সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গ্রামাঞ্চলে অনলাইনে পাঠদান অব্যাহত
বাড়ির উঠানের পাশে গাছ তলায় বোর্ড টানিয়ে পাঠদান করাচ্ছেন। তবে সামনে কোনো শিক্ষার্থী নেই। সেখানে মোবাইল একটি ট্রাইপডে বসিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোর। এভাবেই অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন এক শিক্ষিকা। তিনি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার বইলর সাহিত্য রত্ম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সালমা মাহমুদ।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা। এমন পরিস্থিতিতে বাড়ছে অনলাইন ক্লাসের কদর। সংসদ বাংলাদেশ চ্যানেলে প্রচারিত হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণির ক্লাস। পাশাপাশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিয়মিত অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। প্রযুক্তিগত নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও গ্রামগঞ্জের শিক্ষকরা অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। অনেকে নতুন করে শিখছেন প্রযুক্তির ব্যবহার।
শিক্ষক সালমা মাহমুদ বলেন, এভাবে ক্লাস নিতে হবে তা কোনোদিন ভাবিনি। অনলাইন ক্লাস নেওয়ার জন্য ক্যামেরা স্ট্যান্ড ও মাইক্রোফোন কিনেছি। এ সব প্রযুক্তি এর আগে কখনো ব্যবহার করিনি। এ ব্যাপারে আমার ছেলে আমাকে সহযোগিতা করছে। যতটুকু পারি চেষ্টা করছি।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ সফিউল হক জানান, ময়মনসিংহ অনলাইন প্রাইমারি স্কুল নামে একটি ফেসবুক পেজে প্রতি উপজেলা থেকে ৩৫ জন করে শিক্ষক অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। জেলার ১৩টি উপজেলা থেকে অংশ নেওয়া শিক্ষকদের সংখ্যা ৪৫৫ জন।
তিনি আরও জানান, জেলায় প্রায় পাঁচ লাখ প্রাথমিক শিক্ষার্থী রয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক ছাত্রছাত্রী অনলাইন ক্লাসের আওতায় এসেছে।
প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে নেই গ্রামগঞ্জের শিক্ষকরা। এর প্রমান মিলছে করোনাকালীন সময়ে বন্ধ থাকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এ সব অনলাইন ক্লাসে। ফেসবুকে প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন পেইজে তারা ক্লাস নিচ্ছেন।
ত্রিশাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাশেদুজ্জামান রানা জানান, এ পর্যন্ত তিনি অনলাইনের মাধ্যমে প্রায় পঞ্চাশটি ক্লাস নিয়েছেন। বিষয়টি তাদের জন্য একেবারে নতুন হওয়ায় বিপাকে পড়তে হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ''অনেকের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবে তারা ক্লাস নিতে পারছেন না। এ বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দরকার। তাহলে আরও অনেক শিক্ষক অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারবেন।''
এদিকে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ময়মনসিংহে বেড়েছে অনলাইন ক্লাসের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির বেচাকেনা। চাহিদা বেশি থাকায় বেড়েছে দামও।
শহরের অলকা নদীবাংলা মার্কেটের ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন বলেন, ট্রাইপড, মাইক্রো ফোন বিক্রি আগের থেকে অনেক বেশি বেড়েছে। ক্রেতা হিসেবে শিক্ষকদের সংখ্যা তুলনামুলক বেশি। অনেকে ঘরের ভেতরে ক্লাস নেন, তাই আলাদা লাইট স্ট্যান্ডও কিনছেন।
তিনি জানান, ক্যামেরা স্ট্যান্ড বা ট্রাইপড মডেল অনুযায়ী ১৩শ' থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া মাইক্রো ফোন বিক্রি হচ্ছে সাড়ে আটশ থেকে ১১শ' টাকায়। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম একটু বেশি বলে জানান ওই ব্যবসায়ী।
প্রাথমিকের শিক্ষকদের অনলাইনে ক্লাস নেওয়া দিন দিন বাড়লেও বাস্তবতা হচ্ছে গ্রামের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর অনলাইন ক্লাসে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট ও কম্পিউটার ব্যবহারের সুবিধা নেই গ্রামের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর। এমন পরিস্থিতিতে শিশুদের লেখাপড়া সচল রাখতে উদাহরণ হতে পারে ত্রিশাল বইলর কানহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহানা জামানের উদ্যোগ।
সপ্তাহে তিনি একদিন শিক্ষার্থীদরে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন, রাখছেন পড়াশোনার খোঁজ খবর। তিনি বলেন, অনলাইন ক্লাসে শহরের শিক্ষার্থীদের যুক্ত করা গেলেও গ্রামের চিত্র ভিন্ন। তাই অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি সপ্তাহে একবার করে হলেও শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিচ্ছি।
''শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়ার টেবিলে বসছে কম। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের খোঁজ খবর রাখছি। পড়া দিচ্ছি, আবার তা আদায়ও করে নিচ্ছি'', যোগ করেন তিনি।
কথা হয় জেলার ফুলপুর উপজেলার আবদুল হাদি নামে এক অভিভাবকের সঙ্গে। তিনি বলেন, গ্রামের সকল শিক্ষার্থীদের পক্ষে অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয় না। তাদের সবার পরিবারের পক্ষে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ব্যবস্থা করা কঠিন।
''যারা এগুলো সংগ্রহ করতে পারে তাদের প্রতিবেশী ছাত্রছাত্রীরাও ওই শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে অনলাইনে ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে। যদি শিক্ষকরা নিয়ম করে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার খোঁজ নেন বা মাঝে মধ্যে এলাকায় এসে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে আরও ভালো হত।"
ত্রিশাল উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ বলেন, অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ ছাড়া নিয়মিত জুম মিটিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষকদের উৎসাহ দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এ সময় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার একটা শঙ্কা থাকে। তাই শিক্ষকদের এ ব্যাপারে সচেতন করা হচ্ছে।
এদিকে, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে শিক্ষকদের নিরাপদে থেকে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ বলেন, প্রাথমিকের শিক্ষকরা অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার নজির সৃষ্টি করেছেন। সারা বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের শিক্ষকরা এখানে অংশ নিচ্ছেন।
তিনি বলেন, আমাদের কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শিক্ষার্থীদের নিরাপদে রাখা, সুস্থ রাখা। এ ছাড়া শিক্ষকদের নিরাপদে থেকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারা অনলাইনে পাঠদানের পাশাপাশি অবিভাভকদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে বিভিন্ন মাধ্যমে শিশুদের স্বাস্থ্য বিধি শেখানোর কাজও করছেন।