'কে আমি', এক দাস সন্তানের পরিচয়ের খোঁজে
একটা ফটোগ্রাফ থেকে নাসিরের কাহিনী শুরু হয়। উনবিংশ শতকের একজন মানুষের ফটোগ্রাফ, যিনি দেখতে হুবহু মালিক-আল-নাসিরের মত। সেই ফটোগ্রাফের সাথে যুক্ত হয় আরো কয়েকটি সুত্র এবং তা ধরেই নাসির খুঁজতে শুরু করেন তাঁর পরিবারের শেকড়।
টিভিতে কালো ফুটবল খেলোয়াড়দের উপর একটা তথ্যচিত্র দেখছিলেন নাসির। বিগত একশ বছরে কৃষ্ণকায় ফুটবলারদের উপর তথ্যচিত্র। যেহেতু কালোদের নিয়ে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য কাজ হয়নি নাসির তাই মনোযোগ দিয়ে বিবিসির অনুষ্ঠানটি দেখছিলেন।
হঠাৎ একটা মুখ তাঁকে ভীষণ ভাবে চমকে দেয় নাসিরকে। একজন ভিক্টোরিয়ান ফুটবল খেলোয়াড়। খুব সাবলীল যার ভঙ্গী, একেবারে জড়তাহীন। কোন কিছুর পরোয়া করে না এমন। কালো কিন্তু খাঁটি ব্রিটিশ ভদ্রলোক যেনো।
তিনি হলেন এণ্ড্রু ওয়াটসন। মালিক-আল-নাসির মুসলিম হওয়ার আগে ছিলেন মার্ক ওয়াটসন। এর মানে একই পদবী যা নাসির পেয়েছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। এন্ড্রু ওয়াটসনের মত নাসিরের বাবাও এসেছিলেন গায়ানার দিমেরারা থেকে।
তথ্যচিত্রটিতে এণ্ড্রু ওয়াটসনের কিশোর বয়সের একটি ছবি দেখতে পাওয়া যায়। সেই সময়টাতে এণ্ড্রু ওয়াটসন হ্যালিফেক্সের গ্রামার স্কুলের ছাত্র ছিলেন। নাসিরের মায়ের টিভি সেটের উপরে একই বয়সের একটা ছবি ছিল যেটা হুবহু এণ্ড্রু ওয়াটসনের মত। নাসির হত-বিহ্বল হয়ে টিভিতে চোখ আটকে রাখেন। মিনিট খানিক পরেই নাসিরের মা তাঁকে ফোন করে একই কথা বলেন।
এণ্ড্রু ওয়াটসন ১৮৫৬ সালে দিমেরারা'য় জন্মেছিলেন। বেশ ধনী পরিবারে জন্মানো এণ্ড্রু প্রাইভেট স্কুলে বেশ ভালো শিক্ষা পেয়েছিলেন। তিনি গ্লাসগো, লিভারপুল এবং লন্ডন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।
ঊনবিংশ শতকে এণ্ড্রু ওয়াটসন একজন গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলার ছিলেন। ১৮৮০র দশকে তিনি কুইন্স পার্কের হয়ে খেলেছিলেন। তিন-তিনটে স্কটিশ কাপ জেতার নায়ক ছিলেন তিনি। সে সময়ে কুইন্স পার্ক বিশ্বের বৃহৎ ক্লাব গুলোর একটা ছিল। এণ্ড্রু স্কটল্যান্ডের হয়ে তিনটি আন্তর্জাতিক ম্যাচও খেলেন। তাঁকে দলের অনুপ্রেরণা বলা হতো। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৬-১ গোলে জেতা ম্যাচে তিনি জাতীয় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
এন্ড্রু ওয়াটসন দেখতে একদম নাসিরের মত হলেও তাঁর জীবন নাসিরের জীবন থেকে একদম ভিন্ন।
স্কুল পড়াকালীন সময়ে নাসির প্রথমবারের মত বর্ণবাদের শিকার হন। এটা ছিল ১৯৭২ সাল। তখন নাসিরের বয়স ছয় বছর। তিনি স্কুলের এ্যসেমব্লির জন্য বসে ছিলেন। প্রধান শিক্ষক তখন একটা টেপ বাজিয়ে গল্প শোনাচ্ছিলেন। গল্পটার নাম ছিল, "ছোট্ট কালো স্যাম্বোর গল্প"। সকালের সেই এ্যসেমব্লিতে নাসির উচ্চশব্দে আপত্তিকর সব লাইন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলেন। অন্য বাচ্চারা তাঁর দিকে তাকিয়ে হা হা করে হেসে গড়িয়ে পড়ছিল।
সেই মুহূর্তে নাসিরের মনে হয়েছিল, 'আমি কেউ না, আমার কোন অস্তিত্ব নেই। আমি নিতান্ত একটা দূর্ঘটনা।' কিন্তু তাঁকে এটাও বোঝানো হয়েছিল যে তাঁর এসবে মন খারাপ করা যাবে না। এতে আপত্তিকর কিছু নেই কারণ তাঁদের শিক্ষকেরা এসব বাজিয়েছিলেন এবং শিক্ষকরা ভুল করতে পারেন না।
ইংল্যান্ডে সত্তুর দশকে বর্ণ বৈষম্য ছিল প্রকট, কিন্তু সেটাকে স্বাভাবিক ঘটনা বলে গণ্য করা হতো। বিভিন্ন বইয়ের নামেও বর্ণ বৈষম্য স্পষ্ট ছিল কিন্তু সেটা নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা ছিল না। যেমন- "টেন লিট্যল নিগার বয়েজ" অথবা "দ্য প্রাউড গালিওয়াগ"। কারো কাছেই এটাকে সমস্যা মনে হতো না।
