মেশিনারি, যানবাহন আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারাতে পারেন ইপিজেড বিনিয়োগকারীরা
কয়েক দশক ধরে শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করছেন দেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) এবং হাই-টেক পার্কের বিনিয়োগকারীরা। এবার তাদের মূলধনী যন্ত্রপাতি, যানবাহন ও আসবাবপত্র আমদানির ওপর শুল্ক আরোপের কথা বিবেচনা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এনবিআর-এর রাজস্ব নীতি প্রণয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এ পদক্ষেপের লক্ষ্য এসব বিশেষায়িত অঞ্চলের বাইরের বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ব্যবসায়িক পরিবেশের ভারসাম্য তৈরি করা এবং এসব অঞ্চলে পাওয়া সুবিধার অপব্যবহার রোধ করা।
রাজস্ব কর্তৃপক্ষ ইপিজেড এবং হাই-টেক পার্কগুলোতে বিনিয়োগকারীদের আমদানি করা খুচরা যন্ত্রাংশ — বিশেষ করে যেসব যন্ত্রাংশ ইতোমধ্যে স্থানীয়ভাবে তৈরি হচ্ছে — সেগুলোর ওপর শুল্ক বাড়ানোরও পরিকল্পনা করছে।
'আমরা ইপিজেডের ভেতরে এবং বাইরে বিনিয়োগকারীদের জন্য আমদানি শুল্ক সমান করতে চাই। এ লক্ষ্যে বর্তমানে শুল্কমুক্ত সুবিধা রয়েছে এমন যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করতে পারে এনবিআর,' নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন এনবিআর-এর একজন কর্মকর্তা।
'আমরা বর্তমানে শুল্কছাড়ের সুবিধা পাওয়া কিছু সরঞ্জাম এবং খুচরা যন্ত্রাংশের ওপর আমদানি শুল্ক বাড়ানোর কথা বিবেচনা করছি। এছাড়া আমরা ইপিজেড অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের জন্য যানবাহনের ওপর আমদানি শুল্ক চালুর পরিকল্পনা করছি,' তিনি বলেন।
তবে এ কর্মকর্তা প্রস্তাবিত বা বর্ধিত শুল্কের পরিমাণ উল্লেখ করতে রাজি হননি।
এনবিআর-এর সূত্রের ইঙ্গিত অনুযায়ী, ইপিজেডে বিনিয়োগকারীদের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর প্রায় ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হতে পারে। আর খুচরা যন্ত্রাংশ, সরঞ্জাম এবং আসবাবপত্রের শুল্ক ১ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়াও যানবাহন আমদানির জন্য আমদানি শুল্ক বিপুল হারে বাড়তে পারে। এ বৃদ্ধি সম্ভাব্য ৮০০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
'এসব ব্যবস্থা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত কেবল রাজস্ব নিয়ে উদ্বেগের ওপর ভিত্তি করে ছিল না। আমরা অন্যান্য বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রতিষ্ঠার এবং শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহার মোকাবিলা করার গুরুত্বও বিবেচনায় নিয়েছি,' বলেন ওই কর্মকর্তা।
ইপিজেড ও হাই-টেক পার্কগুলোতে শুল্কমুক্ত সুবিধার ব্যাপক অপব্যবহার হচ্ছে বলে নানা সময়ে বিভিন্ন অভিযোগের কথা জানা গিয়েছে।
গত বছর এক বাজেট আলোচনার সময় এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, 'কর সুবিধার কারণে অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদন করা সম্ভব এমন পণ্যের আমদানির ওপর এখনও অতিরিক্ত নির্ভরতা রয়েছে। স্থানীয় শিল্পের বিকাশকেও আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।'
এসব সুবিধা কমিয়ে আনার ইঙ্গিত দিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, 'আমরা সুবিধাসমূহ পুনরায় মূল্যায়ন করব এবং সেগুলো আরও কঠোর করব। আমরা আর অফিস স্টেশনারি ও চেয়ারের মতো জিনিসপত্র আমদানির সুবিধা দেব না। শুল্কমুক্ত সুবিধা নিয়ে বিদেশ থেকে কাঠের চেয়ারও কেন আমদানি করতে হবে?'
