বিশ্বে ব্র্যান্ডেড প্লাস্টিক দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী কোকা-কোলা ও পেপসিকো: গবেষণা
প্রতি বছর বিভিন্ন কোম্পানি সমস্ত পৃথিবীতে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক উৎপাদন করছে। এই প্লাস্টিকের কিছু নদী বা সমুদ্র সৈকতে জমা হয়ে পানির স্বাভাবিক স্রোতে বাধা সৃষ্টি করে। আবার কিছু প্লাস্টিক ভেঙ্গে অতিক্ষুদ্র মাইক্রোপ্লাস্টিক বা ন্যানোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। এ ধরনের অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক বাতাসে ভাসতে পারে এবং মানুষের ফুসফুস ও রক্তসহ অন্যান্য অঙ্গে প্রবেশ করতে পারে।
যদিও এর পেছন কোন কোন কোম্পানি দায়ী তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন, সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বেশ কিছু কোম্পানির নাম উঠে এসেছে যেগুলো অতিরিক্ত মাত্রায় প্লাস্টিক দূষণ করছে।
বুধবার (২৪ এপ্রিল) 'সায়েন্স অ্যাডভান্স' জার্নালে প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণায় ছয়টি মহাদেশের বেশ কিছু বড় কোম্পানি বা ব্র্যান্ড এর নাম উঠে এসেছে যেগুলো ব্র্যান্ডেড প্লাস্টিক দূষণের সাথে জড়িত। গবেষকরা ১ লাখের বেশী স্বেচ্ছাসেবীদের সহায়তায় ১.৮ মিলিয়নের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য আলাদা করেছেন তাদের গবেষণার জন্য। এতে তারা দেখতে পান, ৫৬টি কোম্পানি বিশ্বব্যাপী ৫০ শতাংশের বেশি প্লাস্টিক দূষণ করে আসছে। এর মধ্যে কোকা-কোলা একাই মোট ১১ শতাংশ প্লাস্টিক দূষণের জন্য দায়ী।
তথ্য সংগ্রহের জন্য বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্লাস্টিক 'নিরীক্ষা' পরিচালনা করেছেন। তারা সতর্কতার সাথে সমুদ্র সৈকত, পার্ক, নদী এবং অন্যান্য এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে প্লাস্টিকের ধ্বংসাবশেষ সংগ্রহ করেছেন। তারা প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রতিটি অংশ পরীক্ষা করে দৃশ্যমান ব্র্যান্ড বা ট্রেডমার্ক চিহ্নিত করেছে। ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ব্রেক ফ্রি ফ্রম প্লাস্টিক নামের সংস্থাটি ১ হাজার ৫শ ৭৬টি নিরীক্ষা সমন্বয় করেছে।
পরীক্ষা চালানো ১.৮ মিলিয়নেরও বেশি প্লাস্টিকের মধ্যে প্রায় ৯ লাখ ১০ হাজার প্লাস্টিকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দৃশ্যমান চিহ্ন পাওয়া গেছে। [এটি লক্ষণীয় যে সূর্যালোক এবং আবহাওয়ার সংস্পর্শে আসার কারণে প্লাস্টিক তার ব্র্যান্ড মার্কারগুলো (চিহ্ন) হারাতে পারে।] ব্র্যান্ডের দৃশ্যমান চিহ্নের ওপর ভিত্তি করে ব্র্যান্ডেড প্লাস্টিক দূষণের জন্য দায়ী শীর্ষ কোম্পানিগুলো (শনাক্তকৃত) হলো— কোকা-কোলা, পেপসিকো, নেসলে এবং ড্যানোন।
একটি ইমেইলে কোকা-কোলার একজন মুখপাত্র কোম্পানিটির 'ওয়ার্ল্ড উইদাউট ওয়েস্ট' নামক কৌশলের কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন, কোকা-কোলা ২০২৫ সালের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী শতভাগ পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্যাকেজিং ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি ২০৩০ সালের মধ্যে কোম্পানিটি ৫০ শতাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান ব্যবহার করতে চায় প্যাকেজিংয়ের জন্য।
নেসলে একটি ইমেইলে জানিয়েছে, কোম্পানির মূল লক্ষ্য নতুন প্লাস্টিকের ব্যবহার এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা এবং প্যাকেজিংয়ের জন্য আরো বেশি করে পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান ব্যবহার করা। পেপসিকো ইমেইলের মাধ্যমে জানিয়েছে, কোম্পানিটি প্লাস্টিক দূষণ মোকাবেলায় একটি বৈশ্বিক নীতি কাঠামোর পক্ষে এবং এমন একটি অর্থনীতি গড়ে তুলতে কাজ করছে যেখানে প্লাস্টিক পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব।
