ভারতে সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি জায়ান্টদের শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগের কারণ কী?
২০২০ সালের শুরু থেকে এপর্যন্ত ভারতের বাজারে ১৭শ' কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে সিলিকন ভ্যালির বিখ্যাত কোম্পানিগুলো।
সবার আগে গত জানুয়ারিতে একশ কোটি ডলার পুঁজি নিবেশের ঘোষণা দিয়েছিল অ্যামাজন। তারপর ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ৬শ' কোটি ডলার ফেসবুক। তবে সবাইকে ছাড়িয়ে গত সপ্তাহে অ্যালফাবেট ইঙ্কের অঙ্গঃপ্রতিষ্ঠান গুগল এক হাজার কোটি ডলার লগ্নির ঘোষণা দেয়। এর বাইরে ছোটখাট অন্যান্য বিনিয়োগ মিলিয়ে চলতি বছর ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এসেছে দুই হাজার কোটি ডলারের বেশি। এর সিংহভাগটাই আসে যুক্তরাষ্ট্র তথা ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে অবস্থিত কোম্পানিগুলো থেকে।
বৃহৎ বিনিয়োগের এই ধারাবাহিকতা কিছুদিন আগেও অচিন্তনীয় বিষয় ছিল। কয়েক মাস পূর্বের ওই সময়ে ভারতের সংশ্লিষ্টখাতের সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে তথ্যের স্থানীয়করণ ও আয়করের মতো বিষয় নিয়ে প্রায় বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিল মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্টেরা। এখনকার মতো উষ্ণ অভ্যর্থনা নয়, বরং হিমশীতল প্রতিক্রিয়া পাচ্ছিলেন নানা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীরা।
বদলে যাওয়া পৃথিবীতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উত্তরণ:
তারপর অবশ্য বদলে গেছে অনেক কিছুই। করোনাভাইরাস তছনছ করে দিয়েছে বিশ্ব অর্থনীতিকে। ভারতের অর্থনীতি এর ফলে বেশ নাজুক অবস্থানে রয়েছে। আবার চীনের সঙ্গে ভারতের কূটনীতিক দ্বৈরথের প্রভাব পড়েছে চীনা প্রযুক্তি কোম্পানি বয়কটের ক্ষেত্রে। এ বিষয়টি ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির সঙ্গেও মেলে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনটিও চীনা কোম্পানিতে আস্থা রাখেনা। ভবিষ্যতের প্রযুক্তি বাজারে বরং চীনের উত্থানকে নিজেদের আধিপত্যের উপর চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখছে ওয়াশিংটন।
হংকংয়ে বেইজিংয়ের কর্তৃত্ব বৃদ্ধিসহ ওয়াশিংটনের সঙ্গে অন্যান্য বিষয়ের বিরোধে চীনা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সহযোগিতার পরিসর কমেছে মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্টদের। মূলত একারণেই, মার্কিন ইনফোটেক খাতের জন্য আগে থেকে আকর্ষণীয় ভারতের বাজারে বিনিয়োগ নতুন করে প্রাধান্য পাচ্ছে।
ভারতের সম্ভাবনা:
বড় পরিসরের নতুন পুঁজি প্রবাহগুলোর মূল লক্ষ্য কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত একটি সত্য। তা হলো; ভারতের ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল অর্থনীতির পরিধি ও সম্ভাবনা। ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ইতোমধ্যেই ৭০ কোটির বেশি। নতুন ব্যবহারকারী যোগ হতে পারে আরও ৫০ কোটি। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় টেক কোম্পানিগুলোর পক্ষে দীর্ঘসময় ধরে এমন বিপুল বাজারের আকর্ষণ উপেক্ষা করাও সম্ভব নয়।
এব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বণিক কাউন্সিলের প্রযুক্তি নীতি বিষয়ক প্রধান পরামর্শক জয় গুল্লিশ বলেন, ''বাজার নিয়ন্ত্রণ নীতিগুলো স্বচ্ছ এবং ন্যায্য হলে দীর্ঘমেয়াদে ভারতের বাজার যে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট খাতের উদ্যোগক্তাদের মধ্যে প্রবল দৃঢ় আছে। আমি মনে করি, সাম্প্রতিক বিনিয়োগের মধ্যে দিয়ে সেই আস্থার বুনিয়াদ আরও মজবুত হচ্ছে। ''
অন্যতম কারণ চীন:
