‘ফাহিমের সদা হাসিমুখ ভোলা যায় না’ শোকার্ত নাইজেরিয়ার প্রযুক্তি উদ্যোক্তারা
তরুণ বাংলাদেশি প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহ'র খণ্ডিত লাশ গত মঙ্গলবার নিউইয়র্কে তার নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্ট থেকে উদ্ধার করে স্থানীয় পুলিশ। বাংলাদেশে 'পাঠাও' রাইড শেয়ারিং সেবার সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম- উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশেও তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক উন্নয়নের ছোঁয়া পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় আফ্রিকার নাইজেরিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন 'গোকাডা' রাইড শেয়ারিং। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ছিলেন তিনি। কাজ করেছেন দেশটির অন্যান্য প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে।
নাইজেরিয়ার প্রযুক্তি উদ্যোক্তা সমাজের পরিধি খুবই ঘনিষ্ঠ। আর তাই ফাহিমের মৃত্যুতে সেখানে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। ৩৩ বছরের বাংলাদেশি তরুণ নির্বাহীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বাণী দিয়েছে তার প্রতিষ্ঠান গোকাডাও। নিজেদের মুখ্য নির্বাহীর মৃত্যুকে তারা 'আকস্মিক এবং মর্মান্তিক' বলে উল্লেখ করে। খবর সিএনএনের।
টুইটারে প্রকাশিত শোক বার্তায় বলা হয়, ''তার পরিবার-বন্ধুবান্ধব যারা এখন অপরিসীম কষ্ট এবং বেদনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তাদের সকলের জন্য আমরা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সমবেদনা জানাই। সত্যিই তার হাসিটি ভুলবার মতো নয়।''
নাইজেরিয়ার প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের স্মৃতিচারণ:
নাইজেরীয় বন্ধুরা ফাহিমকে একজন উদ্যমী এবং দৃঢ়-সংকল্প তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে স্মরণ করেন। উদীয়মান অর্থনীতির বাজারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ তৈরিতে বিশ্বাস করতেন ফাহিম- এমনটাই বলেছেন অনেকে।
দেশটির তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক উদ্যোগ 'ইডেন' এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা নাদায়ার এনেগেসি বলেন, ''সে (ফাহিম) দৃঢ়ভাবেই বিশ্ব করতো আগামীদিনে পৃথিবীর অর্থনৈতিক উত্তরণের মূল কেন্দ্র হবে উদীয়মান দেশের বাজার। এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করতে সে শতভাগ সংকল্পবদ্ধ ছিল। একারণেই সে যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে বাংলাদেশে ফিরে যায় এবং সম্প্রতি ওই একইকারণে সে নাইজেরিয়াতে এসে প্রযুক্তি নির্ভর যোগাযোগ সেবা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে।''
''ফাহিম ছিল চিন্তাশীল কিন্তু জীবনের লক্ষ্য নিয়ে তার কোনো সংশয় ছিল না। লক্ষ্যের প্রতি তার নিষ্ঠা অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তো। আমার জানা মতে, নাইজেরিয়ার প্রযুক্তিখাতের সকলেই ফাহিমকে নিজেদের একজন মনে করতেন। আমরা সবাই তাকে ভালবাসতাম'' যোগ করেন এনেগেসি।
তবে প্রায় সকলেই ফাহিমের উজ্জ্বল আর দীর্ঘসময় ধরে হাস্যোজ্জ্বল মুখটি আর দেখতে পাবেন না- একথা মনে করে আবেগ আপ্লুত হন।
নাইজেরিয়ার তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও শিক্ষা খাতের উন্নয়নে বিনিয়োগকারী গোসসি উকানউকে তাদেরই একজন।
