‘এই ধেনু সর্ না, নইলে ফুল ছুড়ে মারব’
বাজেটের দিন সংবাদকক্ষে যদি 'চানরাত' পরিবেশ-পরিস্থিতি থাকে, তাহলে পরদিন সংবাদপত্রগুলো যেন একেকটা ঈদ সংখ্যা। সংবাদ আধেয় যত জটিলই হোক না কেন, নানারকম সৃজনশীল চিত্র বিশেষ করে গ্রাফিক্স বা নকশা এবং কার্টুনগুলো চিত্তমনে আনন্দের দোলা দেয়।
সংবাদপত্রে সৃজনশীল গ্রাফিক্সের ব্যবহার খুব পুরোনো না হলেও কার্টুনের বয়স অনেক। পত্রিকায় ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্রের ব্যবহার শুরু ঊনিশ শতকে। তবে তারও আগে কার্টুন ব্যবহারের উদাহরণ আছে। 'যোগ দাও অথবা মরো' [জয়েন, অর ডাই] শিরোনামে ১৭৫৪ সালের ৯ মে পেনসিলভেনিয়া গেজেট পত্রিকায় একটি কার্টুন প্রকাশিত হয়, যেখানে কলোনিয়াল আমেরিকার ৮টি উপনিবেশকে আট টুকরোয় বিভক্ত একটি সাপ হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছিল। কার্টুনটি এঁকেছিলেন আমেরিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন।
বাংলা ব্যঙ্গচিত্রের আদিপুরুষ গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঊনিশ শতকে বাংলা সংবাদপত্রেও কার্টুন ছাপা শুরু হয়। তবে ব্যাপকভাবে তা শুরু হয় তিরিশের দশকে। সেসময় সওগাত পত্রিকায় কার্টুন আঁকতেন আবুল কাশেম। স্বাধীন বাংলাদেশে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় রনবীর আঁকা কার্টুন 'টোকাই' ব্যঙ্গচিত্রকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। একসময় শুধু কার্টুন নিয়েই ম্যাগাজিন প্রকাশ শুরু হয় দেশে। দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে কার্টুন।
তবে, পত্রিকায় রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র এখন আমরা কমই দেখি। এর কারণও হয়তো আমাদের জানা। তারপরও বাজেটের পরদিন প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকাগুলোতে ছাপা কার্টুন পাঠকদের এক বিশেষ আনন্দ দেয়।
স্যাটায়ার মানুষের জীবনেরই একটি অংশ। জীবনযাত্রায় মানুষ তার চাওয়া-পাওয়া নিয়ে ক্ষমতাসীনদের কাজকর্মে যে ব্যঙ্গ করতে চায়, তারা সেটা খুঁজে পায় পত্রিকায় ছাপা ব্যঙ্গচিত্রে। ঈদ সংখ্যার মতো বাজেটের পরদিনের পত্রিকার জন্যও তাই আমি অপেক্ষা করি কার্টুনগুলো দেখার জন্য। আমার মতো নিশ্চয় আরও অনেক মানুষ, অনেক পাঠকও অপেক্ষা করেন।
অবশ্য পত্রিকার সেই আগের মতো রমরমা অবস্থা আর নেই। ইন্টারনেট এসে অনেককিছু ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এসে সবকিছু। রঙ্গ-ব্যঙ্গের জন্য এখন মানুষ আর শুধু কার্টুনিস্ট কিংবা কমেডিয়ানদের দিকে তাকিয়ে থাকে না। সামাজিকমাধ্যম, বিশেষ করে বাংলাদেশে ফেসবুকের কল্যাণে তারা নিজেরাই একেকজন চরিত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। কেউ লেখায়, কেউ ছবিতে আর কেউ নিজে নিজের ভিডিও করে রাষ্ট্র ও সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে।
এবারের বাজেটও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
কূটনীতিক থেকে রাজনীতিক হয়ে অতীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা এ এইচ মাহমুদ আলী এবার অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বাজেট দেওয়ার পরমুহূর্ত থেকেই নানা রসাত্মক আলোচনা চলছে। এটা এরকম না যে মাহমুদ আলী বাজেট দিয়েছেন বলে রঙ্গরস চলছে। বিষয়টা আসলে এরকম যে, বাজেট যিনিই পেশ করুন না কেন, বিষয়বৈচিত্র্য এবং মানুষের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে এ নিয়ে পরিহাস, পরিতাপ, হাস্যকৌতুক, হাস্যরস, রঙ্গ-তামশা, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ সব চলবেই।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে জাতীয় বাজেট প্রসঙ্গে ফেসবুক পোস্ট, রিল এবং স্টোরিতে সয়লাব। এরা যে বিখ্যাত মানুষ, এরকম নন। একেবারে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সাধারণ্যে পরিচিত অনেকেই বাজেট নিয়ে স্যাটায়ার করার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে বেছে নিয়েছেন।
সেসব পোস্ট এবং রিলে বিষয়ের কোনো অভাব নেই। কেউ হয়ত মোবাইল ফোনে টকটাইমের খরচ বেড়ে যাওয়া নিয়ে 'মিসড কল' যুগে ফিরে যাওয়ার কথা বলছেন। কেউ বলছেন, বিয়ের জন্য কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া নিতে খরচ বাড়লেও সমস্যা নেই, বেবি ফুডের দাম কমছে। কেউ জানাচ্ছেন, সিগারেটের দাম ঠিকই বাড়বে, কিন্তু চকোলেটের দাম কমার যে কথা বলা হচ্ছে, সেটা কখনোই হবে না। আবার কারও দুঃখ যে, আকাশযানের খরচ কমলেও রানওয়ে না থাকার কারণে সেটা কিনতে পারছেন না।
নানা হাস্যরসের মধ্যে যে সিরিয়াস বিষয় নিয়ে বেশি আলোচনা, সেটা হলো ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ। এ নিয়ে রসিকতার ঢংয়ে হলেও তুমুল সমালোচনা চলছে।
সেখানেই প্রশ্ন উঠেছে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহামেদ তাহলে বঞ্চিত হবেন কেন! তার মতো দুর্নীতিবিরোধী একজন মানুষ, যিনি মাথায় টুপি পরে তার অধস্তনদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছুতে লোভ না করতে বলেছিলেন; তিনি না হয় ছোট একটা ভুল করে একদিনে গুলশানে দুইজোড়া ফ্ল্যাটের দলিল করেছেন, অবৈধ আয়ে জবরদস্তি করে সংখ্যালঘুদের জমি কিনেছেন, দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন; তাই বলে তার সম্পত্তি কেন ক্রোক করা হবে? তাকেও ১৫ শতাংশ কর পরিশোধের শর্তে সব অবৈধ সম্পদ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হোক।
আসলে আমরা এমন একটা রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন করেছি যেখানে অবৈধ আয়, বিশেষ করে ঘুষকে কোনো অন্যায় মনে করা হয় না। উল্টো বরং অবৈধ আয়ের সম্পদের পাহাড় গড়া মানুষদেরই সমাজ বেশি সম্মান ও ভক্তি করে। এমনকি পবিত্র যে মসজিদ, সেখানেও দেখবেন বর্তমান ও সাবেক ঘুষখোরদেরই সামনের সারির আসন নিশ্চিত। সরকারও তাদের সেই সম্মান দিতে চাচ্ছে। পনেরো শতাংশের কথা বলে 'এই দুষ্টু' এরকম একটু আদুরে বকুনি দিতে চাচ্ছে।
তাদের জন্য ১৫ শতাংশের ওই বকুনি আসলে 'এই ধেনু সর্ না, নইলে ফুল ছুড়ে মারব' বলে যে মিথটা প্রচলিত আছে অনেকটা সেরকম। অনেকেই হয়তো গল্পটা জানেন। যারা জানেন না, তাদের বলছি। বলার আগে যে শহীদ বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে এ গল্প, তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
গল্পটা এরকম: সত্তর দশকের শেষদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ ঢাকার বাইরে একটা বনভোজনে গিয়েছে। এক অধ্যাপক সঙ্গী সমভিব্যাহারে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করছেন। হঠাৎ সামনে একটা গরু পড়ল। গরুটা না সরলে তিনি এগিয়ে যেতে পারছিলেন না। নরম মনের মানুষটি তখন গরুকে সরে যাওয়ার অনুরোধ জানাতে বলেছিলেন, 'এই ধেনু সর্ না, নইলে ফুল ছুড়ে মারব।'
আমাদেরও হয়েছে সে অবস্থা। আমরা কালোটাকার মালিকদের কোনোভাবেই বাগে আনতে না পেরে দয়া করে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সব টাকা সাদা করার অনুরোধ জানাচ্ছি। অথচ ক্ষমতাসীন দল মাত্র পাঁচমাস আগে তার নির্বাচনি ইশতেহারে অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা দিয়েছিল।
অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে জানিয়ে তখন বলা হয়েছিল: রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরে ঘুষ-দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয় রোধ, ঋণ-কর-বিল খেলাপি ও দুর্নীতিবাজদের বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে শাস্তি প্রদান এবং তাদের অবৈধ অর্থ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।
বেনজীরের দুর্ভাগ্য যে, দুর্নীতি দমন কমিশনের আবেদনে শুধু তার সম্পত্তিই বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দিয়েছেন আদালত।
- বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।