দীর্ঘদিন ধরে চীনের বিপুল সম্ভাবনাময় বাজারে নিজেদের সম্পূর্ণ আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছে সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি জায়ান্টেরা। এক্ষেত্রে, অবাধ তথ্যপ্রবাহে বাঁধা দিতে চীন যে 'গ্রেট ফায়ারোয়াল' বা ডিজিটাল প্রতিবন্ধকতার দেওয়াল দেয়; সেটাই ছিল মূল কারণ। চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে শুধুমাত্র স্বশাসিত হংকংয়ে গুগল এবং ফেসবুক ব্যবহার করা সম্ভব। কিন্তু হংকংয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলটিকেও বিদ্যমান 'ফায়ারওয়ালের' আওতায় আনতে পারে চীন। এমন শঙ্কাতেও চীন বিমুখিতা বাড়ছে।
ইতোমধ্যেই, চীনের নতুন নিরাপত্তা আইনের আওতায় হংকংয়ের বেইজিং নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের বেশ কিছু ক্ষমতা পেয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে; ব্যবহারকারীদের পোস্ট সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা এবং নির্দিষ্ট কোনো প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ করার মতো আইনি বিধিমালা।
এসব আইনের প্রেক্ষিতে আবার স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থান নেয় ফেসবুক, গুগল ও টুইটার। তারা নিজেদের ব্যবহারকারীর তথ্য হংকং কর্তৃপক্ষকে দেবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়।
চীন বিরোধিতায় একাট্টা:
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি অনুষদের পরিচালক মার্ক লেম্বলি বলেন, '' চীনের সঙ্গে ব্যবসা করা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। দেশটির সঙ্গে ব্যবসা অব্যাহত রাখলে কোম্পানির নৈতিকতা বিসর্জন দিতে হবে, এমন চেতনাও বাড়ছে (পশ্চিমা) ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
তবে মূল কারণ আসলে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতা। বিশেষ করে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের তীব্র চীন বিরোধী মনোভাব। গত সপ্তাহেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রে চীনা প্রযুক্তি কোম্পানি 'হুয়াওয়ে'র আধিপত্য বিস্তার রোধে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন, বলে গর্ব প্রকাশ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল ব্যবহারকারী থাকা স্বল্প দৈর্ঘ্যের চীনা ভিডিও প্ল্যাটফর্ম টিকটক'কেও নিষিদ্ধ করার সম্ভাব্য উপায় খোঁজার কথা জানিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।
টিকটক নিষিদ্ধ করলে তাতে ভারতের পদাঙ্কই অনুসরণ করবে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষে ২০ সেনা নিহতের পর গত মাসেই টিকটকসহ ৫৯টি চীনা আপ নিষিদ্ধ করে নয়াদিল্লি। চীনা পণ্য বর্জনের কট্টর জাতীয়তাবাদি দাবিতে সাড়া দিয়েই এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
বাণিজ্যিক পরিবেশে ভরকেন্দ্র বদল:
ভারতের সঙ্গে অবশ্য চীনা প্রযুক্তিখাতের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। দেশটির বাজার নিয়ন্ত্রণ করে চীনে তৈরি স্মার্টফোন। এমনকি ভারতের প্রযুক্তিখাতের নয়া উদ্যোগগুলোয় চীনা কোম্পানির বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। এ অবস্থায় সাম্প্রতিক সীমান্ত উত্তেজনা যুক্তরাষ্ট্র-ভারত প্রযুক্তিখাতের সহযোগিতা বৃদ্ধির পরিপূরক হয়ে উঠতে চলেছে। ফলে, চীনা বিনিয়োগের ভারতীয় স্টার্টআপগুলো এখন মার্কিন পুঁজি পেয়ে চীন নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারবে অনেকাংশে।
ব্যবসায়ের নতুন ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশ বদলের ব্যাখ্যা দেন টুফটস ইউনিভার্সিটির বৈশ্বিক বাণিজ্য গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক রবি শঙ্কর চতুর্বেদী।
তিনি বলেন, ''ভারত এবং তার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলো দীর্ঘসময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার ছাতার তলে থেকে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের প্রয়াস চালিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব শক্তি দুইটির মাঝে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু, এরমধ্যেই চীনের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ ভারতকে অন্তত এক প্রজন্মের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কোলে ঠেলে দিয়েছে।''