ঢাকায় ট্রাফিক আইন অমান্যে সবার আগে উত্তরা, মামলা কমেছে গুলশানে
২০২১ সাল থেকে গত তিন বছরে রাজধানীতে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের ঘটনা বেড়েছে ২৮ শতাংশ। এই সময়ে প্রায় সব এলাকাতেই ট্রাফিক আইন অমান্যের হার বেড়েছে।
তালিকায় সবার উপরে রয়েছে উত্তরা। গত তিন বছরে ট্রাফিক আইন অমান্যের ঘটনায় এই এলাকায় মামলা বেড়েছে ১৪৭ শতাংশ। তবে, এরমধ্যে ব্যাতিক্রম হলো গুলশান অঞ্চল। এখানে আইন অমান্যের হার ১১ শতাংশ কমেছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের গত তিন বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য পুরো শহরকে মোট ৮টি জোনে ভাগ করেছে ডিএমপি— গুলশান, মিরপুর, তেজগাঁও, রমনা, লালবাগ, ওয়ারী এবং মতিঝিল।
মামলার সংখ্যায় এগিয়ে উত্তরা, কমেছে গুলশানে
উত্তরা অঞ্চলে ২০২১ সালে ট্রাফিক আইনে মামলা হয় ১৪,৩৭৮টি। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে ২০২৩ সালে এই সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৩৫,৫৫৫টিতে। মতিঝিল অঞ্চলেও মামলা বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। এরপরে রয়েছে যথাক্রমে— তেজগাঁও, লালবাগ, রমনা ও মিরপুর। তালিকার সবার নিচে রয়েছে ওয়ারী অঞ্চল; এখানে মামলা বেড়েছে মাত্র ৫ শতাংশ।
মামলা বৃদ্ধির হারের বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাফিক উত্তরা অঞ্চলের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার কামারুজ্জামান বলেন, "করোনার সময় মানুষের চলাচল কম ছিল। তাই মামলাও হয়েছে কম। এছাড়া, এই এলাকায় দ্রুততার সাথে নগরায়ন বাড়ছে। যার ফলে মানুষের যাতায়াতও আগের তুলনা অনেক বেশি। এ কারণে মামলা সংখ্যা বেড়েছে।"
ঢাকা শহরের মধ্যে একমাত্র গুলশান এলাকায় ট্রাফিক আইন অমান্যের ঘটনায় মামলার হার কমেছে। ২০২১ সালে এখানে মামলা হয়েছিল ৩৪,৪৩০ টি। দুই বছরের ব্যবধানে ২০২৩ সালে মামলা হয় ৩০,৭৯০টি। ভিআইপি এরিয়া হিসাবে পরিচিত এই অঞ্চলে মামলা কমেছে ১১ শতাংশ। ঢাকা শহরের একমাত্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন (এআই) সিগন্যাল সিস্টমও এই এলাকাতেই চালু রয়েছে।
গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার আব্দুল মোমিন বলেন, "এই এলাকায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেশি। এখাকার মানুষ ট্রাফিক আইনের বিষয়ে সচেতন। তাছাড়া, ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে সচেতনতা বৃদ্ধিতেও কাজ করা হয়। তাই এখানে ট্রাফিক আইন অমান্যের পরিমাণ কম।"
তবে নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, "গুলশান এরিয়াতে তবে মামলার সংখ্যা কমেছে ঠিকই, কিন্তু ট্রাফিক আইন অমান্যের ঘটনা কমেনি। অনেক সময় দেখা যায়, ট্রাফিক আইন ভঙ্গের কারণে গাড়ি আটকানো হলেও, বড় অফিসার দিয়ে সুপারিশ করা হয়। কোনো ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশকেই তার ঊর্ধ্বতনদের কাছে কথা শুনতে হয়। এসব কারণে অনেক সময় আইন অমান্য করলেও ট্রাফিক পুলিশরা মামলা দেন না।"
মামলা বেশি তেজগাঁওয়ে, কম মতিঝিলে
২০২৩ সালে রাজধানীতে ট্রাফিক আইন অমান্যের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩,২৭,৫২২টি। এরমধ্যে তেজগাঁও অঞ্চলে ৬৫,৬৩৭টি মামলা হয়েছ। এছাড়া, এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মিরপুরে; এ অঞ্চলে মামলা হয়েছে ৪৯,৯০২টি। তৃতীয় স্থানে আছে রমনা, যেখানে মামলার সংখ্যা ৪২,৩৪০টি।
সবচেয়ে কম ট্রাফিক আইন অমান্যের ঘটনা ঘটেছে মতিঝিল এলাকায়। এখানে মামলা হয়েছে ২৯,৬২৬টি। এসব মামলা বাবদ ৭২ কোটি ৭ লাখ ২৩ হাজার ৯৬৩ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ট্রাফিক আইন অনুযায়ী— লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি, ভুয়া লাইসেন্স, রেজিস্টেশনবিহীন গাড়ি, ট্রাফিক সংকেত অমান্য, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো, অবৈধ পার্কিং, উল্টো পথে চালানো, যত্রতত্র ইউটান নেওয়া, সিটবেল্ট না বাঁধা, হেলমেট ব্যবহার না করা, চলন্ত গাড়িতে চালক ফোনে কথা বলা, সড়কে প্রকাশ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিসহ বেশ কয়েকটি কারণে জরিমানা করে ট্রাফিক পুলিশ।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক অ্যাডমিন অ্যান্ড রিসার্চ) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, "ঢাকা শহরে অধিকাংশ মামলা হয় ট্রাফিক আইনের ৯২ ধারায়। এই ধারায় প্রথমবার সর্বনিম্ন ১০০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৩০০০ টাকা জরিমানা করা হয়। পরবর্তীতে দ্বিগুণ হারে জরিমানা আদায় করা হয়।"
জরিমানার হার বেশি ওয়ারিতে, মতিঝিলে কম
ডিএমপির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মামলা প্রতি জরিমানার হার বেশি ওয়ারি এলাকায়। এখানে প্রতি মামলায় গড়ে ২,৩২৮ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর পরেই রয়েছে রমনা ও গুলশান এরিয়া; যথাক্রমে মামলা প্রতি ২,২৯৬ ও ২,২৪৩ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
অন্যদিকে, মামলা প্রতি জরিমানার হার সবচেয়ে কম মতিঝিল এলাকায়। গত বছর এই বিভাগে মামলা হয়েছে ২৯,৬২৬টি। এসব মামলায় ৫ কোটি ৮৩ লাখ ৫০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। গড় মামলায় জরিমানা করা হয়েছে ১,৯৭০ টাকা করে।
এদিকে, তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে— মামলা প্রতি জরিমানার হার যেসব অঞ্চলে বেশি, সেখানে ট্রাফিক আইন অমান্যের হার অপেক্ষাকৃত কম। অন্যদিকে, যে অঞ্চলে জরিমানার হার অপেক্ষকৃত কম, সেখানে আইন অমান্যের হার বেশি।
জানতে চাইলে ওয়ারী অঞ্চল ট্রাফিক পুলিশের সহকারী কমিশনা মো. কপিল বলেন, "শাস্তির সঙ্গে অপরাধের একটা সম্পর্ক রয়েছে। তবে আমরা ডিসি মহোদয়ের নির্দেশে এই অঞ্চলের পুরো ট্রাফিক ব্যবস্থাকে একটি নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা করছি। যার কারণে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের হার কম।"
এছাড়া, সার্বিক বিষয়ে জানতে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানকে মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।