নিরাপদ বিশ্ব গড়তে অভিযোজন সক্ষমতা বাড়াতে হবে: প্রধানমন্ত্রী
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা জোরদারের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি, সহনশীলতা জোরদার এবং সমন্বিত ঝুঁকি হ্রাসের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
সোমবার (২২ এপ্রিল) সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) চার দিনব্যাপী জাতিসংঘ জলবায়ু অভিযোজন সম্মেলন জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (ন্যাপ) এক্সপো-২০২৪-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ছয়টি বিষয় বাস্তবায়নের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
প্রথমত, প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোকে তাদের কার্বন নিঃসরণ কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
দ্বিতীয়ত, উন্নত দেশগুলো বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের জলবায়ু তহবিলের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা পূরণ করতে হবে। অভিযোজন ও প্রশমনের মধ্যে এই তহবিল সমানভাবে বণ্টন করতে হবে।
তৃতীয়ত, উন্নত দেশগুলোকে অবশ্যই দক্ষ জ্বালানি সমাধান এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রযুক্তি হস্তান্তর নিশ্চিত করতে হবে।
চতুর্থত, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের সময়, জড়িত দেশগুলোর উন্নয়ন অগ্রাধিকারগুলো তাদের ক্ষতি এবং ক্ষতির ভিত্তিতে বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
পঞ্চমত, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, নদীভাঙন, বন্যা ও খরার কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব সব দেশকে ভাগ করে নিতে হবে।
পরিশেষে, আগামী প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে প্রধান অর্থনীতিগুলোকে অবশ্যই সকল স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী কাজ করতে হবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারহিনা আহমেদ, বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গুয়েন লুইস, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (ইউএনএফসিসিসি) নির্বাহী সচিব সাইমন স্টিল এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ প্রণয়নে বাংলাদেশের অবদান শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশেরও কম হলেও এটি নেতিবাচক প্রভাবের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি।
জলবায়ু পরিবর্তনের এসব বিরূপ প্রভাব আমাদের সম্ভাবনাময় উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য হুমকি। অব্যাহত বৈশ্বিক উষ্ণতা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি বড় এলাকা যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১২-১৭ শতাংশ এবং এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমরা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য উন্নত বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি।
শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ইনটেন্ডেড ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (আইএনডিসি) প্রণয়ন করে এবং সেটি হালনাগাদ করে ২০২১ সালে ইউএনএফসিসিসিতে জমা দিয়েছে।
তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ নিঃশর্ত ৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং শর্তসাপেক্ষে ১৫ দশমিক ১২ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করেছে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করেছে। একই সঙ্গে ২০২৩ সালে মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা (এমসিপিপি) প্রণয়ন করেছে। এটির লক্ষ্য জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় দুর্বলতা থেকে সমৃদ্ধির দিকে সহনশীলতায় পৌঁছানো।
তিনি বলেন, এছাড়া এমসিপিপির অভিযোজন ও প্রশমন কর্মসূচিতে স্থানীয় জনগণ ও অংশীজনদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ২০২২-২০৫০ সালের জন্য জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (ন্যাপ) প্রণয়ন করেছে এবং ২০২২ সালের অক্টোবরে ইউএনএফসিসিসিতে জমা দিয়েছে। এই পরিকল্পনায় ১১টি জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার ৮টি খাতে ১১৩টি অগ্রাধিকার কর্মসূচি চিহ্নিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আগামী ২৭ বছরে ন্যাপে গৃহীত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রায় ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন।
আমি ধনী দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সুনির্দিষ্ট তহবিল ও অতিরিক্ত আর্থিক সম্পদ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নত দেশগুলো ব্যাপক কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণায়নে অধিক অবদান রাখছে।
তিনি বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে রক্ষা করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব। ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আমরা অভিযোজন ও প্রশমন কার্যক্রমে উন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছিলাম। আশা করি উন্নত দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে।'
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের হুমকিতে পড়া বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পরও আর্থিক, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি সহায়তা অব্যাহত রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও ধনী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
তিনি বলেন, কপ-২৬ এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উন্নত দেশগুলোর ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৫ সালের মধ্যে অভিযোজন অর্থায়ন দ্বিগুণ করা উচিত। ধনী দেশগুলোকে এই প্রতিশ্রুতি পূরণের আহ্বান জানান তিনি।
'যেসব দেশ ইতোমধ্যে ন্যাপ প্রণয়ন করেছে তারা যাতে তাদের এনএপি বাস্তবায়নে ইউএনএফসিসিসিসহ সহজে ও দ্রুত সব উৎস থেকে আর্থিক সহায়তা পেতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।'
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সম্ভাব্য ক্ষতি হ্রাসে অভিযোজন ও প্রশমনে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইউএনএফসিসিসির লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড থেকে অর্থায়নের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ সব সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উন্নয়ন অংশীদারদের নিয়ে 'বাংলাদেশ ক্লাইমেট ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ' (বিসিডিপি) গঠন করেছে যেখানে সব পক্ষ একমত হয়েছে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, বিসিডিপি মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা, জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা, জাতীয় নির্ধারিত অবদান এবং বাংলাদেশের রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
তিনি বলেন,'আসুন আমরা এই গ্রহকে আরও নিবিড়ভাবে রক্ষার জন্য একসঙ্গে কাজ করি।'
এ অনুষ্ঠান থেকে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ক্লাইমেট ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপের (বিসিডিপি) উদ্বোধন করেন।