সেই ভয়াবহ সময়টাতে নাসির দরিদ্র শহরতলীতে বাস করতেন এবং সব সময় কোন না কোন ভাবে বর্ণবাদের মুখোমুখি হতেন। কখনো ক্লাশরুমে, কখনো বন্ধুদের দ্বারা, আবার নিজের গৃহে টেলিভিশনে। সব জায়গায় তিনি বর্ণবাদের অস্তিত্ব অনুভব করতেন।
প্রায় প্রতিদিন তাঁকে স্কুলে এবং স্কুলের বাইরে মারামারি করতে হতো। সুযোগ পেলেই তাকে আঘাত করতো অন্যরা। আবার সেই মারামারির দায়ও তাঁর কাঁধে চাপানো হত। তাঁকে দোষী হিসেবে শাস্তি দেয়া হতো আর শিক্ষকরাও তাতে ঘি ঢালতো।
এভাবে নাসিরের জীবন ধীরে ধীরে দুর্বিষহ হয়ে উঠতে থাকে। ১৯৭৪ এর ক্রিসমাসে নাসিরের বাবার স্ট্রোক করে। স্ট্রোক করার পর তার বাবার শরীর অবশ হয়ে যায় এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁকে হাসপাতালেই থাকতে হয়।
নাসিরের মা ছিলেন একজন শ্বেতাঙ্গ নারী। তাঁর বাবার মৃত্যুর পর তাঁর মাকে চারজন কৃষ্ণ বর্ণের সন্তান নিয়ে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। দরিদ্র শ্বেতাঙ্গ পাড়ায় তিনি খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না কেননা তাঁকে সর্বক্ষণ বর্ণবাদের কোন না কোন ঘটনা মোকাবেলা করতে হচ্ছিল। তিনি সবসময় সবখানে বৈষম্যের শিকার হচ্ছিলেন।
নাসিরের মা মানসিক ভাবে খুব দৃঢ়চেতা ছিলেন, তবুও বর্ণবাদের বিষাক্ত ছোবল থেকে তিনি তাঁকে আর তাঁর সন্তানদের রক্ষা করতে পারেননি। আট বছর বয়সে নাসিরকে বিদ্যালয় থেকে বের করে দেয়া হয় এবং সংশোধনের জন্য নেয়া হয়। এতে ছিল বর্ণবাদের সরাসরি প্রভাব।
সেদিনের রাতটা নাসির কোনদিন ভুলেননি। সেটা ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে পীড়াদায়ক ঘটনা। তার কাপড়-চোপড় খুলে নেয়া হয়েছিল। এরপর তাকে ভালো করে পরিস্কার করে একটা আলাদা রুমে বন্দি করা হয়েছিল।
চৌদ্দ দিন তাঁকে সেখানে বন্দি রাখা হয়েছিল এবং সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। কেউ তার সাথে কথা বলতে পারতো না। একটা ফুটো দিয়ে তার খাবার ঠেলে ভেতরে পাঠিয়ে দেয়া হতো। জেলে কয়েদিদের যেভাবে রাখা হতো ঠিক সেভাবেই তাকে রাখা হয়েছিল।
যেখানে নাসিরকে বন্দী করা হয়েছিল তার নাম লিভারপুল চিলড্রেন এডমিশন ইউনিট। এটা ছিল উলটনের আর্কফিল্ড রোডে। এই কুখ্যাত সংশোধন আশ্রমটি ভাগ্যিস এখন ভেঙে ফেলা হয়েছে। এই বাড়িটি ছিল পুরোনো ভিক্টোরিয়ান আমলের ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি ভবন।
এই বাড়িটার পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন এ্যডামস ফ্যামিলি'র গোমেজের মত দেখতে একজন মানুষ। তার অফিসে একটা ময়না পাখি ছিল, মস্ত-বড় কালো ময়না। সারাক্ষণ কথা বলতো। জায়গাটা ছিল স্যাঁতস্যাঁতে এবং দূর্গন্ধময়। দেয়ালগুলো থেকে খসে পড়েছিল পলেস্তরা। বড় হল রুমের বিশাল বিশাল ব্লকগুলো খুলে পড়েছিল। সেই ফুটোগুলো এতো বড় ছিল যে ছোট বাচ্চারা অনায়াসে সেখানে সেঁটে যেতে পারতো।
নাসির এক ঘর থেকে অন্য ঘরে বদলি হতে থাকে। সব জায়গায় তিনি শারিরীক ভাবে নির্যাতন এবং বর্ণ-বিদ্বেষের শিকার হয়েছিলেন। বেশির ভাগ সংশোধন আশ্রমগুলোতে শিশুদের নির্যাতন করা হতো, কিন্তু এর বিরুদ্ধে কারো কিছু বলার ছিল না। কারণ সমাজকর্মীদের আবার এই রিপোর্টগুলো তারাই লিখতেন যারা অত্যাচার করতেন। তাই নির্যাতনের ব্যাপারটা অপ্রকাশিতই থাকতো। শিশুদের দিয়ে এসব আশ্রমে জোর করে কাজ করানো হতো।
প্রাইমারী স্কুল থেকে আঠারো মাস নাসিরের হারিয়ে গিয়েছিল। দু'বছরেরও কম সময় তিনি পেয়েছিলেন মাধ্যমিকে। তাঁকে ম্যানচেস্টারের একটা বর্বর স্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা করতে হয়েছিল। এই স্কুলেই মেরে তাঁর দাঁত ফেলে দেয়া হয়েছিল। ছুরির আঘাতও খেতে হয়েছে এখানে।
