প্লাস্টিক বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তর: মুমানু পলিয়েস্টার ইন্ডাস্ট্রিজ যেভাবে টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে কাজ করছে
মানিকগঞ্জের সিংগাইরে একটি ব্যস্ত কারখানায় শশব্যস্ত হয়ে কাজ করছেন প্রায় ২০ জন শ্রমিক। ঝুট প্লাস্টিকের বোতল থেকে লেবেল খুলে ফেলছেন তারা। এই বোতলগুলো পরে বেশ কয়েকটি স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফাইবারে রূপান্তরিত করা হবে।
ব্যবহারযোগ্য ফাইবারে রূপান্তরের আগে বোতলগুলো ধোয়া ও কেটে টুকরো টুকরো করার মতো বেশ কয়েকটি ধাপ পাড়ি দেয়। এসব ধাপ পার হওয়ার পর একটি মেশিন এই ফাইবারগুলোকে রোল করে, যা পরবর্তীতে প্যাকেজ করে বিক্রির জন্য সংরক্ষণ করা হয়।
প্লাস্টিক বর্জ্যকে পলিয়েস্টার স্ট্যাপল ফাইবারে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশের চক্রাকার অর্থনীতিতে (সার্কুলার ইকোনমি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত মুমানু পলিয়েস্টার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
কোম্পানিটির একটি ১ লাখ ৩৮ হাজার ২০০ বর্গফুটের অত্যাধুনিক কারখানা রয়েছে। এখানে দৈনিক ৮০ থেকে ১০০ টন ফাইবার প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এই পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়া প্লাস্টিক বর্জ্য সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি দেশের শক্তিশালী তৈরি পোশাক খাতসহ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা পূরণ করে।
মুমানুর উপ-মহাব্যবস্থাপক (বিজনেস ডেভেলপমেন্ট প্রধান) রুহুল হোসেন কোম্পানিটির টেকসই উদ্যোগের বিষয়ে বলেন, 'আমাদের কোম্পানি কোনো বর্জ্য তৈরি করে না। আমরা আমাদের কারখানায় প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে সতেরো ধরনের ফাইবার তৈরি করি। অবশিষ্ট উপাদান দিয়ে দড়ি ও বেল্ট বানাই। কিছু বর্জ্য থেকে ইটও তৈরি করি।'
তিনি আরও বলেন, 'মুমানু প্রথমে শুধু রপ্তানিতেই জোর দিত। এখন আমাদের পণ্যের ৫০ শতাংশ রপ্তানি হয়, বাকি ৫০ শতাংশ বিক্রি হয় স্থানীয় বাজারে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমাদের টার্নওভার ছিল প্রায় ২০০ কোটি টাকা, যা ক্রমশ বাড়ছে। আমরা চীন, ভারত ও ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশে ফাইবার রপ্তানি করি।'
বিশ্বব্যাংকের ২০২১ সালের সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, যা দেশের মোট বর্জ্যের ১০ শতাংশ। এর মধ্যে মাত্র ৩৭.২ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইকেল করা হয়।
২০২৪ সালে মুমানু সারা দেশ থেকে রেকর্ড ১৮ হাজার ৪৬০ টন পিইটি (পলিইথিলিন টেরেফথালেট) বোতল সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ঢাকা থেকে সর্বোচ্চ সংগ্রহ করা হয়েছে ৯ হাজার ৪৮১ টন বোতল; এরপর চট্টগ্রাম থেকে ৩ হাজার ৭৭২ টন ও রংপুর থেকে ৩ হাজার ৬৭৪ টন বোতল সংগ্রহ করা হয়েছে।
বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে অংশীদারত্বের মাধ্যমে সরবরাহ শৃঙ্খলকে শক্তিশালী করেছে মুনামু। এতে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জিনিসের নিয়মিত সরবরাহ আসার পাশাপাশি পানীয় কোম্পানিগুলোর টেকসই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহায়তা হয়েছে।
মুমানুর তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানিটি বোতল সংগ্রহকারী, বর্জ্য দোকানের কর্মচারী, সংগ্রাহক ও পরিবেশকসহ প্রায় ৩ লাখ ৬৫ হাজার কর্মীকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে।
