বাবার মতো ট্রাম্পও অন্যের শোক পরোয়া করেন না!
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পিতা ফ্রেড সি. ট্রাম্প ছিলেন এক সফল আবাসন ব্যবসায়ী। তার তৈরি সুউচ্চ আবাসিক ভবনগুলো নিউইয়র্কের ব্রুকলীন এবং কুইন্স এলাকায় আজো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।
মৃত্যুর পর তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান হয়; ম্যানহাটনের ফিফথ এভিন্যিউ এলাকার মার্বেল কলিজিয়েট চার্চে। পরিবারের সদস্যসহ নিউইয়র্কের প্রায় ৬০০ গণ্যমান্য ব্যক্তি সেখানে অংশ নেন। নির্মাণ ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক অনেকেই ছিলেন শোক অনুষ্ঠানে।
সেদিনের শোকাবহ আবহকে আরো ভারি করে তোলে চার্চের বিখ্যাত যাজক নরম্যান ভিনসেন্ট পিয়ালের গুরুগম্ভীর প্রার্থনাপাঠ। এরপর একে একে পিতার স্মরণে প্রশংসাপত্র পাঠ করেন তার চার জীবিত সন্তানের মধ্যে তিনজন। সবার শেষে পালা ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের।
একটু মনোযোগ দিয়ে শুনুন, তার অতীত কথন। কারণ, অতীত আজ ও আগামীর এক জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি। অতীতের দর্পণ আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতকে বোঝার সুযোগ করে দেয়।
আগামীদিনে সবসেরা অর্থনৈতিক ও সামরিক বিশ্বশক্তির সর্বেসর্বা হতে চলা ডোনাল্ড ট্রাম্প তার বক্তব্য শুরু করলেন, নিজেকে নিয়ে কথা শুরুর মাধ্যমে।
১৯৯৯ সালের জুন মাসের সেই দিনে উপস্থিত হিতকামীদের ট্রাম্প জানালেন, নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতায় নিজের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প 'ট্রাম্প প্লেস' নিয়ে এক প্রতিবেদন পড়ার সময়েই, তিনি সে সূত্রে নিজ পিতার মৃত্যু সম্পর্কে জানতে পারেন।
ট্রাম্প নির্মাণ সংস্থার এক সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা অ্যাল্যান মার্কাস সেদিনের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ''ট্রাম্প নিজের বক্তব্য শুরু করেন এভাবে; আমার ক্যারিয়ারের চরম সফলতার বছরটি দারুণ উপভোগ করছিলাম। প্রশান্ত মন নিয়ে সকালের নাস্তা করতে করতে এই ভেবে আত্মতৃপ্তি পাচ্ছিলাম যে, সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছে। আর তখনই বাবার মৃত্যু সংবাদ চোখে পড়লো।''
''ডোনাল্ডের প্রশংসাপত্রের কথাগুলো ছিল শুধু নিজেকে নিয়েই। সেদিন চার্চে উপস্থিত সবাই তা বেশ ভালোই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন'' মন্তব্য প্রাক্তন এ কর্মচারীর।
ট্রাম্প পরিবারের জীবনী লেখক গোয়ান্ডা ব্লেয়ারও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত ছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেদিনের সেই প্রশংসাপত্র তার কাছেও আশ্চর্য ঠেকে। বিস্ময় নিয়েই যা তিনি উল্লেখ করেছেন তার লেখা পারিবারিক ইতিহাসের বই- দ্য ট্রাম্পস- এ।
''এটা কি বিস্ময়কর ছিল?'' নিউ ইয়র্ক টাইমস সাক্ষাৎকার নেওয়ার কালে তাকে জিজ্ঞাসা করে। জবাবে ব্লেয়ার বলেন, ''না, মোটেও নয়। আমি একে হতবাক করে দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করব।''
পরিবারের কোনো সদস্যের মৃত্যুর ঘটনায় হোক বা চলমান মহামারির তাণ্ডবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় দেড় লাখ নাগরিকের মৃত্যু; কোনোকিছুতেই সহমর্মিতা প্রকাশ করেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার শোক নেই মহামারি জনিত মন্দায় কর্মহীন ৩ কোটি নাগরিকের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে। শ্বেতাঙ্গ পুলিশের নির্যাতনের প্রেক্ষিতে শুরু হওয়া বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনকারীদের জন্যেও সহানুভূতি নেই তার মনে। অন্তত, মানুষের দুর্ভোগে আজপর্যন্ত ট্রাম্পকে প্রকাশ্যে শোকাহত হতে দেখেনি কেউ।
