কোকা-কোলার ওপর মানুষ কেন এত ক্ষুব্ধ?
ক্ষুব্ধ লোকেরা রাস্তায় কোকা-কোলার বোতল খালি করছে। পানীয়টি ইসরায়েলের পতাকায় কিংবা টয়লেটে ঢেলে দিচ্ছে। একইসাথে জনপ্রিয় কার্বনেটেড বেভারেজটিকে সিস্টেমেটিক বয়কট করার দাবির সাথে সাথে 'ফ্রি প্যালেস্টাইন' স্লোগান দিচ্ছে।
দৃশ্যগুলো বাইরের কোনো দেশের নয়, বরং বাংলাদেশের। মূলত গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এমন ঘটনা অহরহই দেখা যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে একটা পর্যায়ে গিয়ে বয়কট প্রচারণাটি অনেকটা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল বলে মনে হচ্ছিল। ঠিক সেই সময়েই কোকা-কলার একটি বিজ্ঞাপন যেন অজান্তেই হিতে বিপরীত হয়ে সেই বয়কট প্রচারণাকে ফের উস্কে দিয়েছে।
কোকা-কোলা বাংলাদেশের পানীয়ের জগতে একটি সুপরিচিত ব্র্যান্ড। গত বছর পর্যন্তও এটি সম্পর্কে ভোক্তাদের মাঝে বেশ ইতিবাচক ধারণা ছিল। গত ৭ অক্টোবরের আগে তাদের বেশিরভাগ সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কিন্তু পরে নাটকীয়ভাবে এই অবস্থায় পরিবর্তন ঘটে।
এক্ষেত্রে ভোক্তারা কেবল কোকা-কোলার সমালোচনাই করছে না। বরং পাশাপাশি তারা পানীয়টি বিক্রি করা খুচরা বিক্রেতাদের প্রতিও কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। সেক্ষেত্রে ঐসব খুচরা বিক্রেতাদেরও তারা বয়কটের আহ্বান জানাচ্ছে।
ইসরায়েলের সাথে কোকা-কোলার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক
কোকা-কোলা ১৯৬৬ সাল থেকেই ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক। উদাহরণস্বরূপ, কোকা-কোলার যে ফ্যাক্টরি নিয়ে বিজ্ঞাপনে গর্ব করা হয়েছে সেটি ১৯৬৭ থেকে ১৯৯১ সালে দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
যার ফলে সেই সময়ে আরব লীগ কোকা-কোলাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বয়কট করেছিল। এমনকি ২০২০ সালে দখলকৃত ভূমিতে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক 'কালো তালিকাভুক্ত' করা হয়েছিল।
ইসরায়েল সরকারের অর্থনৈতিক মিশন থেকেও কোকা-কোলার সাথে তেল আবিবের সম্পর্কের গভীরতা অনুমান করা যায়। ১৯৯৭ সাথে ব্র্যান্ডটিকে প্রায় ৩০ বছর ধরে সহযোগিতা করার জন্য সম্মানিত করা হয়।
কোম্পানিটি মার্কিন-ইসরায়েলি চেম্বার অফ কমার্স অ্যাওয়ার্ডসকেও স্পনসর করে। যার মাধ্যমে ইসরায়েলি অর্থনীতিতে অবদান রাখা ব্যবসায়িক গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
এছাড়াও ২০০৯ সালে কোকা-কোলা আইপ্যাকের মাধ্যমে লবিংয়ের জন্য একটি পুরস্কার স্পনসর করেছিল। যেটি যুদ্ধবিরতির জন্য জাতিসংঘের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে এবং গাজায় অব্যাহত সামরিক হামলার সমর্থন দেয়।
কোকা-কোলা বিতর্কিতভাবে ২০০৯ সালে বেন-এলিয়েজারের জন্য একটি বিশেষ সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। যিনি কি-না ছয় দিনের যুদ্ধে ৩০০ জনেরও বেশি মিশরীয় বন্দিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত ছিলেন। এই সংবর্ধনা তৎকালীন সময়ে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়।
ইসরায়েলের সাথে ব্র্যান্ডের বিতর্কিত সব সম্পর্ক নিয়ে নানা প্রশ্ন শুধু বাংলাদেশিদের মনেই নয়, বরং সারা বিশ্বেই প্রাসঙ্গিকভাবে তোলা হয়েছে।
এমনকি চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সভায় কোকা-কোলার সিইও জেমস কুইন্সিকে ব্লুমবার্গ 'ইসরায়েলপন্থি' কোম্পানি হওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল। তিনি এই প্রশ্নটি অনেকটা অস্বস্তি নিয়েই এড়িয়ে গেছেন।
জেমস কুইন্সিক বলেন, "দেখুন, আমি আপনাকে একটি সহজ উদাহরণ দেই। আমাদের ইসরায়েল ও গাজা উভয় স্থানেই বোতল প্রস্তুতের ফ্যাক্টরি রয়েছে। অর্থাৎ আমরা প্রায় প্রতিটি দেশের ব্যবসা করছি।"