উদ্বেগ প্রকাশ বিনিয়োগকারীদের
তবে বিনিয়োগকারীরা এনবিআরের নতুন এ পদ্ধতির জেরে বিনিয়োগের জন্য ইপিজেড বেছে নেওয়ার কারণ মূল্যহীন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ঢাকা ইপিজেডে অবস্থিত টেক্সটাইল কারখানা শাশা ডেনিমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ টিবিএসকে বলেন, 'যদি বিদ্যমান শুল্ক ও কর সুবিধা কমানো হয়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের প্রতিশ্রুতি থেকে পিছিয়ে যেতে পারেন।'
'বিনিয়োগকারীরা যখন প্রাথমিকভাবে ইপিজেডে বিনিয়োগ করতে এসেছিলেন, তখন তাদের এসব সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। যদি সুবিধাগুলোর কোনোটা হঠাৎ করে প্রত্যাহার করা বা কমানো হয়, তাহলে তা বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারানোর কারণ হতে পারে,' তিনি বলেন।
'এটা কেবল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রভাবিত করবে না, বরং স্থানীয় বিনিয়োগকেও বাধাগ্রস্ত করতে পারে। ইতোমধ্যে ইপিজেড বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ছাঁটাই করা হয়েছে,' শামস আরও বলেন।
নন-ইপিজেড ব্যবসায়ীরা স্বাগত জানিয়েছেন
ইপিজেড এলাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত এমবি নিটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'সরকার যদি ইপিজেড এবং নন-ইপিজেড জোনের মধ্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে চায়, তাহলে সে উদ্যোগ প্রশংসনীয়।'
'তবে আমরা আকস্মিকভাবে এবং সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের সঙ্গে আগেভাগে আলোচনা ছাড়াই নেওয়া কোনো সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নই,' বলেন তিনি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট পিআরআই)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, 'ইপিজেডের ভেতরে এবং বাইরের কারখানার মধ্যে আমদানি শুল্কের হার ভিন্ন রাখার কোনো যুক্তি নেই। তবে এসব সুবিধা দেওয়ার আগেই এগুলো বিবেচনা করা উচিত ছিল। আকস্মিক নীতি পরিবর্তন বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করে।'
ইপিজেড বিনিয়োগকারীদের পাওয়া প্রণোদনা
১৯৮৩ সাল থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে কার্যক্রম পরিচালনা করা কারখানাসমূহ শুল্কমুক্ত সুবিধা এবং অন্যান্য সুবিধা ভোগ করে আসছে।
বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) মতে, এসব অঞ্চলের কারখানাগুলো বর্তমানে নির্মাণ সামগ্রী, মেশিনারি, অফিস সরঞ্জাম এবং খুচরা যন্ত্রাংশের শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা পায়। পাশাপাশি এগুলো কাঁচামাল এবং তৈরি পণ্যের শুল্কমুক্ত আমদানি ও রপ্তানি, দ্বৈত করমুক্তি এবং লভ্যাংশ কর থেকে অব্যাহতির সুবিধাও ভোগ করে।
এছাড়া এ কারখানাগুলোর কর অবকাশের সুবিধাও রয়েছেও, যার মাধ্যমে করহার কমানোর সুযোগ পায় এগুলো।
এনবিআরসূত্র এবং বিনিয়োগকারী উভয়ের মতে, ইপিজেডের প্রত্যেক বিনিয়োগকারী — বিদেশি হোক বা যৌথ উদ্যোগের — প্রতিটি গাড়ির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করেন। এছাড়া খুচরা যন্ত্রাংশের জন্য তাদের কম আমদানি শুল্কও দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
একইসঙ্গে তারা দ্বৈত কর থেকে মুক্তি এবং লভ্যাংশ কর থেকে অব্যাহতির সুবিধা লাভ করেন। তারা বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির জন্য জিএসপি [জেনারেলাইজড সিস্টেম অফ প্রেফারেন্স] সুবিধাও পান। তাদের রয়্যালটি, টেকনিক্যাল ও কনসালট্যান্সি ফি'র রেমিট্যান্সও অনুমোদিত।
