ট্রান্সশিপমেন্টে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আখাউড়া স্থলবন্দরের বাণিজ্য
দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন কার্যক্রম শুরু করেছে ভারত। বৃহস্পতিবার সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম চালানের পণ্য নিয়ে চারটি কন্টেইনার বোঝাই ট্রেইলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে আগরতলায় পৌঁছায়। পরীক্ষামূলক এই চালানে ছিল রড ও ডাল। মূলত খরচ ও সময় বাঁচাতেই বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে পণ্য সরবরাহ করবে ভারত।
২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের মধ্যে সম্পাদিত 'এগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফ্রম ইন্ডিয়া বিটুইন বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডিয়া' চুক্তির আওতায় এবং ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর উভয় দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) অনুযায়ী বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করে নিজ দেশে পণ্য পরিবহন করবে ভারত।
ট্রান্সশিপমেন্টের প্রথম চালানেই ৫৩.২৫ টন রড ও ৪৯.৮৩ মেট্রিক টন ডাল নিয়ে গেছে ভারত। এ জন্য নির্ধারিত মাশুল ও ফি পরিশোধ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করে রড-সিমেন্টের মতো চাহিদাসম্পন্ন পণ্য পরিবহনের ফলে আখাউড়া স্থলবন্দরের রফতানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত আখাউড়া স্থলবন্দরটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন পণ্য রফতানি হয়ে আসছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে। এক সময় প্রচুর পরিমাণ পণ্য রফতানি হলেও গেল কয়েক বছর ধরে রফতানি বাণিজ্যে ধস নেমেছে। মূলত ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে অন্যান্য রাজ্যগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে পণ্য আমদানি কমিয়ে দেয় সেখানকার ব্যবসায়ীরা।
সবচেয়ে বেশি চাহিদাসম্পন্ন পাথর এখন শিলং থেকে সংগ্রহ করছেন বড় ব্যবসায়ীরা। আর নানা অজুহাত দেখিয়ে প্রায়ই মাছ আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। আগে প্রতিদিন রড, সিমেন্ট, পাথর, কয়লা, তুলা, মাছ ও প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন পণ্যবোঝাই শতাধিক ট্রাক আগরতলা স্থলবন্দরে প্রবেশ করলেও করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকেই তা অর্ধেকেরও নিচে নেমে আসে।
করোনাভাইরাসের প্রকোপে এবং বর্ষা মৌসুম হওয়ায় এখন রফতানির পরিমাণ আরও কমেছে। বর্তমানে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ ট্রাক পণ্য যাচ্ছে আগরতলা স্থলবন্দরে। এর মধ্যে রড, কয়লা, পাথর ও মাছ রফতানি কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। এখন শুধুমাত্র সিমেন্ট, ভোজ্য তেল, তুলা, প্লাস্টিক ও খাদ্যসামগ্রী যাচ্ছে। তবে সেগুলোর পরিমাণও খুবই কম।
এ দিকে, করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেওয়ার আগে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে প্রতি মাসে গড়ে তিনশ টন রড রফতানি হতো। প্রতি মাসে অন্তত এক লাখ ব্যাগ সিমেন্ট যেত। কিন্তু ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে রড-সিমেন্টের মতো চাহিদা সম্পন্ন পণ্য পরিবহন হলে স্থলবন্দরের রফতানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, রড-সিমেন্টের বাজার ধরে রাখতে এসব পণ্য ট্রান্সশিপমেন্টের আওতামুক্ত রাখা হোক।
আখাউড়া স্থলবন্দরের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে থেকেই রফতানি বাণিজ্যে ধস নেমেছে। করোনাভাইরাসের কারণে এখন আরও করুণ দশা বন্দরের। এখন যদি রড-সিমেন্টের মতো চাহিদা সম্পন্ন পণ্য রফতানি না করা যায় তাহলে বন্দরের ব্যবসায়িক কার্যক্রম টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে পড়বে।
আখাউড়া স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী ইদন মিয়া বলেন, ট্রান্সশিপমেন্টের কারণে আমাদের রফতানি বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবে। আমার দেশের পণ্য আমি ভারতে রফতানি করতাম, এখন তারা (ভারত) সরাসরি মাল নিয়ে যাচ্ছে। এতে করে আমাদের দেশের যে মাল রফতানি করতাম সেটি হ্রাস পাবে।
আখাউড়া স্থলবন্দরের কাস্টমস্ ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফোরকান আহমেদ খলিফা বলেন, 'আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে সরাসরি রফতানি হতো। এখন কোলকাতা থেকে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে নিয়ে যাচ্ছে। সেদিক বিবেচনা করলে বন্দরের রফতানি বাণিজ্যে কিছুটা প্রভাব পড়ে। রফতানি করলে আমাদের রেমিট্যান্স আসে। এখন তারা সরাসরি নিজেরটা নিজে নিয়ে যাচ্ছে।'
আখাউড়া স্থলবন্দরের আমদানি-রফতানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম বলেন, 'আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে প্রতি মাসে তিনশ টন রড ও একলাখ ব্যাগ সিমেন্ট রফতানি হয়। যদি ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে রড-সিমেন্ট পরিবহন কার্যক্রম অব্যাহত থাকে থাকে তাহলে স্থলবন্দরের রফতানি বাণিজ্যে ব্যাঘাত ঘটবে। যেহেতু পরীক্ষামূলক চালান, তাই আমরা পর্যবেক্ষণ করছি।'
কোলকাতা থেকে আসা পরীক্ষামূলক প্রথম চালানের পণ্য পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আদনান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের সত্ত্বাধিকারী আক্তার হোসেন বলেন, 'এই চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী এবং জোরদার হবে। এটি পরীক্ষামূলক চালান, পরবর্তীতে আরও পণ্য আসার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে'।
বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা কোন প্রক্রিয়ায় পণ্য আমদানি করেন জানতে চাইলে আখাউড়া স্থলবন্দরের আমদানি-রফতানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাজিব উদ্দিন ভূইয়া জানান, ভারতীয় যে ব্যবসায়ী পণ্য আমদানি করবেন, তার নামে ব্যাংকে এলসির (লেটার অব ক্রেডিট) মাধ্যমে পণ্যটি রফতানি করা হয়।
যদিও ভারতে এই ট্রান্সশিপমেন্ট আমাদের রফতানিখাতের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশের রফতানিকারকরা।
ভারতে রড রপ্তানির অন্যতম প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম এর ডেপুটি ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, 'হ্যাঁ, এতে আমাদের রফতানির সুযোগ কমে যাবে'।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ত্রিপুরায় দুই হাজার টন রড রফতানি করেছে বাংলাদেশের এই রডশিল্প প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটি বছরে ১৬ লাখ টন রড উৎপাদন করে। সে তুলনায় এই রফতানির পরিমাণ খুবই সামান্য।
তপন সেনগুপ্ত আরও বলেন, ভারতে রড উৎপাদনের কাঁচামাল সহজলভ্য। সেখানে উৎপাদন ব্যয়ও আমাদের দেশের তুলনায় কম। ফলে এখন ত্রিপুরাসহ উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে খুব সহজেই রড ট্রান্সশিপ করে পাঠাতে পারবে দেশটি।