প্রতারণার শিকার মালয়েশিয়াগামী কর্মীরা, প্রবেশের সময়সীমা শেষ, বিমানবন্দরেই আটকে রইলেন হাজারো কর্মী
মালয়েশিয়ায় অভিবাসনপ্রত্যাশী কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত অভিবাসন খরচ নিলেও অব্যবস্থাপনা ও সন্দেহজনক লেনদেনের কারণে এই কর্মীদের জন্য সময়মতো ফ্লাইটের ব্যবস্থা করতে পারেনি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সিন্ডিকেট।
মালয়েশিয়ার সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা ৩১ মে-র মধ্যে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো তাদের টিকিট দিতে না পারায় গতকাল শুক্রবার ঢাকা বিমানবন্দরে শত শত লোক জড়ো হয়েছিলেন।
ঢাকা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, শুক্রবার সাতটি ফ্লাইটে দুই হাজারের বেশি কর্মীর মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রায় ১০ হাজার কর্মী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিজেদের কর্মক্ষেত্রে পৌঁছাতে পারেননি বলে ধারণা করেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
গতকাল রাত ৯টায় বিমানবন্দর ঘুরে দেখা গেছে, কিছু এজেন্সির প্রতিনিধিরা কিছু কর্মীকে সামনের কোনো তারিখের টিকিট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং মালয়েশিয়া সময়সীমা বাড়িয়ে দেবে বলে কিছু কর্মীকে প্রলুব্ধ করছেন।
এজেন্সিগুলো এ বিপর্যয়ের দায় চাপাচ্ছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের ওপর।
এ পরিস্থিতিতে মধ্যে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, তারা এজেন্সিগুলোর কাছে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ব্যক্তিদের তালিকা এবং তাদের ভ্রমণ পরিকল্পনা চেয়েছেন।
'কিন্তু এজেন্সিগুলো কোনো তথ্য দিতে পারেনি,' বলেন তিনি।
দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং শ্রমিকদের বেকারত্বের অভিযোগের মধ্যে গতকাল আবারও বন্ধ হয়ে গেছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। চার বছরের বিরতির পরে ২০২১ সালের শেষের দিকে ফের খুলে দেওয়া হয়েছিল দেশটির শ্রমবাজার। সরকার অভিবাসনের খরচ নির্ধারণ করেছিল ৭৯ হাজার টাকা।
১০০টি রিক্রুটিং এজেন্সির একটি সিন্ডিকেট বর্তমানে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাচ্ছে। এজেন্সি সূত্রে জানা গেছে, ৫ লাখ কোটার মধ্যে ১০ হাজারের বেশি কর্মী এখনও মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি।
এদিকে ঢাকা-মালয়েশিয়া রুটে বিমানভাড়া স্বাভাবিক দামের চেয়ে চারগুণ বেড়েছে। কর্মীদের এখন ১ লাখ টাকায় একটি টিকিট কিনতে হচ্ছে। অথচ ছয় মাসও একটি টিকিটের দাম ছিল ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা।
কর্মীদের দুর্দশা
নাটোরের সিংড়া উপজেলার মনিরুল ইসলাম মালয়েশিয়ার একটি রেস্তোরাঁয় কাজের ব্যবস্থা করার অভিজ্ঞতা জানান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে।
মনিরুল আরও ২৩ জনের সঙ্গে মালয়েশিয়ায় রেস্টুরেন্টে কাজের জন্য একটি এজেন্সিকে ৭ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। শুক্রবার সকালে তাদের মালয়েশিয়ার টিকিট পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিকাল ৪টা পর্যন্ত তারা টিকিট পাননি।
আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে ও নিজের জমি বিক্রি করে এজেন্সিকে টাকা দিয়েছেন মনিরুল। মাসে ১,৫০০ রিঙ্গিত বেতনে তাকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।