১৯৮৪ সালে সংশোধনের এই শিকল থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স আঠারো। পুরোপুরি শিক্ষিতও হতে পারেননি। গৃহহীন কালোদের জন্য নির্ধারিত একটা হস্টেলে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হলো।
একটা চাকুরি পাওয়ার মত শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি তিনি, তার নামে একটা কানাকড়িও ছিল না কোথাও। বর্ণবাদের চরম উত্তেজনাময় সময়টাতে তিনি একা একা রাস্তায়। টক্সটেথ দাঙ্গার স্মৃতি তখনো দগদগে। সেই দিশেহারা সময়টাতে নাসির তাঁর পরিচয় ভুলে গিয়েছিলেন— তিনি কে, কোথা থেকে এসেছেন আর তার দ্বারা কী হবে— কিছুই তিনি জানেন না। সে বছরই তাঁর জীবনে একটু একটু করে পরিবর্তন আসতে থাকে।
গিল স্কট-হেরন, সংগীত শিল্পী, কবি এবং মানবাধিকার কর্মী, "দ্য রেভ্যুলেশ্যন উইল নট বি টেলিভাইসড" এবং "আই থিংক আই'ল কল ইট মর্নিং' গানের লেখক। তিনি তখন লিভারপুলে। সেখানে তিনি পারফর্ম করবেন। নাসির এটা জেনে, রয়্যাল কোর্ট থিয়েটারে কোনভাবে চেষ্টাচরিত্র করে প্রবেশ করেন।
তিনি যখন রয়্যাল থিয়েটারের ভেতরে ঢুকেন তখন স্টেজে গিল স্কট-হেরন তৈরি। অন্যরকম এক পরিবেশ। দর্শক-স্রোতার সাথে শিল্পীর অপরূপ এক সম্মিলন। চারিদিক যেনো বিদ্যুতের তরঙ্গ প্রবাহিত হচ্ছে। সকলেই তরঙ্গায়িত। গান শেষ হলে নাসির কোন ভাবে স্টেজের পেছনে প্রবেশ করে গিলের সাথে কথা বলেন। সেটাই তাঁর ভাগ্য বদলে দেয়। গিল নাসিরের মেন্টরে পরিণত হন। পুরোপুরি বদলে দেন নাসিরের জীবন। তিনি প্রবেশ করেন নতুন এক জীবনে।
ইংল্যান্ডে গিলের প্রতিটা ট্যুরে নাসির সঙ্গী হতে থাকেন। ড্রাম সেট করা শিখে নিয়েছিলেন। তিনি কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে হিসাবপাতি রাখাসহ সব ধরনের কাজ করতেন। ধীরে ধীরে তিনি দলের অপরিহার্য একজন হয়ে উঠেন। গিল সবসময় নাসিরকে লিখতে উৎসাহিত করতেন।
নাসির কবিতা লিখতে শুরু করেন। কবিতা হয়ে উঠে তাঁর আশ্রয়। অতীতের সকল বেদনা ভুলতে কবিতা তাঁকে সাহায্য করে। কবিতা তাঁকে সুস্থ করে তুলে।
এই সময়ে একটা প্রশ্ন নাসিরকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে থাকে, তাঁর অতীত ইতিহাস। তিনি যতটুকু জানতেন বা ধারনা করতেন, তাঁর পূর্ব পুরুষরা সম্ভবত দাস ছিলেন। নাসির ভাইকিংদের কথা জানতেন, রোমানদের কথা জানতেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে জানতেন, সম্রাটদের বিশাল সাম্রাজ্যের কথা জানতেন। কিন্তু কালোদের সম্পর্কে যা জানতেন তা হল, কালোরা সবসময় বর্বর চরিত্রের। চালের প্যাকেটের উপর আঙ্কেল বেন অথবা মার্মালেড জারে গালিওয়াগ। কালোদের কোন গৌরবের ইতিহাস কোথাও দেখা যেতো না।
এণ্ড্রু ওয়াটসনকে নাসির প্রথম একটা গৌরবান্বিত চরিত্র হিসেবে দেখতে পান। তাঁকেই প্রথম কালোদের রোল মডেল হিসেবে পান। তাই তিনি তাঁর সম্পর্কে জানতে চান। প্রথমেই তিনি দু'টো আলাদা ফ্যামিলি-ট্রি বা পরিবার বৃক্ষ তৈরি করেন। একটা এণ্ড্রু ওয়াটসনের আরেকটা নাসিরের নিজের।
এণ্ড্রু ওয়াটসনের বিয়ের সার্টিফিকেট থেকে তাঁর বাবার নাম পাওয়া যায়। তিনি পিটার মিলার ওয়াটসন। পিটারের কাজের পদবী ছিল "চিনি চাষী"। ১৮০৫ সালে উত্তর স্কটল্যান্ডের এক অবস্থাপন্ন গৃহে তাঁর জন্ম। ১৮৩০ এর দিকে তিনি দিমেরারায় একটা চিনি চাষ প্রকল্পের মালিক ছিলেন।
পিটার মিলার ওয়াটসনের মা ক্রিশ্চিয়ান রবার্টসন ওয়াটসন(১৭৮০-১৮৪২), তিন বোনের একজন ছিলেন। তাঁদের তিনজনকে বলা হতো, "কিলটার্নের তিন ফর্সা-কন্যা"। বড় জন ছিলেন এ্যান রবার্টসন যিনি চার্লস স্টুয়ার্ট পার্কারকে বিয়ে করেছিলেন। তিনি মূলত গ্লাসগোতেই থাকতেন যেখানে তাঁর ইনস্যুরেন্স এবং জাহাজ তৈরির ব্যবসা ছিল সেই সাথে গ্রেনাডায় চিনি প্রকল্পের মালিক ছিলেন।