তিনি বলেন, ওর যে বৈশিষ্ট্য আমার সারাজীবন মনে থাকবে; তা হলো ওর প্রাণচঞ্চলতা আর সেই বিখ্যাত হাসি। ফাহিমকে সবাই উদ্যোক্তা হিসেবে জানলেও, তার কৌতুকপূর্ণ স্বভাবের ভক্ত ছিল সবাই।
উকানউকে জানান, পরিচিত এক বন্ধুর সূত্রে তিনি ফাহিমের সঙ্গে পরিচিত হন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
''ফাহিম ছিল তীক্ষ্ম এবং উদ্ভাবনী চিন্তার অধিকারী। সে আসলে কী করতে চায়, তা নিয়ে কোনো সংশয়ে ভুগত না। ব্যবসায়িক আলোচনার সময়, সে নিজের চিন্তাধারা সুন্দর করে উপস্থাপন করতে পারতো। অন্যদের থেকে একটি বিষয়কে ভিন্নভাবে দেখার তার অসাধারণ গুণ ছিল ওর'' যোগ করেন উকানউকে।
মর্মান্তিক এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন হত্যাকাণ্ড:
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি দম্প্রতির সন্তান ফাহিম সালেহ স্কুলে পড়ার সময়েই প্রাঙ্কডায়াল ডটকম নামের একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেন। প্রাঙ্ক ফোনকলের রেকর্ডিং বিক্রি করে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সাইটটি ১ কোটি ডলারের ব্যবসা করেছে বলে ২০১৮ সালে জানিয়েছিলেন ফাহিম।
কিশোরকাল জুড়ে তিনি অনেক সাইট তৈরি এবং বিক্রি করেন। ম্যাসাচুসেটসের বেন্টলি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল।
উদ্যোমী এ তরুণ সম্প্রতি একটি নতুন উদ্যোগে পুঁজি বিনিয়োগকারী সংস্থা- অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশ এবং কলম্বিয়ার মতো দেশে রাইড শেয়ারিং সেবা প্রসারে বিনিয়োগ করে সংস্থাটি।
উন্নয়নশীল দেশে নতুন ও প্রযুক্তিভিত্তিক উদ্যোগের প্রসারে আপ্রাণ চেষ্টা ছিল ফাহিমের। স্বপ্ন দেখতেন এসব দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের।
নাইজেরিয়ার লাগোস ভিত্তিক অনলাইনে ওষুধ বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান লাইফস্টোর ফার্মেসি'র সহ-প্রতিষ্ঠাতা আন্ড্রু গার্জা ফাহিমের মৃত্যুর কিছুদিন আগেই তার প্রতিষ্ঠিত গোকাডার সঙ্গে একটি অংশীদারিত্বের চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন।
লকডাউনের মাঝে যখন লাগোসবাসী অবরুদ্ধ; ঠিক তখনই তাদের দ্বারে দ্বারে প্রয়োজনীয় ওষুধের চালান পৌঁছে দিয়েছে গোকাডা।
আন্ড্রু গার্জা ফাহিম সালেহ'কে একজন 'মজার মানুষ' বলে উল্লেখ করে বলেন 'সে সব সময়ই কৌতুক বলতে পছন্দ করতো।'
২০১৮ সালে প্রথম গোকাডার এক সিনিয়র কর্মীর বিদায় উপলক্ষে আয়োজিত এক পার্টিতে ফাহিম এবং গার্জা একে-অন্যের সঙ্গে পরিচিত হন।
গার্জা বলেন, '' ওই অনুষ্ঠানের পরও আমাদের মধ্যে কয়েকবার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। প্রতিবারই কফি খেতে খেতে ব্যবসার তহবিল সংগ্রহ এবং উদ্যোগের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছি আমরা। অনেক সময় নিজেদের কোম্পানির বাণিজ্যিক কৌশল নিয়ে আমরাদের মধ্যে আলোচনা হয়। কিন্তু, নিতান্ত এসব নিরস আলোচনাকে সবসময় প্রাণবন্ত করে রাখতো ফাহিমের কৌতুক বলার স্বভাব।''
মার্কিন বার্তা সংস্থা সিএনএনকে গার্জা জানান, তরুণ উদ্যোক্তা ফাহিমের সঙ্গে কাটানো মজার মুহূর্তগুলো তার স্মৃতিতে অম্লান থাকবে। একইসঙ্গে, ফাহিমের অকালমৃত্যুকে ''মর্মান্তিক এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন'' বর্বর হত্যাকাণ্ড বলেও নিন্দা করেন তিনি।