জুলাই-ডিসেম্বরে ইপিজেডে বিনিয়োগ ২২.৩৩ শতাংশ কমলেও রপ্তানি বেড়েছে ২২.৪১ শতাংশ
জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে দেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোতে (ইপিজেড) বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ২২.৩৩ শতাংশ কমলেও রপ্তানি ২২.৪১ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা)।
বেপজা'র তথ্য অনুসারে, আলোচ্য সময়ে ইপিজেডগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ কমে ১২৬.৩৩ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে— যা ২০২৩ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ১৬২.৬৬ মিলিয়ন ডলার ছিল।
দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক বাজারে অরাজকতার প্রভাবে এই বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে বলে মনে করছে সরকারি সংস্থাটি।
যদিও এরমধ্যেই ইপিজেডগুলো থেকে রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে ৪.১২ বিলিয়ন ডলার হয়েছে— যা ২০২৩ সালের শেষ ছয় মাসে ৩.৩৭ বিলিয়ন ডলার ছিল।
সোমবার (২৭ জানুয়ারি) রাজধানীর গ্রিন রোড কার্যালয়ে বেপজা আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আবুল কালাম মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান বলেন, "আমাদের বেপজাতে বিনিয়োগ কিছুটা কমেছে, তবে বাইরের তুলনায় এটা অনেক কম।"
তিনি বলেন, "২–৩ দিন আগে বিভিন্ন পত্রিকায় এসেছে আবার ব্যবসায়ীরাও অভিযোগ করেছেন, দেশে সার্বিক বিনিয়োগ ৭১ শতাংশ কমে গেছে। আর এটার আঁচ আমাদের বেপজার ওপরেও পড়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "এটা শুধুমাত্র আমাদের দেশের পটপরিবর্তন বা তার পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য না, বরং পুরো গ্লোবাল মার্কেটেই একটা অরাজকতা চলছে। সুতরাং, বিনিয়োগ কমছে এটা শুধু আমাদের দেশের পরিস্থিতির জন্য না, একটা গ্লোবাল ইমপ্যাক্ট এখানে আছে।"
"বায়ারদের চাহিদা কমে গেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কারণে ইউরোপে গ্যাসের দাম অনেক বেড়ে গেছে। অনেক মধ্যম আয়ের এবং উচ্চ আয়ের যারা ক্রেতা আছেন, তাদের কিছু কিছু জিনিসের চাহিদা কমে যাওয়াতে অর্ডার পাওয়া যাচ্ছে কম।"
"আর যেহেতু অর্ডার কমে যাচ্ছে, সেই কারণে সার্বিকভাবে বিনিয়োগে প্রভাব পড়েছে," যোগ করেন তিনি।
বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান আরও বলেন, "তবে এই যে নিম্নমুখী অবস্থা, এ থেকে আমরা কেটে উঠছি। আমাদের ইপিজেপের ব্যবসায়ীরা যারা আছেন, তাদের সঙ্গে আমরা নিয়মিত কথা বলছি, তারা বলছেন– একটা ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে।"
তিনি বলেন, দেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ইতোমধ্যেই আমাদের কাছে আসতে শুরু করেছেন। কিছু বিদেশি কোম্পানি আমাদের বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রেসিডেন্ট আসায় চীন থেকে সেখানে পণ্য রপ্তানি কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।"
"ফলে এই মার্কিন কোম্পানিগুলো এখন চীনের জায়গায় বাংলাদেশ থেকে পণ্য নেওয়া এবং তাদের স্থাপনা স্থানান্তরের কথা ভাবছে। সম্প্রতি, একটি বিদেশি কোম্পানি ১৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাবও দিয়েছে এবং বিনিয়োগকারীরা সোলার প্যানেলের উপাদান এবং রাসায়নিক দ্রব্য তৈরিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প সরকার ক্ষমতায় এসে চীনের রপ্তানিকৃত পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করায় বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়তে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। তিনি মনে করেন, বাড়তি শুল্ক আরোপের ফলে চীনের কিছু শিল্প-কারখানাগুলো বিভিন্ন দেশে স্থানান্তরিত হবে, যেখানে বাংলাদেশ সবার ওপরে আছে।