ছোট বোন এলিজাবেথের বিয়ে হয়েছিল স্যমুয়েল স্যান্ডবাচ নামের এক ব্যক্তির সাথে যার ছিল স্যান্ডবাচ নামে একটা কোম্পানি। চিনি, কফি, চিটাগুড়, রাম এবং প্রাইম গোল্ড কোস্ট নিগ্রো ইত্যাদির ব্যবসা করতো সেই কোম্পানি।
এখানে একটা ছবি স্পষ্ট। ব্যবসা সংক্রান্ত পারস্পরিক সম্পর্কে নিজের মধ্যে বিয়ের একটা ব্যবস্থা ছিল। বংশ পরম্পরায় তাঁরা একটা রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাঁরা ছিল ক্রীতদাসের মালিক এবং প্রচুর পরিমানে সম্পদের অধিকারী।
এই জায়গায় এসে একটা ব্যাপার নাসিরকে খোঁচাতে থাকে। তাঁর চেহারা হুবহু এণ্ড্রু ওয়াটসন মত এবং তাঁদের পূর্ব পুরুষ একই জায়গা থেকে এসেছিলেন। তাদের পদবীও এক। তারা যদি পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত হয় তাহলে তাঁদের পূর্বপুরুষও কী ক্রীতদাস প্রথার সাথে জড়িত ছিল, তারাও ক্রীতদাসের মালিক ছিল?
নাসিরের বাবা নাসিরকে একবার বলেছিলেন, 'একদিন তোকে আমি আখের কাছেই ফিরিয়ে নিয়ে যাব।' নাসিরের সময় হয়েছে সেখানেই ফিরে যাবার যেখান থেকে তাঁর বাবা এসেছিলেন। সেই আখের কাছে ফিরে যাওয়া।
২০০৮ সালে নাসির দক্ষিণ আমেরিকার দেশ গায়ানা রওনা দিলেন 'ওয়েলদাদ' নামক একটা গ্রামের নামকে সম্বল করে, যে গ্রামে তাঁর বাবা, রেজিনাল্ড উইলকক্স ওয়াটসন কখনো ছিলেন। নাসিরের কাছে মনে হচ্ছিল নিজ গ্রামে ফিরছেন।
রাজধানী জর্জটাউনে নাসির প্রথমদিন অবস্থান করেন। রাজধানী শহর হলেও কোন সুউচ্চ দালান নেই। পুরোনো বাড়িগুলো সব কাঠের তৈরি। নাসির জাতীয় আর্কাইভ ঘাটাঘাটি করে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য বের করেন।
বৈবাহিক কোন রেকর্ড না পেলেও নির্বাচন কমিশন এটা নিশ্চিত করলেন যে গায়ানায় পিটার মিলার ওয়াটসন ছিলেন। যেহেতু তাঁর দুইটা চিনি প্রকল্প সেখানে ছিল তাই তাঁর ভোটাধিকার ছিল।
তাঁর জন্ম তারিখের সাথে চিনি প্রকল্পের মালিকের সাথে মিল ছিল, যেটা পাওয়া গিয়েছিল এণ্ড্রু ওয়াটসনের বিবাহের সনদে। এটা প্রমাণ করে যে প্রথম কৃষ্ণকায় ফুটবল খেলোয়ারের পিতার একটা চিনি চাষ প্রকল্প ছিল এবং ক্রীতদাস পালন করতেন এবং একজন কালো নারীর সাথে সম্পর্ক ছিল।
জর্জটাউনের উপকূল ধরে নাসির ছোট্ট গ্রাম ওয়েলদাদের পথে যাত্রা শুরু করেন। দেড় ঘন্টার পথ পুরো তিন ঘন্টায়। উঁচুনিচু পথ, পথ জুড়ে গরু, ছাগল, গাধা আর সাথে প্রচণ্ড গরম।
কিন্তু ওয়েলদাদ খুব সুন্দর একটা গ্রাম। সবুজ, তরতাজা গাছপালা। ষাট ফুট উঁচু নারিকেল পাম গাছ, ফলের গাছ। ছবির মত সুন্দর সবকিছু। পুরো শহরে বৈসাদৃশ্য হচ্ছে টেলিফোনের পোলগুলো যেগুলো আধুনিকতার একমাত্র উদাহরণ। সময়ের অনেক পেছনে চলে গেছি মনে হচ্ছিল।
লিভারপুলে ঝাঁক ঝাঁক সিগাল উড়ে কিন্তু ওয়েলদাদে নীল, সবুজ রঙের প্যারাকিট আর ম্যাকাওয়ের ঝাঁক। লম্বা বড় লেজওয়ালা পাখিগুলো পুরো জায়গাটাকে কোলাহলপূর্ণ করে রাখে।
রেইনফরেস্ট কেটে কেটে আখের ক্ষেত, ধানের ক্ষেত যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই রাস্তাগুলো দুই'শ বছর আগে ডাচদের কলোনি কালে তৈরি করা হয়েছিল। ক্রীতদাসরা সেই রাস্তাগুলো তৈরি করেছিলেন। নারকেল বীথি আর কাঠের বাড়িগুলোর চারপাশে গরুগুলো নিশ্চিন্তে চরে বেড়াচ্ছিল।
এখানকার ফসলের মাঠ থেকে যা পাওয়া যায় তা অনেক কষ্ট করে অর্জন করতে হয়, কোন কিছু সহজলভ্য নয়।
ওয়েলদাদ একটি প্রত্যন্ত গ্রাম এবং মানুষগুলো খুব সহজ সরল। সাহায্য করতে পারাটা তাদের জন্য ভীষণ আনন্দের। সেখানকার মানুষদের কাছ থেকে জানা গেলো পার্শ্ববর্তী গ্রামে ওয়াটসন নামে একজন শিক্ষক ছিলেন, তিনি মারা গেছেন। তিনি কী নাসিরের দাদা?