চলতি গ্রীষ্মে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে তার ভাতিজি মেরি এল.ট্রাম্পের লেখা বই প্রকাশিত হওয়ার পর, তার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটি নতুন করে আলোচনার পাদপ্রদীপে আসে।
আসবেই বা না কেন! ভাইরাসের তাণ্ডবে প্রাণ হারানো অজস্র নাগরিকের মৃত্যুতে ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করেননি। বরং ব্যস্ত থেকেছেন হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেন প্রাঙ্গণে একের পর এক বিতর্কিত সংবাদ সম্মেলনে অনুষ্ঠানে, নয়তো মহামারির মাঝেও অর্থনীতিকে সচল করার লক্ষ্য নিয়ে শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে।
যেসব পরিবার কর্মহীন হয়ে পড়েছে বা যারা প্রিয়জন হারিয়েছে, তাদের জন্য একখণ্ড অবসর পাননি মার্কিন রাষ্ট্রপতি।
গত চার জুলাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস। সপ্তাহন্তের এদিনে দেওয়া তার বক্তব্য পুরো মার্কিন জাতিকে বিস্মিত করে। বামপন্থি ফ্যাসিবাদ মার্কিন সমাজ ও গণমাধ্যম দখল করে নিচ্ছে বলে, স্বাধীনতা দিবসের দিনে জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। অথচ, যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ ইঙ্গিত। তা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের চলমান বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন। পুলিশি হেফাজতে জর্জ ফ্লয়েডের নির্মম মৃত্যু বা তাকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনকে; ট্রাম্প তার বক্তব্যে একবারও উল্লেখ করেননি। যেমন উল্লেখ করেননি আন্দোলনে অংশ নেওয়া লাখো জনতার বর্ণবাদী বিচার ব্যবস্থা অবসানের ন্যায্য দাবিকে।
এর পেছনে অবশ্য অনেক কারণ আছে। সত্যকে স্বীকার করে নেওয়ার অপারগতা এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় অব্যবস্থাপনা- যার মধ্যে অন্যতম।
বিশেষ করে, ট্রাম্পের অপরিণামদর্শী নীতি ও পরিচালনার কারণেই; যুক্তরাষ্ট্রে মহামারি পরিস্থিতি বিপর্যয়ে রূপ নেয়। একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায়, সঙ্কটের মাত্রা শুধু বাড়তেই থাকে।
কিন্তু, প্রধান কারণ হয়তো তার মানসিক জগতে অন্যের দুর্দশা অনুধাবনের তীব্র অভাব। খোদ তার নিজের দল- রিপাবলিকানদের অনেক প্রভাবশালী সদস্য এ অভিযোগ করে বলেছেন, নিজেকে অন্যের জায়গায় রেখে, তাদের দুঃখকষ্ট অনুধাবন করার অভাবটাই ট্রাম্পের 'থোরাই কেয়ার' স্বভাবের পেছনে প্রধান কারণ।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা জাতীয় সঙ্কটে রাষ্ট্রপ্রধানের লা-পরোয়া স্বভাব। জাতির পাশে থাকতে ট্রাম্পের অনিচ্ছা, অক্ষমতা এবং জাতীয় সঙ্কটে নাগরিকদের সাহস ও উদ্দীপনা জোগানোয় তার নেতৃত্বের ব্যর্থতা; তার মিত্রদের আশ্চর্য করেছে। বাড়িয়ে চলেছে সমালোচকদের নিন্দার ঝুড়ি। এমনকি খোদ তার কার্যালয়- হোয়াইট হাউজের অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাও ট্রাম্পের গতিবিধি নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় এক অবস্থায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার সবচেয়ে স্বাভাবিক কাজটি ডোনাল্ড ট্রাম্প কেন করতে পারেন না- তা নিয়ে তাদের বিস্ময়ের সীমা নেই।
