খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির সুবিধাভোগীর তালিকাতেও ৬ লাখ ভুয়া কার্ড!
রংপুরের মিঠাপুকুর এলাকার ময়েনপুর ইউনিয়নের এরশাদুল ও গোলাম মোস্তফা। কাজের সুবাদে দুজনেই পরিবার নিয়ে ঢাকায় বসবাস করেন। তবে খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির সুবিধাভোগী হিসেবে তাদের নামে একটি করে কার্ড ছিল। যা তারা জানতেনও না। তবে কার্ডের বিপরীতে আসা খাদ্য সহায়তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দীর্ঘদিন ধরে নিজেরাই ভোগ করছিলেন।
জানা গেছে, তদন্ত শুরু হওয়ার পর মিঠাপুকুর উপজেলায় দুই ধাপে এ ধরণের মোট ১৪৮টি কার্ড বাতিল করা হয়েছে। যার মধ্যে মৃত ব্যক্তি, নাম ঠিকানাবিহীন ব্যক্তি, স্বচ্ছল ব্যক্তিও ছিল। শুধু মিঠাপুকুর নয়, সরাদেশেই এভাবে নয়ছয় করে সুবিধা ভোগ করছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধীরা।
মিঠাপুকুরের উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. সোহেল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কিছু কার্ডে সমস্যা ছিল। এগুলো রিপ্লেস করে নতুন করে প্রকৃত সুবিধাভোগীর নামে কার্ড করা হয়েছে।'
জানা গেছে, মিঠাপুকুরের মত সারাদেশেই এ ধরণের প্রতারণা চলছিল। করোনাকালীন সময়ে তদন্ত করে এখন পর্যন্ত মোট ৬ লাখ ভুয়া কার্ড পাওয়া গেছে। যেগুলো বাতিল করে তালিকায় প্রকৃত সুবিধাভোগীদের নাম যুক্ত করা হচ্ছে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির আওতায় সারাদেশে ৫০ লাখ ব্যক্তির নামে কার্ড ছিল। এই কার্ডের বিপরীতে মূলত ১০ টাকা কেজি দরে ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। খাদ্য অধিদপ্তর এই সহায়তা দিয়ে থাকে।
জানা গেছে, করোনাকালে যখন খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির আওতায় সারাদেশে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়া শুরু হয় তখন অনেক স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে এসব চাল আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই অপরাধে একশ'রও বেশি চেয়ারম্যান-মেম্বার বহিষ্কার করা হয়েছে। অনেকের নামে দুদকে মামলাও হয়েছে।
এই অবস্থায় টনক নড়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সারাদেশে কী পরিমাণ ভুয়া কার্ড রয়েছে তা খুঁজতে তদন্ত শুরু হয়। কাজটি করছে খাদ্য অধিদপ্তর। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) নেতৃত্বে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকরা এই তালিকাটি হালনাগাদ করছে।
জানা গেছে, খাদ্য অধিদপ্তর এখন পর্যন্ত প্রায় ৬ লাখ ভুয়া কার্ডের সন্ধান পায়। যেখানে পাওয়া গেছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আত্মীয়স্বজন, মৃত ব্যক্তি, স্বচ্ছল পরিবার, গ্রামে বসবাস করে না, আবার কারও নামের কার্ড থাকলেও সে ব্যক্তি জানে না এরকম ব্যক্তিদের নামে কার্ড। এসব কার্ডের বিপরীতে সরকারী সহায়তা দীর্ঘদিন দরে আত্মসাৎ করা হচ্ছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা এখন পর্যন্ত ৬ লাখ কার্ড পেয়েছি। যেগুলো আসলে কিছু সচ্ছল পরিবার, মৃত ব্যক্তি, কিছু নাম পরিচয়হীন ব্যক্তি, গ্রামে থাকে না এমন কিছু ব্যক্তির নামে ছিল। যেগুলো আমরা বাতিল করেছি এবং সত্যিকার অর্থেই দরিদ্র এমন মানুষের নামে এগুলো দেওয়া হচ্ছে।'
খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বছরের মার্চ-এপ্রিল ও সেপ্টেম্বর-নভেম্বর এই পাঁচ মাসে ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির আওতায় ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। করোনা মহামারিতে যখন সারাদেশে নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমে যায় তখন এই সহায়তা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু এগুলো বিতরণ করতে গিয়ে সরকারকে অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়। কারণ সারাদেশ থেকেই অনিয়মের অভিযোগ উঠতে থাকে।
এর প্রেক্ষিতেই তদন্ত শুরু হয় ভুয়া কার্ড খুজে বের করার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সারোয়ার মাহমুদ বলেন, 'সারাদেশ থেকে যখন অনিয়মের অভিযোগ উঠতে থাকে তখনই এই তদন্ত শুরু হয়। এটা এখনো চলমান রয়েছে।'
তবে এখনো কোনো কোনো জায়গায় ভুয়া কার্ডের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার চর নাসিরপুর ইউনিয়নের রাজিয়া বেগম এবং নার্গিস আক্তার। তাদের নামে খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির আওতায় যে কার্ড রয়েছে তা তারা জানতেনই না। অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছের লোকজন এই কার্ডের বিপরীতে সুবিধা নিয়েছেন। এ বিষয়ে স্থানীয় মেম্বাররাই আবার ইউএনও ও জেলার প্রশাসকের কাছে অভিযোগ করেছেন বলে জানা গেছে। যা এখনো তদন্তাধীন।
এই অনিয়ম বন্ধে খাদ্য মন্ত্রণালয় কিউআরকোডসহ ডিজিটাল কার্ড তৈরির কাজ শুরু করেছে। যেখানে ভোটার আইডির তথ্য দিয়ে কার্ডটি করা হবে। এই কার্ডের হলে কার্ডধারী ব্যতিত অন্য কেউ সুবিধা নিতে পারবে না। আগামি সেপ্টেম্বরে আবার ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণ করা হবে। তখন পরীক্ষামূলকভাবে কিছু ডিজিটাল কার্ড ব্যবহারের জন্য কাজ শুরু হয়েছে।
খাদ্য সচিব নাজমানারা খানুম বলেন, 'আমরা ডিজিটাল কার্ডে যাবো, কাজও শুরু হয়েছে। এর জন্য অবশ্য একটু সময়ের দরকার আছে। এই কার্ড থাকলে কেউ জালিয়াতি করার সুযোগ পাবে না।'
উল্লেখ্য, করোনাকালীন সময়ে যখন মানুষের আয় কমে যায় তখন প্রধানমন্ত্রী খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির ৫০ লাখ সুবিধাভোগীর বাইরে আরও ৫০ লাখ লোকের তালিকা করতে বলেন। যাদেরকে নগদ ২৫০০ করে টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু এখানে যে ৫০ লাখ লোকের তালিকা করা হয় তার মধ্যে ২৮ লাখ লোকের তথ্যে গড়মিল পাওয়া গেছে। যার মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে জনপ্রতিনিধিরা প্রায় ৭০০ কোটি টাকা মেরে দেওয়ার পায়তারা করছিলেন।