মিস্টার হোয়াইট নামে একজনকে পাওয়া গেলো যিনি পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু হতাশজনক ব্যাপার হলো তিনি ওয়াটসন নামে কোন ব্যক্তিকে চিনেন না।
কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে নাসিরের সাথে কথা বলার পরেরদিনই তিনি নদীর ধারে দু'জন মহিলাকে গল্প করতে শোনেন। একজন তার গৃহকর্মীর নাম বলেছিলেন ওয়াটসন।
নাসির অবশেষে সেই নারীর খোঁজে বেরুলেন। তিনি একটা কাঠের বাড়িতে থাকতেন যেটি বন্যার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পিলারের উপর নির্মিত ছিল।
সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় নাসির খাড়া কাঠের সিঁড়ি পার হয়ে উপরে উঠলেন। তাকে একজন বয়স্ক নারী হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি বিরাশি বছর বয়স্ক উইদিলাইন। নাসিরের চোখ আটকে গেল দেয়ালে সাঁটানো এক ছবিতে। ঠিক তার বাবার মুখোয়বব।
কথা বলে নাসির যা বুঝলেন ছবিটি নাসিরের চাচার। তাঁর বাবারা হলেন সৎ ভাই এবং দু'জনকেই ডাকা হতো রেজ বলে। তাহলে উইদিলাইন হলেন নাসিরের চাচাতো বোন। তাঁদের দু'জনের দাদা হলেন জর্জ এডওয়ার্ড ওয়াটসন। উইদিলাইন এটাও নিশ্চিত করলেন যে শিক্ষক ওয়াটসনই তাদের দাদা। তিনি একজন শিক্ষক ছিলেন এবং নাসিরের বাবাকে লিখতে পড়তে তিনিই শিখিয়েছিলেন।
উইদিলাইন এও জানান নাসিরের বাবা পূর্বপুরুষের সম্পত্তি পেতেন কিন্তু তিনি ইংল্যান্ডে চলে যাওয়ায় তা আর পাননি। পরের দিন নাসির জমি রেজিস্ট্রি অফিসে যোগাযোগ করেন। নাসির জানতে চান এই সম্পত্তিগুলোর সাথে এন্ড্রু ওয়াটসনের কোন যোগাযোগ আছে কি না। জমির মানচিত্র দেখে ওয়াটসন পরিবারের জমি চিহ্নিত করেন তিনি। যেখানে উইদিলাইন এখন বাস করছে সেটাকে এক সময় বলা হতো উডল্যান্ড প্ল্যান্টেশন। এই জায়গাটা চিনি শোধনাগার এলাকার উত্তর পাশ।
হতাশাজনক ভাবে এই চিনি প্রকল্পের সাথে পিটার মিলার ওয়াটসনের কোন পরিস্কার যোগাযোগ পাওয়া যায় না। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকে যায়। নাসিরের পূর্বপুরুষরা কীভাবে একরের পর একর চাষের জমির মালিক হলো?