ট্রাম্পের অন্যতম প্রধান মিত্র এবং নিউইয়র্ক রাজ্যের রিপাবলিকান দলের প্রতিনিধি পিটার টি. কিং বলেন, ''তার রাস্ত্রপতিত্বের ধরনটাই আলাদা। তিনি একজন শক্তিশালী ও অনমনীয় নেতা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পছন্দ করেন। এমতাবস্থায় আপনি কোনো দুর্বলতা প্রকাশ করতে পারেন না। দুর্বলতা তাকে কাবু করেছে, এমনটা তিনি কখনোই প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।''
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা, সকল শিশুর অন্তরে:
সারাজীবন ট্রাম্প এই স্বভাবেরই ছিলেন, বলে জানিয়েছেন তার বন্ধু ও স্বজনেরা। তারা জানান, স্বভাবটি তিনি বাড়িতেই রপ্ত করেন, পিতা ফ্রেড সি. ট্রাম্পের কল্যাণে।
ফ্রেড ছিলেন একজন জাত ব্যবসায়ী, কিন্তু পুত্র ডোনাল্ডকে কর্মজীবনে সফল করতে লাখ লাখ ডলার খরচ করেছেন। কঠোর ব্যবসায়ীক প্রতিযোগিতার জগতে পিতার কাছে ট্রাম্পের পাঠ একটি বিষয়; হয় জয়ী হও, নইলে পরাজিত হবে। ফ্রেডের ব্যবসার জগতে; দুঃখ বা শোক প্রকাশ করা ছিল কেবল দুর্বলতার প্রতীক।
''ডোনাল্ড সব কিছুতেই জয়ী হওয়া নিয়ে ভাবতো। আমাকে সব সময় বলতো; কিভাবে জিততে হয়, তা শিখিয়ে আমাকে সাহায্য কর'' বলেছিলেন নিউইয়র্ক মিলিটারি একাডেমীতে ট্রাম্পের প্রাক্তন সহপাঠী জর্জ হোয়াইট।
সহপাঠী ডোনাল্ডের উপর তার পিতা ফ্রেডের গভীর প্রভাবের কথা তুলে ধরে জর্জ বলেন, সামরিক একাডেমিতে থিওডর ডোবাইস নামে আমাদের একজন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ফেরত প্রশিক্ষক ছিলেন। তিনি একবার জর্জকে বলেছিলেন, এর আগে আমি কখনো এমন কোনো ক্যাডেট দেখিনি, যার বাবা ছেলের প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাবার মতো কঠোর।
জর্জ জানান, প্রতি সপ্তাহন্তে ফ্রেড ছেলেকে দেখতে আসতেন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে সার্বক্ষণিক নজর রাখতেন।
ম্যানহাটনের একটি আবাসিক এলাকার সভাপতি অ্যান্ড্রু স্টেইন। দীর্ঘদিন ধরেই পেশাগত কারণে তার সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্পর্ক।
স্টেইন বলেন, পিতা এখনও দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। হোয়াইট হাউজে যখন ডোনাল্ডের সঙ্গে দেখা করতে যেতাম এবং যখন আমরা একাকি আলোচনা করতাম, তখন সে মাঝেমাঝেই ছাদের দিকে তাকিয়ে (মৃত পিতাকে) উদ্দেশ্য করে বলতো; ফ্রেড তুমি কি এটা (প্রেসিডেন্ট হওয়াটা) বিশ্বাস করতে পারছ?
মার্কিন দৈনিক দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ট্রাম্পের ২০ জন বন্ধু-স্বজন, রাজনৈতিক মিত্র, প্রশাসনের সদস্য এবং তার সাবেক ও বর্তমান কর্মচারীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এরা সকলেই আজকের দিনের ট্রাম্পের চরিত্রের পেছনে তার পিতার শাসনকে প্রধান পরিচালক বলে অবহিত করেন।
ফ্রেড ট্রাম্পের নিজ সন্তানদের সঙ্গে এই অনুশাসনের সম্পর্ক এবং কিভাবে তা তার দ্বিতীয় সন্তান ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তৈরি করেছে- তা নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে, মেরি ট্রাম্পের লেখা বইয়ে। বইটির ইংরেজি শিরোনামের অর্থ দাঁড়ায়; ''অনেক বেশি এবং কখনই কম নয়: কিভাবে আমার পরিবার পৃথিবীর সবচেয়ে বিপৎজনক মানুষটিকে তৈরি করেছে!''
মেরি ট্রাম্পের ভাতিজি এবং পেশায় একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। তার বইটি ট্রাম্পের বর্তমান আচরণের অতীত অনুঘটক অনুসন্ধানে এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যোগ করে।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে