ভ্যাকসিন প্রতিযোগিতায় যেভাবে সবার চেয়ে এগিয়ে চীন
এক দশক আগে কানাডার টরেন্টো শহরে একত্রিত হয়েছিলেন সেখানে প্রবাসী কিছু চীনা বিজ্ঞানী। বারবি কিউ আর বিয়ার খেতে খেতে ওই আড্ডার আলোচনা কেন্দ্রে ছিল, ভ্যাকসিন উৎপাদনে তাদের মাতৃভূমি চীনের উন্নত বিশ্ব থেকে যোজন যোজন পিছিয়ে থাকার প্রসঙ্গ। তাই সেখানে উপস্থিত চারজন চীনা বিজ্ঞানী এ অবস্থা পরিবর্তনে একটা কিছু করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
কানাডার বিশ্বখ্যাত কিছু ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানির শীর্ষ পদের চাকরি ছেড়ে তারা ফিরে গেলেন চীনে। সেখানেই তিয়ানজিং শহরে প্রতিষ্ঠা করলেন একটি জৈব-প্রযুক্তি গবেষণা ফার্ম। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চীনে বিশ্বমানের ভ্যাকসিন উৎপাদনই ছিল মূল্য লক্ষ্য।
তিয়ানজিংয়ে প্রতিষ্ঠিত সেই কোম্পানিটিই হচ্ছে আজকের ক্যানসাইনো বায়োলজিক্স ইঙ্ক। করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন উৎপাদনের দৌড়ে এগিয়ে থাকায়; বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে চীনা প্রতিষ্ঠানটি।
ক্যানসাইনো'র চীনা বংশদ্ভূত মুখ্য নির্বাহী হলেন ইউ জুয়েফেং। ইতোপূর্বে, তিনি সানোফি'র কানাডা শাখার ভ্যাকসিন উৎপাদন কার্যক্রমের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কানাডা এবং চীনের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিক্ত রূপ নিলেও, উভয় দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রক্ষা করেছেন ইউ জুয়েফেং।
এই সম্পর্কের বরাতেই কানাডা সরকারের সবচেয়ে বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করতে সক্ষম হন তিনি। যা প্রতিষ্ঠানের বৈজ্ঞানিক দক্ষতা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
চীনে জুয়েফেং শীর্ষ এক সামরিক বাহিনীর বিজ্ঞানীর সঙ্গে প্রথমে ইবোলা ভাইরাসের প্রতিষেধক উৎপাদনের গবেষণা করেন। এখন করছেন করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনের গবেষণা।
গত মে'তে মানবদেহে নিজেদের উৎপাদিত ভ্যাকসিন প্রয়োগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে একটি সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করে ক্যানসাইনো। পুরো বিশ্বের মাঝে প্রথম তারাই এ ধাপটি অতিক্রম করে। ভ্যাকসিন গবেষণায় মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক স্তর। কারণ, এর মধ্য দিয়েই ভ্যাকসিনের সম্ভাব্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং এর সুরক্ষার দিকগুলো প্রমাণিত হয়।
সফলতায় এগিয়ে থাকা ক্যানসাইনো'র আর্থিক অবস্থা অবশ্য খুব একটা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গত বছর কোম্পানিটি দুই কোটি ২০ লাখ ডলার লোকসান করে। এখন পর্যন্ত মুনাফার মুখ দেখেনি তারা। কিন্তু, প্রতিকূলতা তাদের পিছিয়ে দেয়নি। এমনকি, পশ্চিমা দেশের বিপুল আর্থিক সক্ষমতার ফার্মাসিটিক্যাল জায়ান্টদের সঙ্গে ভ্যাকসিন ট্রায়ালের গতিতে তাল মিলিয়ে চলেছে ক্যানসাইনো, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার তাদের থেকেও এগিয়ে গেছে।
মহামারি যখন রাষ্ট্র, অর্থনীতি আর জনগণের নাভিশ্বাস সৃষ্টি করেছে, তখন বিশ্বের সব দেশই ভ্যাকসিনের সমাধান চাইছে। যদিও, তা উৎপাদনের গবেষণা এখনও চলমান। এবং এই মুহূর্তে ক্যানসাইনো বা অন্য যেকোনো কোম্পানির তৈরি ভ্যাকসিন করোনাভাইরাস প্রতিরোধের জাদুকরি উপায় হয়ে উঠবে কিনা, তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই।