আবুল কালাম মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান বলেন, "ট্রাম্পের চীন নীতি, চীনের ব্যপারে তাদের যে আউটলুক আছে– এটা বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে আমাদের দেশে বিনিয়োগ বাড়তে। আমরা যেটা জানতে পারছি, চীনা যে পণ্য আমেরিকার বাজারে যাচ্ছে, ট্রাম্প প্রশাসন চাচ্ছে সেটার ওপর আরও ট্যাক্স বসাতে। আবার চীনে কিন্তু তরুণ জনগোষ্টি কমে গেছে, তাই তাদের ওয়ার্ক ফোর্সও কম। যারা আছেন, তাদের মজুরি অনেক বেশি। ওখানে তাদের খরচ বাড়ছে।"
তিনি বলেন, "পাশাপাশি অতিরিক্ত ট্যাক্স দিতে হলে তাদের যে পণ্য আছে, সেই পণ্যের দাম কিন্তু আমেরিকার বাজারে অনেক বেড়ে যাবে। এর ফলে প্রতিযোগীতায় পিছিয়ে পড়বে তারা। এটা এড়িয়ে যাবার জন্য চীনের কিছু বিনিয়োগকারী চাচ্ছেন চীনের বাইরে তাদের প্রতিষ্ঠান স্থানন্তির করতে। আমরা যে বিভিন্ন সময় বিনিয়োগ সামিট করেছি সেখানে আমরা দেখেছি– চীনা বিনিয়োগকারীর কাছে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, মিয়ানমার, বাংলাদেশ– এই দেশগুলো তাদের তাদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে।"
"এর মধ্যে ১ নম্বরে আছে বাংলাদেশ। আমরা প্রচুর সাড়া পাচ্ছি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে। চীনের বিভিন্ন ফার্ম থেকে বিনিয়োগকারীরা আসছেন। আর এটা যে, শুধু রেডিমেট গার্মেন্টস পণ্য তৈরীতে আসছে তা নয়, অন্য খাতেও আসছে। সোলার প্যানেল তৈরি করার জন্য যে কাঁচামাল, সিলিকন ডাই অক্সাইড, এ ধরনের কাঁচামাল তৈরি করতে বিনিয়োগকারীরা আসছেন। সামনে আবার বিনিয়োগ বাড়বে বলে আশা করি," যোগ করেন তিনি।
মিরসরাইতে পানির চ্যালেঞ্জ
বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে যখন মরিয়া বাংলাদেশ, তখন পানি সংকটের কারণে বেপজা বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে।
চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করছে বেপজা।
এ বিষয়ে বেপজা চেয়ারম্যান বলেন, "দেড় বছর আগে আমাদের কাছে একজন চীনা বিনিয়োগকারী আসেন। ১৩৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব ছিল। আমরা তাদের দুঃখিত করে ফিরিয়ে দিয়েছি। কারণ টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠান করতে যেই ধরনের পানি প্রয়োজন, মিরসরাইতে সেই পরিমাণ পানি দিতে পারবো না। তাই আমরা ফিরিয়ে দিয়েছি। এখনও আমরাদের এখানে পানি পাওয়া চ্যালেঞ্জ।"
তিনি বলেন, "চট্টগ্রামের মিরসরাইতে আমাদের গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যা হবে না, তবে পানির সমস্যা হবে। মিরসরাইতে ৪২টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছি। ২৪৯টি প্লট ইতোমধ্যে বরাদ্দ দিয়েছি। ওখানে যাদের পানির দরকার খুবই কম, তাদেরকে জমি বরাদ্দ দিয়েছি।"
তিনি বলেন, "আমরা মাটির নিচের পানি নেব না। আমরা ৪৫ একর জমিতে লেক খনন করেছি। বর্ষাতে ওখানে পানি জমবে। লেকে বৃষ্টির পানি যাওয়ার জন্য আলাদা নেটওয়ার্ক করেছি। প্রতিষ্ঠানগুলোকে শর্ত দিয়েছি, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য রেইন ওয়াটার হারভেস্ট করতে।"
২০২৪ অর্থবছরে দেশের মোট এফডিআইয়ের ২৯% ইপিজেডে
বেপজার সদস্য (বিনিয়োগ প্রচার) মো: আশরাফুল কবির জানান, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মোট এফডিআইয়ের ২৯% বেপজাতে এসেছে।
৩,৪৪৫ একর (১৩.৯৫ বর্গ কিলোমিটার) জমিতে ৮টি ইপিজেড এবং বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল দেশের মোট ১,৪৬৮.১৭ মিলিয়ন ডলার এফডিআইয়ের মধ্যে ৪২৪.২৯ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে।
২০২৪ সালে ২৮টি দেশি-বিদেশি কোম্পানি বেপজার সাথে ৫৬৮.৪৯ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের চুক্তি সই করেছে। বেপজা এ পর্যন্ত মোট ৬.৯১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে এবং ১১৪.৯১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের রপ্তানি করেছে।