মনিরুল আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, 'মালয়েশিয়া যেতে না পারলে আমার আর বেঁচে থাকার পথ থাকবে না।'
এদিকে বেশ কিছু এজেন্সির বিরুদ্ধে ভুয়া টিকিট দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। মালয়েশিয়াগামী কয়েকজন জানান, কিছু কিছু এজেন্সির পক্ষ থেকে তাদের ভুয়া টিকিট দেওয়া হয়। সে টিকিট নিয়ে তারা এয়ারপোর্টের ভেতরে প্রবেশ করেন। কিন্তু ভুয়া টিকিটের কারণে তাদের বের করে দেওয়া হয়।
আরমান শিকদার নামে মালয়েশিয়ায় অভিবাসনপ্রত্যাশী এক ব্যক্তি বলেন, সকাল সাড়ে ১১টায় একটি ফ্লাইটের কথা বলে ফ্লাইটের ঠিক ১০ মিনিট আগে টিকিট দেওয়া হয়। কিন্তু বিমানবন্দরে প্রবেশ করলে প্রয়োজনীয় যাচাইয়ের পর তাদের টিকিট ভুয়া বলে জানানো হয়।
এছাড়াও শুরুতে চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও, কর্মীদের কাছ থেকে বিভিন্ন মিথ্যা অজুহাতে আরও টাকা নিয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে।
আলী হোসেন নামে মালয়েশিয়াগামী এক অভিবাসনপ্রত্যাশী জানান, প্রথমে তার সাথে ৫ লাখ টাকার চুক্তি হয়। কিন্তু তার কাছ থেকে প্রায় ৭ লাখ টাকা নিয়েছে এজেন্সি।
এই টাকার সঙ্গে প্রত্যেক কর্মীর সর্বশেষ স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ৭০ হাজার টাকা এবং ফিঙ্গারের জন্য ৪-৫ হাজার করে টাকা নেওয়া হয়েছে।
এজেন্সিগুলো কী বলছে
১০০টি রিক্রুটিং এজেন্সি মিলে যে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে, তার অংশ সাদিয়া ইন্টারন্যাশনাল। এ এজেন্সির স্বত্বাধিকারী এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ-এর (বায়রা) সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, মালয়েশিয়ার সরকার দুই মাস আগেই ডেডলাইন জানিয়েছিল।
'কিন্তু আমরা যেমন নিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে চাহিদাপত্র দেরিতে পেয়েছি, অন্যদিকে আমাদের প্রবাসী মন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি,' বলেন তিনি।
কী পরিমাণ লোক বাকি আছে, তা যাচাই করে মন্ত্রণালয় যদি সেভাবে অতিরিক্ত ফ্লাইট দেওয়ার জন্য বিমান মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করত, তাহলে এ সমস্যা এড়ানো যেত বলে মন্তব্য করেন নোমান।
কর্মীদের অধিকার নিয়ে উদ্বেগ
কুয়ালালামপুরেভিত্তিক অভিবাসী কর্মী অধিকার বিশেষজ্ঞ অ্যান্ডি হল এই কর্মীদের কল্যাণ ও কর্মসংস্থানের অবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, 'এই কর্মীদের অনেকেই মালয়েশিয়ায় জোরপূর্বক শ্রমের জন্য বাংলাদেশি কর্মী পাচারকারী ক্রিমিনাল সিন্ডিকেটের শিকার। সম্প্রতি দেশটিতে প্রবেশের গড় খরচ জনপ্রতি ৬ হাজার ডলার হয়ে গেছে। ভুয়া নিয়োগকারীর কাছে এসে কাজ না পেয়ে অনেকেই আধুনিক দাসত্বের উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন।'
তিনি মালয়েশিয়ার একজন অভিবাসন কর্মকর্তার একটি চিঠির বরাত দিয়ে বলেন, কর্মী প্রবেশের সময়সীমা বাড়ানো হয়নি। তাই ৩১ মের পরদিন যারা দেশটিতে পৌঁছাবে, পারমিটের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে তাদেরকে ফেরত পাঠানো হবে।
এয়ারলাইন্সগুলোকেও ঢাকা থেকে এই পারমিট নিয়ে আসা কর্মীদের ফ্লাইটে না ওঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক আটকা পড়েছেন।
কর্মীদের দুর্দশা লাঘবে এবং তাদের মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর পর মানব পাচার তদন্তের সুবিধার্থে এক দফা মেয়াদ বৃদ্ধি করতে অনুরোধ করেন সরকারকে।