তবে ক্যানসাইনো'র সফলতা চীনের নবীন জৈব-প্রযুক্তি শিল্পের বিশ্ব স্তরে উত্থানের সঙ্কেত দেয়। এ শিল্প শক্তিশালী হলে চীনা রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের হাতেও তার দেশের প্রভাব বিস্তারের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যুক্ত হবে।
সাংহাই ভিত্তিক ক্যাপিটাল সিক্যিউরিটিজ কর্পের ওষুধ শিল্প বিশ্লেষক ওয়াং রুইজেকে বলেন, ''ক্যানসাইনো যে গতিতে প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এবং মানবদেহে ভ্যাকসিনের পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। এর মধ্য দিয়ে তাদের পরীক্ষা চালানোর প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ এবং দক্ষতার সঙ্গে তা ব্যবহারের যোগ্যতা উঠে এসেছে। করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন পরীক্ষার ক্ষেত্রে তাদের যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদের প্রয়োজন হয়েছিল।''
সম্পদ চীন সরকার যেমন দিয়েছে, তেমনি তার ব্যবস্থা হয়েছে কানাডা থেকেও। এখানেই ক্যানসাইনো'র বদৌলতে একটি যোগসূত্র তৈরি হয়।
গত মে'তে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ক্যানসাইনোর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালকে তিনি জোরালো সমর্থন দিচ্ছেন বলে জানান। এমনকি দেশটির গবেষকরাও এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগে সরাসরি অংশ নিয়েছেন।
চীনের ফার্মাসিটিক্যাল খাত ওষুধের মান ও সুরক্ষা নিয়ন্ত্রণে গাফিলতির নানা কেলেঙ্কারির কারণে ইতোপূর্বে বেশ দুর্নাম কুড়িয়েছে। কিন্তু, সেই অন্ধকার এখন ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে, কারণ পশ্চিমা দেশ থেকে প্রশিক্ষিত শত শত চীনা বিজ্ঞানী এখন দেশে ফিরে আসছেন। তাদের দক্ষতা নতুন মান যোগ করছে সংশ্লিষ্ট শিল্পের উন্নয়নে।
ক্যানসাইনোর ৫৭ বছরের মুখ্য নির্বাহী জুয়েফেং কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোবায়োলজিতে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন।
২০১৯ সালে প্রথম হংকংয়ের পুঁজিবাজারে প্রথম একটি পাবলিক কোম্পানি হিসেবে আইপিও ছাড়ে ক্যানসাইনো। ওই সময়ে তিনি এবং তার চীন ফেরত বিজ্ঞানী বন্ধুদের কঠিন সময় পাড়ি দেওয়ার কথা তুলে ধরে জুয়েফেং জানান, ''আমাদের অধিকাংশের পরিবার কানাডায় ছিল। বছরে তাদের সঙ্গে মাত্র কয়েকবার দেখা করার সুযোগ পাওয়া যেত।
তিনি আরও বলেন, ''আপনজনদের থেকে দূরে থাকার ভাবনা আপনার মনকে বিষাদগ্রস্ত করে। আমার সন্তানেরা তাদের পিতাকে ছাড়াই বড় হচ্ছে, আমার স্ত্রীকে একাই শীতকালে মাইনাস ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১০ ইঞ্চি পুরু হয়ে জমা বরফ পরিষ্কার করতে হচ্ছে, এসব ভাবতে গিয়ে আমরা সকলেই ব্যথিত হতাম।''
নিজ দেশে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নে এভাবেই, আর্থিক এবং পারিবারিক ত্যাগ-তিতিক্ষা বরণ করেন ক্যানসাইনো'র বিজ্ঞানীরা। অথচ আজ তারাই প্রশান্ত মহাসাগরের দুই পাড়ের মানুষের আলোচনার কেন্দ্রে। পরীক্ষাধীন ভ্যাকসিনটি কার্যকর প্রমাণিত হলে, তাদের লোকসানী কোম্পানিটি নিঃসন্দেহে চীন তথা সমগ্র এশিয়ার মাঝে এক মহীরুহ হয়ে ওঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় পথে রয়েছে।