পাঁচদিন খোঁজাখুঁজির পর নাসির লিভারপুল ফিরে আসে। তিনি তাঁর পরিবারের সদস্য খুঁজে পেয়েছেন, পূর্ব-পুরুষদের বাসস্থান খুঁজে পেয়েছেন, এণ্ড্রু ওয়াটসনের বাবা কে ছিলেন তা বের করেছেন কিন্তু এখনো অনেক কিছু জানা বাকি ছিল।
দশ বছর পর নাসির পরবর্তী যোগসূত্রটা খুঁজে পেয়েছিলেন। ই-বে তে কিছু হাতে লেখা চিঠি বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখতে পেয়েছিলেন যেগুলো মোম সীল ও পোস্টমার্ক দেয়া ছিল। সাধারণত স্ট্যাম্প ডিলাররা এই ধরনের জিনিস সংগ্রহ করে থাকে। চিঠিগুলোতে কী আছে তার একটা সুত্রের তালিকা দেয়া আছে। বিক্রেতারা এটা উনবিংশ শতকে চিনি এবং ক্রীতদাস ব্যবসার সাথে জড়িত প্রতিনিধিত্বকারি হিসেবে বর্ণনা করছেন বিশেষ করে সে সময়ে লিভেরপুল, দিমেরারা এবং গ্লাসগোতে বসবাসকারী ব্যবসায়ীদের সাথে সম্পর্কিত।
টাকা পয়সার টানাটানি থাকলেও নাসির প্রায় হাজার খানেক পাউন্ড খরচ করে সবগুলো চিঠি কিনে ফেলেন। এটা একটা জুয়া খেলা ছিল এবং নাসির তা জিতে গিয়েছিলেন।একশোরও বেশি চিঠি ছিল ওখানে। বেশির ভাগই ছিল ক্রীতদাস প্রথার সাথে জড়িত এক সাম্রাজের। এই সাম্রাজ্য শুরু হয়েছিল পিটার মিলার ওয়াটসনের দাদা জর্জ রবার্টসন থেকে। সময়টা ছিল ১৭৯০ সালে, গ্রানাডায়। জর্জের পার্টনার ছিলেন স্যামুয়েল স্যান্ডবাচ এবং চার্লস স্টুয়ার্ট পার্কার। যারা বিবাহ সম্পর্কে ওয়াটসনের চাচা।
১৭৯৫ সালে দাসদের এক বিদ্রোহের পর তারা গ্রানাডা থেকে সব ধরনের কাজ পরিচালনা করতেন। এরপর তারা গায়ানার দিমেরারা এলাকায় নতুন স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮১৩ সালে এই পরিবারের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী ফিলিপ ফ্রেড্রিক টীন নামে একজন ডাচ ব্যবসায়ীর সাথে ব্যবসা শুরু করেন। এটা স্যান্ডবাচ টীন নামে পরিচিতি লাভ করে।
সেই কাগজগুলো ছিল ব্যবসার হিসাব পত্রের কাগজ। ১৮০৮-১৮৮০ সালের ব্যবসায়ী একাউন্টের সম্পূর্ণ লাভ, ক্ষতির হিসাব নিকাশ। সেখানে কোম্পানির চাষবাস, ভূমির পরিমাণ, ইন্সুরেন্স, কার্গো জাহাজ তৈরি এবং তাদের ইন্সুরেন্স, কোথায় তাদের যাতায়াত সব কিছুর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া আছে।
এখানে এটাও নিশ্চিত করে যে কোম্পানির গায়ানায় অর্থাৎ যেখানে নাসিরের পূর্বপুরুষের বাস সেখানে চাষবাস ছাড়াও ক্রীতদাসের ব্যবসা ছিল। কোম্পানির দাস ব্যবসার অনেকগুলো লিখিত প্রমাণ রয়েছে। বিস্তারিতভাবে দাসের সংখ্যা এবং তা থেকে অর্জিত বিশাল অংকের টাকা বর্ণনা দেওয়া আছে।
এই আর্কাইভটা ছিল সোনার খনির মত কিন্তু এর বর্বরতম অতীত ইতিহাস নাসিরকে অবশ করে দিয়েছিল। এই ইতিহাস কালো মানুষের শত বছরের অমানুষিক কষ্টের ইতিহাস।
প্রাপ্ত ডকুমেন্ট থেকে জানা যায় স্যামুয়েল স্যান্ডবাচ একজন কম বেতনের ক্লার্ক হিসেবে গ্রানাডার কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কোম্পানি যখন ১৭৯৬তে দিমেরারায় নতুন বসতি স্থাপন করে তিনি সেখানে চলে যান। রবার্টসন পরিবারে বিয়ে করে তিনি কোম্পানির পার্টনার হয়ে যান এবং পরবর্তীতে পুরো ব্যবসা নিজের অধীনে নিয়ে ফেলেন।
তিনি পরবর্তীতে সবচেয়ে বড় ক্রীতদাস ব্যবসায়ীতে পরিণত হন এবং ইংল্যান্ডে একজন নামকরা ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি পান।
১৮২২ সালের ৩১শে আগস্টের "নিগ্রো একাউন্ট" বলে একটা দস্তাবেজ পাওয়া যায়। সেখানে দাস কেনা বেচার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া আছে। এখান থেকে জানা যায় "স্যান্ডবাচ টীন" ৬০০০ পাউন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যখন কোম্পানির অনেক দাস মারা যান।
এ সময়ে দিমেরারা এবং এর আশেপাশের এলাকায় একটা মহামারী হয়েছিল। এতে প্রচুর দাস মারা গিয়েছিল। জানা যায় ১৮২২ এ এক মহামারী জ্বরে গায়ানায় অনেক মানুষ মারা যায়। শুধু জর্জটাউনেই পাঁচ শতাংশ মানুষ মারা যায়।
একটা চিঠিতে মহামারীর বর্ণনা পাওয়া যায় এভাবে…
"এই আবহাওয়ায় যে মহামারী ছড়িয়েছে তাতে সব শ্রেণীর মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করো নিগ্রোদের জন্য এটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে…" ক্রীতদাসরা মারা যাচ্ছে কিন্তু লেখকের মূল চিন্তা ছিল কীভাবে জমিতে উৎপাদন কমে লাভ ৭৫%নেমে এসেছে সেটা নিয়ে।