কর্মীদের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে মজুরি দেওয়া হয়। বোতল সংগ্রহকারীরা প্রতিদিন প্রায় হাজার টাকা করে এবং পরিবেশকরা মাসে গড়ে ১৫ হাজার টাকা আয় করেন। কোম্পানিটিতে প্রায় ২৫০ জন স্থায়ী কর্মী আছেন।
পলিয়েস্টার স্টেপল ফাইবার উৎপাদনে চীনের মতো বাজারগুলোর তুলনায় খরচের দিক দিয়ে বেশ সুবিধা পায় মুমানু। বাংলাদেশে পলিয়েস্টার স্টেপল ফাইবারের উৎপাদন খরচ কেজিতে প্রায় ১.১৫ ডলার, যেখানে চীনে এ খরচ প্রায় ১.৪৫ ডলার।
এই ০.৩০ ডলারের সাশ্রয় হয় কম কাঁচামাল খরচ, সাশ্রয়ী শ্রম ও দ্রুত শিপিংয়ের সময়ের কারণে—যা বাংলাদেশকে উচ্চমানের পলিয়েস্টার স্টেপল ফাইবারের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক এবং সাশ্রয়ী উৎসে পরিণত করেছে।
গাজীপুরের রাজু এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ওয়াদুদ মিয়া রাজু নিয়মিত মুমানু থেকে বালিশ, সোফার কুশন ও ম্যাটের জন্য ফাইবার কেনেন। তিনি বলেন, 'আমার প্রতি মাসে প্রায় ২০ টন ফ্যাব্রিক লাগে। এর পুরোটাই মুমানু থেকে নিই। চার বছর আগেও বিদেশ থেকে এই উপকরণ আমদানি করতে হতো আমাদেরকে, এখন কম দামে দেশেই পাচ্ছি। আমদানি করা ফাইবারের দাম ১২০ টাকা কেজি হলেও এখন মুমানুর ফাইবার ১১৫ টাকা কেজি কিনতে পারি।'
মুমানু পলিয়েস্টার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা আবুল কালাম মোহাম্মদ মুসা। তিনি মনে করতেন, প্লাস্টিক বর্জ্যকে লাভজনক ব্যবসায় রূপান্তরিত করা সম্ভব। এর মাধ্যমে পরিবেশকেও সহায়তা করা যাবে।
একবার চীন ভ্রমণে গিয়ে সেখানকার মানুষ কীভাবে প্লাস্টিকের বোতল সংরক্ষণ ও পুনর্ব্যবহার করে, তা লক্ষ করেছিলেন মুসা। তা দেখেই তার মনে হয়, বাংলাদেশেও প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে অর্থ উপার্জনের সুযোগ আছে। এই ভাবনা থেকেই ২০১৪ সালে তিনি রিসাইক্লিং প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করেন।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে মুমানুর কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে কোম্পানিটি দেশের সবচেয়ে উন্নত পলিয়েস্টার ফাইবার প্ল্যান্টগুলোর একটি।
উন্নত প্রযুক্তি ও টেকসই চর্চা
মুমানুর রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া শুরু হয় সারা দেশের সরবরাহকারীদের কাছ থেকে ব্যবহৃত পিইটি বোতল সংগ্রহের মাধ্যমে।
প্রথমে বোতলগুলো যত্ন নিয়ে পরিষ্কার ও বাছাই করা হয়। লেবেল অপসারণ করে গরম ও ঠান্ডা পানিতে ধোয়া হয়। পরিষ্কার করার পর প্লাস্টিক গলিয়ে তৈরি করা হয় ফাইবার।
প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে পলিয়েস্টার স্টেপল ফাইবার উৎপাদন করে মুমানু বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করছে। পাশাপাশি নতুন উপকরণের প্রয়োজন কমিয়ে বিভিন্ন শিল্পের জন্য টেকসই সম্পদ তৈরি করছে।
পুনর্ব্যবহৃত ফাইবার উৎপাদনের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে মুমানু দেশের চক্রাকার অর্থনীতিকে সমর্থন দিয়ে পরিবেশগত প্রভাব কমাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
উন্নত রিসাইক্লিং প্রযুক্তি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে মুমানু বাংলাদেশে সবুজ শিল্পের পরিসর বাড়াতে কাজ করছে। ভবিষ্যতে পিইটি রিসাইক্লিং শিল্পে আরও অবদান রাখার পরিকল্পনা রয়েছে কোম্পানিটির।