বাংলাদেশে কোকা-কোলার বিতর্কিত বিজ্ঞাপনটি আন্তর্জাতিকভাবেও নজর কেড়েছে। আল-জাজিরা, মিডল ইস্ট আই ও দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট (ইউকে) এর মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়া আউটলেটও খবরটি কভার করেছে।
যুদ্ধের ক্ষেত্রে কোকা-কোলার প্রতিবাদী অবস্থানও বেশ নির্বাচনমূলক বলে মনে হয়। কেননা কোম্পানিটি ইউক্রেন যুদ্ধের রেশ ধরে ২০২২ সালের মার্চ মাস থেকে রাশিয়ায় নিজেদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের হামলা অব্যাহত থাকলেও সেখানে যথারীতি ব্যবসা চালিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি।
কোকা-কোলার প্রধান শেয়ারহোল্ডাররা প্রকৃতপক্ষে ইজরায়েলপন্থী। এটিতে তিনটি কোম্পানির ভোটের ক্ষমতা ৫ শতাংশেরও বেশি। এগুলো হচ্ছে বার্কশায়ার হ্যাথওয়ে ইনকর্পোরেটেড (৯ ভাগ), ভ্যানগার্ড গ্রুপ ইনকর্পোরেটেড (৯ ভাগ) ও ব্ল্যাকরক ইনকর্পোরেটেড (৭ ভাগ)।
ওয়ারেন বাফেটের বার্কশায়ার হ্যাথওয়ের ইসরায়েলকে উল্লেখযোগ্যভাবে সমর্থন করার জন্য তার আর্থিক প্রভাব ব্যবহার করার ট্র্যাক রেকর্ড রয়েছে। এটি ২০০৬ সালে ৪ বিলিয়ন ডলারে ইসরায়েলি কোম্পানি ইসকারের ৮০ ভাগ শেয়ার ক্রয় করে। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে ২ বিলিয়ন ডলারে অবশিষ্ট ২০ ভাগ শেয়ার অধিগ্রহণ করে। বাফেট ইসরায়েলি বন্ডের বেশ শক্তিশালী প্রচারক এবং তেভা ফার্মাসিউটিক্যালস-এর মতো ইসরায়েলি কোম্পানিতে বড় বিনিয়োগ করেছেন। সম্প্রতি তিনি বেন-গুরিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০০ মিলিয়ন ডলার দান করেছেন।
বাফেট নিজেকে একজন নিরপেক্ষ জায়োনিস্ট হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, "আমি ইসরায়েলী বন্ডের মালিক হতে পেরে আনন্দিত।"
বাফেট ইসরায়েল সম্পর্কে আরও বলেন, "আমি ইসরায়েলের পুরো ৭০ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী। আমি বিশ্বাস করি এটি বিশ্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দেশগুলির মধ্যে একটি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সবসময় একসাথে থাকবে। এটি বেশ ইতিবাচক যে, যুক্তরাষ্ট্রের পাশে ইসরায়েল এবং ইসরায়েলের পাশে যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে।"
এদিকে ব্যাকরক-এর সিইও ল্যারি ফিঙ্ক মার্কিন ক্যাম্পাসে ফিলিস্তিনিপন্থী শিক্ষার্থীদের প্রতি নিন্দা প্রকাশকে সমর্থন করেন।
বাইডেন প্রশাসন ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকিস্বরূপ গত বছর অঞ্চলটিতে একটি পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন বিমানবাহী রণতরি মোতায়েন করেছিল। তখন ফিঙ্ক এটিকে 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি শক্ত জবাব' বলে অভিহিত করেছিলেন।
সেক্ষেত্রে গত বছরের ১০ নভেম্বর তারিখে নিউইয়র্কে ব্ল্যাকরকের সদর দফতরের লবি দখল করেছিল আন্দোলনকারীরা। বিক্ষোভকারীদের দাবি, ব্ল্যাকরকের ইসরায়েলে যথেষ্ট বিনিয়োগ রয়েছে। একইসাথে তাদের লকহিড মার্টিন, আরটিএক্স, নর্থরপ গ্রুম্যান, বোয়িং ও জেনারেল ডাইনামিক্সের মতো কোম্পানিগুলিতেও যথেষ্ট বিনিয়োগ রয়েছে। যেগুলি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষে ব্যবহৃত অস্ত্র উৎপাদনের সাথে জড়িত।
ভ্যানগার্ডের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তাদের নানা অস্ত্র কোম্পানিতে বড় রকমের শেয়ার রয়েছে যারা কি-না ইসরায়েলের গণহত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র বিক্রি করে।
কোকা-কোলা কেন ক্রমবর্ধমান বয়কট প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু?