ক্রীতদাসদের অবস্থার বিবরণ পাওয়া যায় জন স্মিথ নামে একজন রেভারেন্ডের বর্ণনা থেকে। তিনি ১৮২৩ সালে দিমেরারা পরিদর্শন করেন। তাঁর বর্ণনা থেকে দেখা যায় ক্রীতদাসরা বিশ ঘন্টার বেশি সময় জমিতে কাজ করে ভীষণ ক্লান্ত থাকতো। অনেকে ঘুমানোর অনুমতি পর্যন্ত পেতো না। রাত জেগে আখ কাটতে হতো।
নাসির আর্কাইভে পাওয়া ক্রীতদাসদের বর্ণনা আর পড়তে পারছিলেন না। তাদের সীমাহীন দূর্দশার কথা কল্পনা করে তিনি মানসিক বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কালো নারী, পুরুষ, শিশুদের বিবেচনা করা হতো পশুদের মত লাভ-ক্ষতির হিসেবে। বরং ঘোড়াদের তাদের থেকেও ভালো ভাবে যত্ন নেয়া হতো।
আর্কাইভ থেকে নাসির তাঁর প্রয়োজনীয় অনেক যোগাযোগ সূত্র পেয়ে গিয়েছিলেন। যেমন- উডল্যান্ড চিনি প্রকল্পের মালিক ছিলেন স্যান্ডবাচ টীন। তাঁর পূর্বপুরুষরা সেই এলাকায় থাকতেন। ১৮৩০শের পর অন্য প্রকল্পের মত পিটার মিলার ওয়াটসন এটা দেখাশোনা করতেন। এবং এই সেই জায়গা যা উইদিলাইন এবং নাসিরের পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা বংশগত ভাবে পেয়েছিল।
সবকিছু একটা দিকেই নির্দেশ করছে আর তা হলো নাসির কোন না কোন ভাবে এণ্ড্রু ওয়াটসনের সাথে সম্পর্কিত। নাসিরের দৃঢ় একটা ধারণা হয়েছে যে এই এণ্ড্রু ওয়াটসন সম্পর্কে তিনি প্রথম থেকে যা ভেবেছিলেন তাই সত্যি হচ্ছে। এই অনুভূতিটা নাসিরকে গর্বিত করে আর স্বস্তি দেয় এই ভেবে যে তাঁর একটা মূল্যবান পরিচয় আছে।
কিন্তু নাসিরের পূর্ব পুরুষেরা ক্রীতদাসের মালিক ছিলেন এটা তাঁকে স্বস্তি দেয় না। বহু বছরের নির্মমতার পর তাদের পরবর্তী প্রজন্ম তাদের সম্পত্তির একটা ছোট অংশের মালিক হন এবং তাদের পদবী বহন করেন।
নাসির আবার দিমেরারা যাবার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাঁর দাদা জর্জ এডওয়ার্ড ওয়াটসনের জন্ম সনদ দেখতে চান যা পিটার মিলারের সাথে সম্পর্কের একটা ভালো সূত্র দিতে পারবে। অথবা পিটারের ভাই হেনরি কিংবা উইলিয়াম, যারা তখন চিনি চাষের সাথে জড়িত ছিলেন তাদের সাথে কোন সূত্র দিতে পারবে।
উইদিলাইন নাসির সম্পর্কে একটা কথা বলেছিলেন, "তিন সাদা চামড়ার স্কটিশ ভাই- তাদের সাথে তোমার সম্পর্ক আছে। "
দাস ব্যবসা করে নাসিরের পূর্বপুরুষ যে সম্পদ তৈরি করেছিলেন স্যামুয়েল স্যান্ডবাচ তা নিয়ে এসেছিলেন লিভারপুলে যে শহরে নাসির একজন বহিরাগত হিসেবে বড় হয়েছেন।
স্যান্ডবাচ "স্যান্ডবাচ টীন এণ্ড কোম্পানি" র এখনকার সিইও'র মত একটা পদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন একটা বিশাল গ্রুপ অব কোম্পানির সবচেয়ে দৃশ্যমান শেয়ার হোল্ডার। দিমেরারা, গ্লাসগো, লিভারপুল সব জায়গায় তিনি ছিলেন প্রভাবশালী।
হাজার হাজার দাস, অসংখ্য চাষ প্রকল্প, জাহাজের বহর স্যান্ডবাচকে এনে দিয়েছিল অঢেল সম্পদ।
লিভারপুলে তিনি অকল্পনীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। ১৮৩১ সালে তিনি শহরের মেয়র নিযুক্ত হলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ শহরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হন। দাস থেকে শুরু করে তুলা, কফি, চিনি, রাম, চিটাগুড় সবকিছুর বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল লিভারপুল।
১৮৩৩ স্যান্ডবাচ টীন থেকে স্যান্ডবাচ অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর ব্যবসার শেয়ার দুই ছেলের কাছে হস্তান্তর করেন। ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে তিনি দাস প্রথা তুলে দিতে আইন তৈরি করতে সাহায্য করেন।
এই আইনের অধীনে ব্রিটিশ সরকার দাস মালিকদের ২০ মিলিয়ন পাউন্ড প্রদান করেন যেনো তারা দাসদের মুক্তি দেন। যদিও এই অর্থ ২০১৫ সাল পর্যন্ত পুরোপুরি প্রদান করা হয়নি।
লিভারপুল পশ্চিম ভারতীয় এসোসিয়েশন এই ক্ষতিপূরণের অর্থ সরকারের কাছ থেকে আদায় করতে সচেষ্ট ছিল। স্যান্ডবাচ ছিলেন তারই একজন সদস্য।
দাস প্রথা বিলুপ্তি হলেও স্যান্ডবাচের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। ১৮৪০ এর মাঝামাঝিতে নতুন প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক অব লিভারপুলের গুরুত্বপূর্ণ একটা স্টক কিনে ব্যাংকের ডেপুটি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
