‘এত দীর্ঘসময় ধরে ঝড়ের তাণ্ডব আগে কখনো দেখিনি’
'চাচা ঝড় কি গেছেনি? কখন যাবে? ফেসবুক কি কয়? আর সহ্য হয় না। রোববার রাত ১২ টা থেকে সোমবার বিকাল, এখনও বাতাস চলছে। আর কতক্ষণ? '- এভাবেই এ প্রতিবেদককে প্রশ্ন করেন ৮৫ বছরের সিডু ব্যাপারী।
সিডু ব্যাপারী ১৯৭০ সালের ঝড়ে তার মা- বাবাসহ পরিবারের ১৭ জন সদস্যকে হারিয়েছেন। তার মতে, ১৯৭০ সালের ঝড়টিও এত দীর্ঘসময় ধরে হয়নি।
সোমবার (২৭ মে) দুপুরে লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদী তীরের নাসিরগঞ্জ বাজারের একটি মসজিদে বসে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন বৃদ্ধ সিডু ব্যাপারী।
ওই এলাকার আরেক বাসিন্দা আলী আহম্মদ (৭৫)-ও জিজ্ঞেস করেন এই ঝড় আর কতক্ষণ চলবে?
সিডু ব্যাপারী এবং আলী আহম্মদ দুজনই জীবনে অসংখ্য ঝড় দেখেছেন। কিন্তু এত দীর্ঘসময় পর্যন্ত কোনো ঝড় হতে দেখেননি তারা। ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে গতকাল রোববার থেকে সোমবার বিকাল পর্যন্তও ঝড় চলছে।
তারা জানান, আমরা একই এলাকায় বসে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, মহাসেন, বুলবুল, আম্পান,মোখার আঘাত দেখেছি। প্রতিটি ঝড় গড়ে ৪-৫ ঘন্টার মধ্যে থেমে গিয়েছিল। কিন্তু রিমাল দীর্ঘক্ষণ চলছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রোববার (২৬ মে) রাত ১২ টা থেকে লক্ষ্মীপুরের উপকূলে আঘাত হানা শুরু করে রিমাল। সোমবার বিকাল সাড়ে ৫ টা পর্যন্ত ঝড় ও বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের রিমালের প্রভাবে মেঘনা তীরবর্তী লক্ষ্মীপুর জেলায় রোববার (২৬ মে) রাত ১২টা থেকে সোমবার এ প্রতিবেদন লেখার সময় বেলা সাড়ে ৫টা পর্যন্ত টানা ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে।
রোববার রাত ১১টার পর থেকে জেলার উপকূলীয় উপজেলা রামগতি, কমলনগর, লক্ষ্মীপুর সদর এবং রায়পুর উপজেলায় বিদ্যুৎ নেই। এছাড়া সড়কে যাত্রীবাহী যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
সোমবার এসব এলাকার বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল।
রিমালের প্রভাবে জেলার কমলনগর উপজেলার মাতাব্বরহাট এলাকায় এবং রামগতি উপজেলার একাধিক স্থানে নির্মাণাধীন বেঁড়িবাধ ধসে পড়েছে।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎ না থাকায় বেশিরভাগ মোবাইল কোম্পানির নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না।
স্টেশনারি ব্যবসায়ী আরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎ না থাকায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রয়েছে।
মেঘনাপাড়ের নাসিরগঞ্জ বাজারে আসা মো. নিজাম উদ্দিন জানান, রোববার রাত ১১টার পর থেকে বাংলালিংকে কথা বলতে পারছেন না।
সোলাইমান হোসেন নামের আরেক যুবক জানিয়েছেন, সোমবার সকাল থেকে তিনি মোবাইল ফোনে রবি নাম্বার দিয়ে কথা বলতে পারছেন।
সোমবার সকালে লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কের বিভিন্ন স্থানে গাছ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। দুপুরেও মেঘনা নদী খুবই উত্তাল ছিল। জেলেরা তাদের নৌকাগুলো নিকটবর্তী খালে নোঙর করে নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছেন।
মেঘনাপাড়ের বাসিন্দা নারী নয়ন আক্তার জানিয়েছেন, রোববারের জোয়ারে তাদের বাড়িতে পানি প্রবেশ করেছিল। সোমবার সন্ধ্যার জোয়ারেও তার ঘর-বাড়ি প্লাবিত হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
মেঘনা পাড়ের বাসিন্দা, মনির মাঝি, রবি সওদাগর এবং সালেম জানিয়েছেন এবং সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রোববারের জোয়ারে প্লাবিত হয়েছিল মেঘনাপাড়ের বেশিরভাগ এলাকা। সোমবার সন্ধ্যার মধ্যে আবারও প্লাবনের আশঙ্কায় রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, জোয়ারের পানিতে অনেকের পুকুরের মাছ চলে গেছে।
দক্ষিণ চরমার্টিন এলাকার বাসিন্দা আলমগীর হোসেন বলেন, জোয়ারের পানিতে বাড়ির আশপাশ তলিয়ে গেছে। বাড়িতে গরু আছে। পানি উঠায় গরু নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়েছে।
দ্বীপ চর আবদুল্লাহর বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন জানান, জোয়ারের পানিতে তাদের পুরো চর প্লাবিত হয়েছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ জামান খান বলেন, অতিরিক্ত জোয়ারের কারণে মেঘনা নদীতে নির্মাণাধীন বাঁধের কয়েকটি পয়েন্ট সমস্যা হয়েছে। ঝড়ের পরে তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও জানান, সোমবারও নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়েও পানির উচ্চতা ১.৩ থেকে ১.৬ মিটার বৃদ্ধি পেতে পারে। ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রম করলে জলোচ্ছ্বাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
লক্ষ্মীপুর পল্লী বিদ্যুৎ- এর জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান জানিয়েছেন, ঝড় শেষ হয়ে যাওয়ার পরপরই আমরা বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করতে কাজ করছি।
অন্যদিকে লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণের উপ-পরিচালক মো. সোহেল শামসুদ্দীন ফিরোজ জানিয়েছেন, এ সময় ক্ষেতে কোনো ফসল নেই। তাই কৃষির তেমন ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা নেই।