মাথার ওপর ছাদ হলেও শেষ হয়নি সংগ্রাম: টেকসই ভবিষ্যতের খোঁজে আশ্রয়ণ সুবিধাভোগীরা
২০১৭ সালের ভারী বন্যায় লালমনিরহাটের চর গোকুন্ডায় তিস্তা নদীর পানিতে ভেসে যায় আব্দুর রশিদ-ববিতা দম্পতির বাড়ি।
পরে ভাসমান জীবনের অবসান ঘটে তিস্তা পাড়ে জুম্মাপাড়া নতুন কলোনিতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘরে।
ইতোমধ্যে এক ছেলে ও এক মেয়ে সংসারে তৈরি করেছে বাড়তি আয়ের চাহিদা।
স্থায়ী ঠিকানার বন্দোবস্ত হলেও প্রতিনিয়ত তাদের লড়াই করতে হচ্ছে পেশাগত জীবনে। কখনো রাজমিস্ত্রী, ভ্যানচালক আবার কখনোবা দিনমজুর করতে হচ্ছে আব্দুর রশিদকে।
ববিতা বলেন, "উন্নতি করার পথ খুঁজে পাচ্ছি না। মেয়েটার বয়স ১৩ হয়ে গেছে। ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা আর খাওয়া দাওয়ার খরচ মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছি। আবার তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কিছু জমাতেও পারছিনা।"
"২ শতক জমিতে ভিটেমাটি তো চিরস্থায়ী সমাধান না। ৫ বছর পরে সন্তানসন্ততি-নাতিপুতি হলে এখানে তো টেকা যাবে না," যোগ করেন তিনি।
আরেক সুবিধাভোগী নূর আসমা বলেন, "আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হওয়ার জন্য আমরা ২টি ছাগল, ৩টি মুরগী পালন করছি। গরু কেনার চিন্তা আছে। অন্যের জমিতে চাষাবাদ করি। ভিটের পরিসরটা বড় হলে ভালো হতো। দিনরাত খেটে যাচ্ছি, যেন আমার মেয়ে গুলোকে আমার মতো ভাসমান জীবন কাটাতে না হয়।"
"ভবিষ্যতে থাকার জন্য এইটুকু জায়গা যথেষ্ট নয়, এজন্য অর্থ জমানোর চেষ্টা করছি," জানালেন এই সুবিধাভোগী।
৪০ বছর বয়সী আসিয়া বেগম বলেন, "একেবারে রাস্তা থেকে উঠে এসে একটা ঠিকানা পাওয়ায় জীবনে উন্নতি করার ইচ্ছে হয়েছে। এজন্য মানুষের বাসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছি।"
আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূরে আলম সিদ্দিকী দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "২ শতাংশ জমির মালিকানায় স্থায়ী ঠিকানার স্বপ্ন পূরণ হলেও জীবনের লড়াই/সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন হাজারো সুবিধাভোগী। জীবন জীবিকা উন্নতির প্রাণান্তকর চেষ্টা মূলত তাদের সন্তানসন্ততির জন্য টেকসই ভবিষ্যত তৈরি করতে।"
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক ইলিয়াস মেহেদী জানান, সারাদেশে আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং সহধর্মী অন্যান্য কার্যক্রম দ্বারা গৃহ প্রদানের মাধ্যমে মোট ৪৩ লাখ ৩৯ হাজার ৫২০ জন পুনর্বাসিত হয়েছে। সারাদেশে ৫টি পর্যায়ে ১০টি ধাপে ৫৮ জেলার ৪৬৪টি উপজেলার শতভাগ ভূমিহীন-গৃহহীনদের পুনর্বাসন করা হয়েছে।
তিনি জানান, এ বছরের জুন পর্যন্ত মোট ২ লাখ ৫৩ হাজার ১৩০টি গৃহ বরাদ্দ করা হয়েছে।
আদিতমারী উপজেলার সবদল গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা হাফিজুল ইসলাম বলেন, "মাথাগোঁজার জন্য ঘরের ঠাঁই হওয়ায় এখন ছেলেমেয়েদের জন্য ভালো কিছু করার চেষ্টা করি। এজন্য রাস্তার পাশে সাইকেল, ভ্যান ও অটো গাড়ি মেরামতের কাজ করে আয়-রোজগার করছি। বাচ্চাদের পড়ালেখা শেষ করানোর ইচ্ছা আছে।"
একইস্থানে দেখা মেলে পঞ্চাশোর্ধ দুই বিধবা বোন আমিনা ও শামিনা বেগমের। নিঃসন্তান এই দুই বোন লড়াই করছে নিজেদের উন্নতির জন্য।
তারা বলেন, "আমরা একটা সময় ভিক্ষাবৃত্তি করেই জীবন কাটাতাম। এখন একটা আশ্রয় হওয়ায় নিজেরা রান্না করি। গরু ছাগল পালনের জন্য একটু জায়গা আছে। এখন কেউ সাহায্য করলে একটা গরু অথবা ছাগল পালন করতে পারবো।"
আরেক ষাটোর্ধ্ব বিধবা জোবেনা খাতুন জানান, "আমি ও আমার একমাত্র সন্তান জাহেদা দুটি ঘর পেয়েছি। আমার মেয়েও অল্পবয়সে বিধবা হয়েছে। আমার নাতিকে নিয়ে আমি এখানে থাকি, আর মেয়েটা ঢাকায় গেছে আয় রোজগার করতে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। মেয়েকে ভালোভাবে মানুষ করতে একাই সংগ্রাম করছে।"
সুবিধাভোগী বাহার আলী বলেন, "এখানে থাকার পাশাপাশি একটি টং দোকান থেকে মাসে ১৫ হাজার টাকা কামাই হয়। এতে ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি ছেলের পড়ার খরচ জোগাড় হয়। স্বপ্ন দেখি সে পড়াশোনা করলেই আমাদের টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হবে।"