এদিকে মার্কিন তামাকজাত দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও বিপণন ব্র্যান্ড আলট্রিয়ার একজন মুখপাত্র গবেষণাটিকে তাদের কোম্পানির প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ভুল দাবি করেছে। তাদের দাবি, গবেষণার জন্য ৮০টির বেশি দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হলেও আলট্রিয়ার সিগারেট কোম্পানি ফিলিপ মরিস ইউএসএ-এর কার্যক্রম শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ।
গবেষণার ব্যাপারে কোন মন্তব্য জানায়নি ফ্রান্সভিত্তিক বহুজাতিক খাদ্যসামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ড্যানোন।
গবেষকরা একটি কোম্পানির প্লাস্টিক উৎপাদন এবং পরিবেশে আবিষ্কৃত প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, যদি পেপসিকো বিশ্বের প্লাস্টিকের মোট ওজনের ১ শতাংশ উৎপাদন করে তাহলে এটি নিরীক্ষায় পাওয়া বর্জ্যের প্রায় ১ শতাংশের জন্য দায়ী। একইভাবে, যদি একটি কোম্পানি বিশ্বের প্লাস্টিকের মোট ওজনের ০.১ শতাংশ উৎপাদন করে তবে এটি ০.১ শতাংশ বর্জ্যের জন্য দায়ী । এ অনুসন্ধানটি পরামর্শ দেয়, শুধু পুনর্ব্যবহার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লাস্টিক সমস্যা সমাধান করার জন্য যথেষ্ট নয়।
বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক সমস্যা সমাধানে একটি চুক্তি করার ব্যাপারে আলোচনার জন্য এই সপ্তাহে অটোয়াতে বিশ্ব নেতারা এবং মধ্যস্ততাকারীরা একত্রিত হবেন। অনেক পরিবেশগত সংস্থা এবং দেশগুলো এমন একটি চুক্তি চায় যা প্লাস্টিক উৎপাদন হ্রাস করবে যা মার্কিন মধ্যস্ততাকারীরা প্রতিরোধ করে আসছে।
শিল্প গোষ্ঠী এবং সংস্থাগুলি যুক্তি দিয়েছে, বারবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক উৎপাদন, উন্নত রিসাইকেল ব্যবস্থা এবং উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লাস্টিক উৎপাদন ব্যাহত না করেই এ সমস্যাটির সমাধান করতে পারে।
ওয়ার্ল্ড প্লাস্টিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বেনি মারম্যানস বলেন, "আমাদের সদস্যরা বারবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের সরবরাহ বাড়াতে বিভিন্ন অবকাঠামোতে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে যাতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকগুলি বর্জ্য, ভূমি বা পুড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে পরিবেশে প্রবেশ করতে না পারে।"
প্লাস্টিক শিল্পের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টদের দাবি, প্লাস্টিক বিশ্ব অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। এর উৎপাদন কমালে তা নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
গবেষকরা শুধু পুনর্ব্যবহার বাড়ানো বা বৃত্তাকার অর্থনীতির গুরুত্বের উপর জোর না দিয়ে প্লাস্টিক উৎপাদন কমানোর বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন। তেল ও গ্যাস উৎপাদনকে লক্ষ্য করে জলবায়ু নীতি থাকা সত্ত্বেও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে তৈরি হওয়া প্লাস্টিক এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখছে। আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা ধারণা করছে, প্লাস্টিকের জন্য এ শতাব্দীর মাঝামাঝি তেলের চাহিদা অর্ধেক বৃদ্ধি পাবে।
ইতোমধ্যেই বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, প্লাস্টিক উৎপাদনে বিধিনিষেধ না থাকায় সেটি পরিবেশের ক্ষতি করার পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়