফনে রিচেমন্ড-বারাক একটি খাদকে পুরো সুড়ঙ্গের সাথে সমান করার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন, কারণ এটি বিভ্রান্তিকর হতে পারে।
তার মতে, শুধু টানেল শ্যাফট ধ্বংস করলেই পুরো নেটওয়ার্ক ভেঙে যায় না। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে এই আঘাতে সম্পূর্ণ সুড়ঙ্গ ধ্বংস হয়ে যায়নি।
ইসরায়েলের আগ্রাসনের মূল্য দিতে হয়েছে গাজাকে
ইসরায়েলের হামলায় গাজায় ফিলিস্তিনিদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।
৫ এপ্রিলের পর মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ জনসংখ্যাগত পরিসংখ্যান ইঙ্গিত দেয় যে নিহতদের ৭০% এরও বেশি নারী ও শিশু ছিল।
ইসরায়েলি বাহিনী হামাসের অবকাঠামো ধ্বংস করার চেষ্টা করায় আরও অনেকে বাস্তুচ্যুত ও গৃহহীন হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের মতে, ১৭ লাখেরও বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
আবাসিক এলাকাগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, ব্যস্ত রাস্তাঘাট ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধ্বংস হয়ে গেছে এবং কৃষিজমি হয়েছে চাষের অনুপযোগী।
স্যাটেলাইট তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৭ অক্টোবর থেকে গাজার ৫৬ শতাংশেরও বেশি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও ইসরায়েল যুদ্ধের লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন