পাঁচ বছরে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ১৭ কোটি চাকরি তৈরি হবে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) শ্রমবাজারে বিপ্লব ঘটানোর ক্ষমতা অনস্বীকার্য এবং এর ভবিষ্যৎ প্রভাব ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। কিছু কাজ ইতোমধ্যেই এআই-এর প্রভাবে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে, অন্যদিকে অনেক কাজ নতুন, উন্নত প্রযুক্তির ফলে সমৃদ্ধি লাভ করছে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) প্রকাশিত 'ফিউচার অব জবস রিপোর্ট ২০২৫' অনুযায়ী, জেনারেটিভ এআই এবং তথ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তিগুলো আগামী পাঁচ বছরে ব্যবসায়িক মডেল পরিবর্তনের পেছনে প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করবে। এই সময়ে, ক্যাশিয়ার এবং ক্লার্কের (দপ্তর সহকারী) মতো প্রশাসনিক কাজগুলো ধীরে ধীরে কমে আসবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফলে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ঘটায় বিশেষজ্ঞদের এই বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, বর্তমান সময় গত মানুষ ও যন্ত্রের সম্পর্ককে নতুনভাবে রূপান্তরিত করবে। ডব্লিউইএফ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানুষ এবং যন্ত্রের মধ্যে সম্পর্ক নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হবে।
প্রতিবেদনটি বর্তমান পরিস্থিতি এবং তার ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের কিছু তথ্য প্রদান করেছে। বর্তমানে ৪৭ শতাংশ কাজ মানুষ সম্পন্ন করে এবং মাত্র ৩০ শতাংশ কাজ যন্ত্রের সঙ্গে সহযোগিতায় করা হয়। কিন্তু ২০৩০ সালে এই অনুপাত প্রায় সমান হয়ে যাবে।
যন্ত্রের গুরুত্ব বাড়ার কারণে প্রতিবেদনে পরামর্শ দিয়ে বলা হয়েছে, প্রযুক্তি এমনভাবে ডিজাইন করা উচিত যা কাজকে প্রতিস্থাপন না করে বরং সেটিকে সহায়তা করবে। এছাড়া, সম্পূর্ণ অটোমেশন করার পরিবর্তে মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনটি সতর্ক করে বলা হয়েছে, অ্যালগরিদমগুলোর হাতে পুরো নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দেওয়ার কারণে দেশগুলোর মধ্যে অসমতা বাড়তে পারে। কারণ সব দেশ সমানভাবে বিনিয়োগ করছে না এবং ভবিষ্যতে একইভাবে বিনিয়োগ করার জন্য তাদের সমান সম্পদও নেই। এছাড়া, মানুষের দায়িত্ব পুরোপুরি তুলে দেওয়ার বিষয়ে নৈতিক বিতর্কও রয়েছে।
এই প্রতিবেদনটি ভবিষ্যতে শ্রম বাজারের পরিস্থিতি নিয়ে কিছু পূর্বাভাস দিয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশেষত ছবি বা লেখা তৈরি করার ক্ষমতা এর অন্যতম কারণ। ২০৩০ সালের মধ্যে শ্রম বাজারে ২২ শতাংশ পরিবর্তন আসবে, যা বর্তমান কর্মসংস্থানের সমান। এর ফলে ১৭০ মিলিয়ন নতুন চাকরি তৈরি হবে, কিন্তু ৯২ মিলিয়ন চাকরি হারানোর সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে, এআই-এর ফলে মোট কর্মসংস্থান ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে অর্থাৎ ৭৮ মিলিয়ন নতুন চাকরি তৈরি হবে।
নতুন চাকরি এবং পতনের ঝুঁকি
প্রতিবেদনটি নতুন কাজের ক্ষেত্রগুলো আলোচনা করেছে এবং কী কারণে এগুলোতে পরিবর্তন আসবে তা ব্যাখ্যা করেছে। যেসব কাজ সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পাবে, তার মধ্যে রয়েছে– কৃষি কাজ (টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য), ডেলিভারি ড্রাইভার (ই-কমার্স বৃদ্ধির কারণে), নির্মাণ কর্মী (ভবিষ্যতে অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়বে), স্বাস্থ্যকর্মী (বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়ার ফলে জন্য নার্স, সেবক-সেবিকা ও সোশ্যাল ওয়ার্কারদের চাহিদা বাড়বে) এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মী (যুব জনসংখ্যার বৃদ্ধি উচ্চশিক্ষার চাহিদা বাড়াবে)।
অন্যদিকে, কিছু এমন কাজও রয়েছে যেগুলো বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষত যেগুলো রুটিন বা রিপিটিটিভ স্কিলস বা পুনরাবৃত্তিমূলক দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে রয়েছে– ক্লার্কদের কাজ (এআই প্রোগ্রাম দিয়ে ডেটা ম্যানেজমেন্টের কারণে এই ধরনের কর্মচারীর চাহিদা কমেছে), কাস্টমার সার্ভিস কর্মী (চ্যাটবটগুলো এসব কাজ গ্রহণ করছে) এবং মেশিন অপারেটর (শিল্প স্বয়ংক্রিয়তা প্রাথমিক যন্ত্রপাতি পরিচালনাকারী কর্মীদের চাহিদা কমিয়ে দিচ্ছে)।
বড় প্রভাব
প্রতিবেদনটিতে ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, এই পরিবর্তনগুলো পাঁচটি প্রধান প্রবণতার কারণে ঘটছে– প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক বিরোধ (যার ফলে সরবরাহ চেইন এবং ব্যবসার কার্যক্রম পরিবর্তিত হচ্ছে), গ্রিন ট্রানজিশন বা সবুজায়ন (বায়ু শক্তি ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তির সাথে সম্পর্কিত চাকরি তৈরি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য), অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং জনসংখ্যার পরিবর্তন (বয়স্ক জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া উন্নত অর্থনীতিগুলোর জন্য একটি চ্যালেঞ্জ)।
প্রতিবেদনটির উপসংহারে বলা হয়েছে, প্রযুক্তিগত রূপান্তর এবং কর্মসংস্থানের উন্নতি শ্রম বাজারকে আরও উৎপাদনশীল, দক্ষ এবং টেকসই করে গড়ার জন্য একটি অনন্য সুযোগ দেয়। তবে এটি ঘটানোর জন্য সরকারের, প্রতিষ্ঠানের এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন, যাতে উপকারিতা "সমান্তরাল এবং ন্যায়সংগত" হয়। নতুন দক্ষতায় প্রশিক্ষণ এবং নতুন চাকরির জন্য শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে এই নতুন যুগে অসমতার ঝুঁকি কমানো যায় এবং সুযোগগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়।