যশোরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, পানির তীব্র সংকটে বিপর্যস্ত জনজীবন
যশোরে শনিবার (২০ এপ্রিল) দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এ অবস্থায় চিকিৎসকেরা প্রয়োজন ছাড়া রোদে ঘর থেকে বের না হতে ও প্রচুর পরিমাণে পানি পানের পরামর্শ দিয়েছেন।
আজ যশোরে বেলা ১২টা পর্যন্ত তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বেলা গড়ানোর সঙ্গে তাপমাত্রা চড়তে থাকে; যা দুইটার দিকে রেকর্ড করা হয় ৪২.৬ ডিগ্রি। জেলার বিমানবন্দর মতিউর রহমান ঘাঁটিস্থ আবহাওয়া অফিস সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
গতকাল শুক্রবার যশোরে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৭ এপ্রিল ছিল ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ১৬ এপ্রিল তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
যশোরে অব্যাহতভাবে বয়ে যাওয়া প্রচন্ড গরমের কারণে চরম দুর্ভোগে জনজীবন। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। এ অবস্থায় বেড়েছে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা। টিউবওয়েলে উঠছে না পানি। খুব প্রয়োজন না হলে রোদে বাইরে না বেরোনোর পরামর্শ দিয়েছেন ডাক্তাররা।
শহরের বেজপাড়া এলাকায় যাত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন রিকশাচালক জাফর ইকবাল। সকাল ৮টায় রিকশা নিয়ে বের হয়েছেন। তিনি জানান, রোদের দাপটে লোকজন বাইরে কম বের হচ্ছে। তাই আয় রোজগার কমেছে। এতে সংসার খরচের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা আয় হচ্ছেনা।
চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড বাজারে বাঙ্গি বিক্রি করেছিলেন যশোর সদরের নরেন্দ্রপুর এলাকার শরিফুল ইসলাম। তিনি ভ্যানে করে বাজারে বাঙ্গি বিক্রি করছেন ৪০ থেকে ১০০ টাকা দরে। তিনি জানান, গরমে লোকজন বাইরে কম, তাই বেচা-বিক্রি বেশি একটা হচ্ছে না।
গরমের কারণে বেড়েছে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা। যশোর জেনারেল হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে পাঁচ শয্যার বিপরীতে ভর্তি রয়েছেন ৩৫ রোগী। যার মধ্যে ১৫ জনই শিশু রোগী।
এদিকে লাগাতার তাপদাহের কারণে রোদের মধ্যে বাইরে না বের হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন যশোর জেনারেল হাসপাতালের শিশু বিভাগের চিকিৎসক মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, এই গরমে ডায়রিয়া, বমি, পেটে ব্যথার রোগী বেশি ভর্তি হচ্ছে। রোগীদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা বেশি। তাদেরকে ঘরের বাইরে বের হতে দেয়া যাবেনা। বেশি করে পানি খাওয়াতে হবে।
এদিকে পানির স্তরও নেমে গেছে, টিউবওয়েলে ঠিকমতো পানি উঠছেনা। যশোর সদর উপজেলার চাঁন্দুটিয়া গ্রামের বাসিন্দা বাবুর আলী জানান, গত ১৩ দিন ধরে তার বাড়ির টিউবওয়েলে ঠিকমতো পানি উঠছে না।
একই গ্রামের আবুল কালাম জানান, টিউবওয়েল চেপে এক বালতি পানি তুলতে গিয়ে যেন জীবন যায় যায় অবস্থা। বাড়ির পাশের কৃষিজমির স্যালোমেশিনের পানি দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিচ্ছেন। কোথাও কোথাও স্যালোমেশিনেও কম পানি উঠছে। ৬ লিটার তেল ব্যয় করেও সাড়ে ৩ বিঘা ধানের আবাদি জমি ভেজানো সম্ভব হয়নি। ফলে চাষিরাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
টিউবওয়েলে পর্যাপ্ত পানি না ওঠার কারণে মানুষ দুর্ভোগে রয়েছেন। যে সব গ্রামে গভীর নলকূপ (ভ্যাটিক্যালযুক্ত টিউবওয়েল) রয়েছে সেখানে পানি নেয়ার জন্য মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে।
চুড়ামনকাটি গ্রামের সালমা খাতুন জানান, বাড়ির টিউবওয়েল দীর্ঘ সময় চেপেও এক বালতি পানি উঠানো সম্ভব হচ্ছে না। আবার কোনো কোনো সময় মোটেও পানি থাকছে না।
পৌর এলাকার বাসিন্দা বেজপাড়ার রফিকুল ইসলাম বলেন, গত ১০ দিন ধরে বাড়ির টিউবওয়েলে ঠিকমতো পানি উঠছে না। পাশের বাড়ির সাবমার্সিবল থেকে পানি নিতে হচ্ছে আমার মতো অনেককে।
যশোর বিএডিসির (সেচ) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল রশিদ জানান, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে। ফলে এমন অবস্থা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টিপাত হলেই ঠিক হয়ে যাবে।
আল রশিদ আরও জানান, যশোর জেলায় গভীর নলকূপ রয়েছে ১ হাজার ৮৬৭ টি। এসব নলকূপ দিয়ে ২৫ হাজার ২২৩ হেক্টর জমিতে পানি দেয়া হয়। আর স্যালো টিউবওয়েল রয়েছে ৬৩ হাজার ৭৯৩ টি। যা দিয়ে ১ লাখ ২৩ হাজার ৪৮২ হেক্টর জমিতে সেচ কাজ করা হয়।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদফতর যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদ পারভেজ জানান, জেলায় ২৪ হাজার ৩২৩ টি অগভীর নলকূপ রয়েছে। পানির স্তর ৩৫ ফুট নিচে চলে যাওয়ার ফলে অগভীর নলকূপগুলো অচল প্রায়। বর্তমানে সাবমার্সিবল ও তারা টিউবওয়েলে কিছুটা স্বাভাবিকভাবে পানি উঠছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপ পরিচালক সুশান্ত কুমার তরফদার জানান, যশোর জেলায় চলতি মৌসুমে ১ লাখ ৬০ হাজার ৭৮৫ হেক্টর জমিতে ধানের চাষ হয়েছে। প্রচণ্ড খরতাপে পানির স্তর নিচে যাওয়ায় স্যালোমেশিনে ঠিকমতো পানি উঠছে না। কম পানি উঠার কারণে বেশি তেল ব্যবহার হচ্ছে। যে কারণে সেচ কাজে চাষিদের ব্যয় বেড়েছে।