চীন-তাইওয়ান উত্তেজনার পেছনের কারণ কী?
তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম লাই শপথ নেওয়ার কয়েকদিন পরেই একটি পূর্ণমাত্রার আক্রমণের অনুকরণ করে দ্বীপটিকে ঘিরে বড় সামরিক মহড়া দেওয়া শুরু করেছে চীন। এই মহড়াটি মূলত স্ব-শাসিত তাইওয়ানের ওপর চীনের দাবির বহিঃপ্রকাশ।
বেইজিং তাইওয়ানকে একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ হিসেবে দেখে এবং চীনের অংশ করতে চায়। প্রয়োজনে সামরিক শক্তি প্রয়োগের সম্ভাবনা চীন কখনোই খারিজ করে দেয়নি।
কিন্তু তাইওয়ানের একটি বড় জনসংখ্যা নিজেদেরকে একটি পৃথক রাষ্ট্র মনে করে। তাদের চাওয়া, তাইওয়ান স্থিতাবস্থা বজায় রেখে স্ব-শাসিত প্রদেশ থাকবে। কিন্তু চীনের থেকে আলাদা হবে না অথবা চীনের সাথে যুক্তও হবে না।
চীন ও তাইওয়ানের সম্পর্কের ইতিহাস
তাইওয়ানের প্রথম বসতি স্থাপনকারীরা ছিল অস্ট্রোনেশিয়ান আদিবাসীরা যারা আধুনিক দিনের দক্ষিণ চীন থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়।
চীনা নথিতে প্রথম দ্বীপটির উল্লেখ পাওয়া যায় ২৩৯ খ্রিস্টাব্দে যখন একজন চীনা সম্রাট সেখানে একটি অভিযাত্রী বাহিনী পাঠান। বেইজিং তার তাইওয়ামের ওপর আঞ্চলিক দাবি ফলাতে জন্য এ তথ্য ব্যবহার করে।
সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ডাচ উপনিবেশ থাকার পর তাইওয়ানকে চীনের চিং সাম্রাজ্য শাসন করা শুরু করে। জাপান প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধে জয়লাভের পর টোকিওর কাছে তাইওয়ানকে হস্তান্তর করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান আত্মসমর্পণ করে এবং চীনের কাছ থেকে নেওয়া ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়। পরে তাইওয়ানকে আনুষ্ঠানিকভাবে চীন প্রজাতন্ত্র (আরওসি) অধিগ্রহণ করে এবং তৎকালীন মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের সম্মতিতে শাসন করতে শুরু করে।
কিন্তু পরের কয়েক বছরে চীনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং তৎকালীন নেতা চিয়াং কাই শেকের সৈন্যরা মাও সেতুং-এর কমিউনিস্ট সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়।
চিয়াং তার কুওমিনতাং (কেএমটি) সরকারের বাকি সদস্যরা এবং তাদের সমর্থকরা (প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষ) ১৯৪৯ সালে তাইওয়ানে পালিয়ে যায়।
চিয়াং একটি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তাইওয়ান শাসন করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর তাইওয়ানে গণতন্ত্র শুরু হয় এবং ১৯৯৬ সালে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
তাইওয়ানকে কারা স্বীকৃতি দিয়েছে?
তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
তাওয়ানের নিজস্ব সংবিধান, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতা এবং সশস্ত্র বাহিনীতে প্রায় ৩ লাখ সক্রিয় সৈন্য রয়েছে।
নির্বাসিত চিয়াং এর আরওসি সরকার প্রথমে সমস্ত চীনের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি করেছিল এবং এটি পুনরায় দখল করতে চেয়েছিল। আরওসি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চীনের প্রতিনিধিত্ব করেছে এবং অনেক পশ্চিমা দেশ দ্বারা একমাত্র চীনা সরকার হিসেবে স্বীকৃত ছিল।
কিন্তু ১৯৭০ এর দশকে কিছু দেশ বিতর্ক করতে শুরু করে যে তাইপেই সরকারকে আর চীনের মূল ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত না।
১৯৭১ সালে জাতিসংঘ বেইজিংকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়। তারপর ১৯৭৮ সাল থেকে চীনের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হওয়া শুরু করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যের সুযোগ ও সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বেইজিংয়ের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।
তারপর থেকে আরওসি সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এমন দেশের সংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। মাত্র ১২টি দেশ বর্তমানে দ্বীপটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাইওয়ানকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য চীন অন্যান্য দেশের ওপর যথেষ্ট কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে।
চীন এবং তাইওয়ানের সম্পর্ক কেমন?