এসবের পাশাপাশি ইপিজেডের কারখানাগুলোর জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যান্য এলাকার মতো ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়নের এখনও অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
ইপিজেডের একজন বিনিয়োগকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'কিছু সুবিধা কেবল কাগজ-কলমেই আছে, কারণ শুল্ক কর্মকর্তারা শুল্ক সুবিধার জন্য বেপজার সার্টিফিকেশনকে স্বীকৃতি দিতে চান না। ফলে বিনিয়োগকারীরা উচ্চ শুল্ক দিতে বা নির্দিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন চুক্তি করতে বাধ্য হন।'
বেপজার নির্বাহী পরিচালক (বিনিয়োগ প্রচার) মো. তানভীর হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'সরকারের রাজস্ব প্রয়োজন, তা বোঝা যায়। তাই এনবিআরের কিছু সুবিধা কমানোর কথা ভাবা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করলে ভালো হবে।'
বেপজা'র তথ্য অনুসারে, দেশের ৮টি ইপিজেডে প্রায় ৪৫১টি কারখানা উৎপাদনে রয়েছে। এগুলোতে ৩৮টি দেশ থেকে প্রায় আট বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে। এসব কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের।
এ ৪৫১ কারখানার মধ্যে প্রায় ৩০০টি মূলত তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল এবং আনুষাঙ্গিক শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত।
দেশের অন্যতম বিখ্যাত পরিবেশবান্ধব তৈরি পোশাক কারখানা প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক বলেন, 'আমরা ইপিজেডের অভ্যন্তরে এবং বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই অভিন্ন সুবিধার পক্ষে কথা বলি। তবে এটা বিবেচনায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, বাড়তি প্রণোদনা না পেলে বিনিয়োগকারীরা এগুলোতে বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক নাও হতে পারেন।'
কমতে পারে কিছু খাদ্যপণ্যের আমদানি শুল্ক
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বাজারদর স্থিতিশীল রাখতে কিছু খাদ্যপণ্যের — যেমন শিশুখাদ্য যা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় না — ওপর আমদানি শুল্ক কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
এছাড়া এনবিআর-এর লক্ষ্য আমদানিকৃত এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে শুল্কের ব্যবধান কমানো।
'২০২৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ বিবেচনায় শুল্ক যৌক্তিককরণ এবং রপ্তানিবিরোধী পক্ষপাত কমানোর জন্য আমাদের ওপর যথেষ্ট চাপ রয়েছে,' এনবিআর-এর একজন কর্মকর্তা বলেন।
'তাই আমরা আমদানি শুল্ক কমিয়ে অথবা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সমধর্মী পণ্যের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি করে কিছু পণ্যের ওপর বিদ্যমান উচ্চ শুল্ক ব্যারিয়ার কমানোর একটি পরিকল্পনা তৈরি করছি,' তিনি আরও বলেন।
৩৬ লাখ টাকার বেশি আয়ে দিতে হতে পারে ৫ শতাংশ বেশি কর
বর্তমানে ব্যক্তিগত করদাতাদের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হয়। সে অনুযায়ী যাদের আয় সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি তাদেরকে সর্বোচ্চ স্ল্যাবে বা ২৫ শতাংশ কর দিতে হয়।
এনবিআর সূত্রমতে, নতুন পরিকল্পনায় আরও ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ এবং পরবর্তী আয়ের ওপর ৩০ শতাংশ কর দিতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে সাড়ে ৩৬ লাখ টাকার বেশি আয়ের জন্য ৩০ শতাংশ কর দিতে হবে।
এর ফলে প্রায় ৫০ হাজার করদাতা অতিরিক্ত করের আওতায় আসবেন বলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।