লিভারপুল ব্যাংকের বিস্তৃতি বাড়তেই থাকে। লিভারপুল ব্যাংক ১৯১৮তে মার্টিন ব্যাংক কিনে ফেলে এবং ১৯২৮ লিভারপুল ব্যাংক মার্টিন ব্যাংক হয়ে যায়। এখন পুরো ইংল্যান্ডে এর কয়েকশ শাখা। একজন দাস-মালিক প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক কয়েক দশকে বিশাল আকার ধারণ করে।
১৯৬৯ এ বারক্লে ব্যাংক মার্টিন ব্যাংক নিয়ে ফেলে যা এখন সমগ্র যুক্তরাজ্যে ষষ্ঠতম ব্যাংক। কিন্তু এই ব্যাংকের উন্নতির পেছনে যে মানুষ, স্যামুয়েল স্যান্ডবাচ, তাঁকে সবাই ভুলে গেছে।
তাঁর হাতে গড়া সম্পত্তি যা নাসিরের পূর্বপুরুষের রক্তে তৈরি তা আজও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সমগ্র লিভারপুলে।
এটা অনেকটা নিশ্চিত যে এণ্ড্রু ওয়াটসন, যার জন্য নাসিরের এই দীর্ঘ যাত্রা শুরু হয়েছিল তাঁর এবং নাসিরের পূর্বপুরুষরা দাস -মালিক এবং দাস ছিলেন। তাঁর মা অবশ্যই একজন স্বাধীন কৃষ্ণকায় নারী ছিলেন। সম্ভবত পিটার মিলার ওয়াটসনের কোন ব্যবসায়িক অংশিদারের কন্যা ছিলেন।
দিমেরারায় অনেক কালো নারী স্বাধীন ছিলেন। তাঁদের নিজস্ব সম্পত্তি ছিল। কিন্তু এমন অনেক নারী ছিলেন যাদের যৌন সম্পর্ক স্থাপনে তাদের কোন অধিকার ছিল না। স্যান্ডবাচ টীন কোম্পানির যেকোন কর্মচারী তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারতো।
দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলে দাস ব্যবসায়ীদের মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় কিন্তু দাসদের ভাগ্য বদলাতে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। তাদের রক্ত পানি করা অর্থের স্রোত বয়ে যায় ইংল্যান্ডে কিন্তু তাদের জন্য কিছুই করা হয় না। আজও দিমেরারায় দাসদের করুণ অবস্থা দেখতে পাওয়া যায়। তাদের পুনর্বাসন করা না গেলে অবিচার করা হবে।
গতবছর গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় বিশ মিলিয়ন পাউন্ড ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দিয়েছেন কেননা এর পিছনের ইতিহাসে দাসপ্রথার যোগসূত্র রয়েছে। চেইন পাব "গ্রীণ কিং" ও ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দিয়েছে।
পনরটি ক্যারিবিয়ান দেশের সংগঠন 'ক্যারিকম' দাস ব্যবসার ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করার একটা যুক্তিযুক্ত প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছেন।
আর মালিক আল নাসিরকে যে যাত্রা লিভারপুল থেকে গায়ানা আবার গায়ানা থেকে লিভারপুল এনেছিল সেই যাত্রাই তাকে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গেল।
যে মানুষকে শৈশবে স্কুল ছাড়া করা হয় এবং সংশোধনের জন্য নেয়া হয়, দেয়া হয়নি কোন রকম শিক্ষা সুযোগ, সেই মানুষ "স্যান্ডবাচ টীন এবং দাসপ্রথায় তার ভূমিকা" নিয়ে পিএইচডি'র গবেষণা করবে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
যে যাত্রা শুরু হয়েছিল একটা পারিবারিক গাছ তৈরি করার মধ্য দিয়ে তা এখন আত্ম-পরিচয় আর সংস্কৃতির পুনঃমূল্যায়নের পথে।
দাস-প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে কিন্তু এর প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। এখন যেটা প্রয়োজন তা হলো স্বীকৃতি প্রদান এবং এর দায়ভার বহন। যেসব প্রতিষ্ঠান এই বর্বর বাণিজ্য থেকে লাভবান হয়েছে তাদের এই দায়ভার বহন করতে হবে। অতীত ভুলের জন্য অর্থপূর্ণ দায়মুক্তি হতে হবে, শুধু মাত্র জনসংযোগের অনুশীলন যেনো না হয়।
জর্জ ফ্লয়েডের ঘটনা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। দুই'শ বছর পার হয়ে গেছে এখনো বর্ণবাদ রয়ে গেছে, রয়ে গেছে নির্যাতন। জর্জ ফ্লয়েডের পরিবারকে জিজ্ঞেস করুন- নির্যাতন কী, বর্ণবাদ কী?
আমরা যদি আমাদের অতীতে দৃষ্টি না দেই কীভাবে বর্তমানকে জানবো? গিল স্কট-হেরণ একবার নাসিরকে বলেছিলেন, "তুমি যদি না জানো তুমি কোথা থেকে এসেছ, কখনো জানবে না কোথায় তুমি যাবে। তোমাকে তোমার ইতিহাস জানতে হবে।"
নাসির তাই তাঁর অতীত ইতিহাস খুঁজে বের করেছে আর তাঁর শেকড় খুঁজতে গিয়ে খুঁজে পেয়েছে কালো মানুষদের জীবনের না বলা অনেক কথা।