১৯৮০ এর দশকে চীন ও তাইওয়ানের সম্পর্ক ভালো হতে শুরু করে কারণ তাইওয়ান চীন সফর এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ম শিথিল করে। ১৯৯১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সাথে যুদ্ধ শেষ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল আরওসি।
চীন তথাকথিত 'এক দেশ, দুই ব্যবস্থা' প্রস্তাব করতে যেটিতে বলা হয়েছিল, তাইওয়ানকে স্বায়ত্তশাসনের অনুমতি দেওয়া হবে যদি এটি বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণে আসতে রাজি হয়।
এই ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করেই ১৯৯৭ সালে চীন হংকংকে বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে অধিগ্রহণ করে এবং এখন পর্যন্ত এ ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করেই হংকং চীনের দখলে আছে। একই পদ্ধতিতে তাইওয়ান অধিগ্রহণ করতে চেয়েছিল চীন।
তাইওয়ান চিনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং বেইজিংকে তাইওয়ানের আরওসি সরকার অবৈধ বলে দাবি করে। তবে চীন এবং তাইওয়ানের অনানুষ্ঠানিক প্রতিনিধিরা এখনও নিজেদের মধ্যে সীমিত পরিসরে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
তারপর ২০০০ সালে তাইওয়ান চেন শুই-বিয়ানকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করে যা বেইজিং-এর জন্য আশঙ্কার কারণ ছিল।
চেন এবং তার দল ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি (ডিপিপি) তাইওয়ানের "স্বাধীনতা" কে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছিল।
২০০৪ সালে চেন পুনঃনির্বাচিত হওয়ার এক বছর পর চীন একটি তথাকথিত 'বিচ্ছিন্নতা বিরোধী আইন' পাস করে যেটিতে বলা হয়, তাইওয়ান চীন থেকে 'বিচ্ছিন্ন' হওয়ার চেষ্টা করলে তাইওয়ানের বিরুদ্ধে 'অশান্তিপূর্ণ উপায়' ব্যবহার করার অধিকার চীনের থাকবে।
চেন এর পর কেএমটি তাইওয়ানের ক্ষমতায় আসে এবং চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখার পক্ষপাতী ছিল।
২০১৬ সালে ডিপিপি থেকে সাই ইং ওয়েন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন। তার অধীনে চিন ও তাইওয়ানের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। সাই ইং দায়িত্ব নেওয়ার পরে চীন তাইওয়ানের সাথে সরকারি যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। কারণ হিসেবে চীন বলেছিল, তাইওয়ান একক চীনা জাতির ধারণাকে সমর্থন করতে অস্বীকার করেছে।
সাই ইং কখনও বলেননি যে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে তাইওয়ানের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। তিনি সবসময় জোর দিয়ে বলেছেন যে এটি ইতোমধ্যেই স্বাধীন।
সাই ইয়ং এবং শি জিনপিং এর মেয়াদ কাছাকাছি সময়েই ছিল। সে সময় তাইওয়ানের ওপর চীনের দাবি আরো আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। শি জিনপিং বলেছিলেন, চীন তাইওয়ানের সাথে "অবশ্যই পুনরায় একত্রিত হবে" এবং "চীনা স্বপ্ন অর্জনের" লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে তিনি ২০৪৯ সালকে নির্ধারণ করেন।
২০২৪ সালের জানুয়ারীতে তাইওয়ানে সাই ইয়ং এর ভাইস প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম লাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। চীন তাকে 'বিচ্ছিন্নতাবাদী' হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
বৃহস্পতিবারের (২৩ মে) মহড়া লাইকের দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম সপ্তাহেই হয়েছে। বেইজিং এটিকে 'বিচ্ছিন্নতাবাদী কাজের' জন্য 'কঠোর শাস্তি' হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে এবং লাইকে এখন পর্যন্ত 'সবচেয়ে বাজে' ডিপিপি প্রেসিডেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
চীন ও তাইওয়ানের সম্পর্কের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা কতটুকু?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেইজিংয়ের সাথে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রাখে এবং "এক চীন নীতি" এর অধীনে এটিকে একমাত্র চীনা সরকার হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এটি তাইওয়ানকেও আন্তর্জাতিক সমর্থন দেয়।
ওয়াশিংটন তাইওয়ানকে প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র সরবরাহ করতে আইন দ্বারা আবদ্ধ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে সামরিকভাবে রক্ষা করবে।
দ্বীপটি দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন-চীন সম্পর্কের সবচেয়ে বিতর্কিত সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বেইজিং তাইপেইয়ের প্রতি ওয়াশিংটনের সমর্থনের নিন্দা জানিয়েছে।
২০২২ সালে মার্কিন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের পরে চীন অভূতপূর্ব শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানায় এবং তাইওয়ানের চারপাশে সামরিক মহড়া চালায়।
২০২২ সাল থেকে তাইওয়ানের এয়ার ডিফেন্স আইডেন্টিফিকেশন জোনে (এডিআইজেড) চীনের যুদ্ধ বিমানের অনুপ্রবেশ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়