বয়কট প্রচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রধান যুক্তি হলো, অন্যান্য নামিদামি ব্র্যান্ডও রয়েছে যেগুলি কোনো না কোনোভাবে ইসরায়েলের সাথে যুক্ত।
এক্ষেত্রে ম্যাকডোনাল্ডস ও স্টারবাকসও বিশ্বব্যাপী ব্যাপক বয়কটের কবলে পরেছে। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশে এগুলোর কার্যক্রম নেই, তাই দেশে একমাত্র প্রধান ব্র্যান্ড হিসেবে কোকা-কোলাই বয়কটের মুখোমুখি হয়েছে। এমনকি পেপসিকো, সোডাস্ট্রিমের মালিক এবং সাবরারও ইসরায়েলের গাজার দখলদারিত্ব থেকে লাভবান হয়েছে।
এক্ষেত্রে ইসরায়েলি খাদ্য প্রস্তুতকারক ওসেমেতে নেসলের বড় ধরনের শেয়ার রয়েছে। এটি দখলকৃত ফিলিস্তিনে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করে।
এক্ষেত্রে সম্ভবত কোকা-কোলার বিরুদ্ধে বিশেষ করে অসন্তোষের কারণ হল ব্র্যান্ডটির পরিচিতি। ভোক্তারা একটি কোম্পানিকে সফল ব্র্যান্ড হিসেবে মনে করে যখন তারা খুব সহজেই তা শনাক্ত করতে পারে। কোকা-কোলা সেই দিক থেকে এতটাই সফল যে, নামটি আমাদের দেশের সমস্ত কার্বোনেটেড বেভারেজের সমার্থক।
যখন কেউ সোডা পানীয় পান করতে চায়, তখন তারা শুধু বলেন যে, 'কোক খাবো'। এমনকি কেউ পেপসি, মোজো বা অন্যান্য পানীয় খেলেও একই কথা বলে থাকেন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে কোকা-কোলা একটি সুপরিচিত ব্র্যান্ড।
দেশে কোকা-কোলার বিক্রিও ব্যাপক। এক কথায়, কার্বোনেটেড বেভারেজ বিক্রির দিক থেকে এটি শীর্ষস্থানে রয়েছেন। অতএব, কোকা-কোলা বয়কটের প্রভাব বিশ্বব্যাপী বেশ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে ও অনুভূত হচ্ছে।
কোকা-কোলা মূলত আমেরিকান কোম্পানি হিসেবে নিজেদের পরিচিত করিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে দেশটিও ইসরায়েলকে একতরফাভাবে সমর্থনের জন্য বর্তমানে জোরালো সমালোচনার মধ্যে রয়েছে। সেক্ষেত্রে আমেরিকার পণ্য হিসেবে কোকা-কোলাও মানুষের মনে নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছে।
এছাড়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশে বাজারে কোকা-কোলার শক্তিশালী বিকল্প হিসেবে রয়েছে মোজো। পানীয়টি ফিলিস্তিনি পক্ষে বেশ সোচ্চার। তাই এটির বোতলে ফিলিস্তিনি পতাকা মুদ্রিত 'উই সাপোর্ট প্যালেস্টাইন' লেখা রয়েছে। একইসাথে দেশের একটি বড় ব্যবসায়িক সংগঠন আকিজ গ্রুপ মোজোর মালিক।
অতএব, দেশে ভোক্তাদের কাছে কোকাকোলার একটি সহজ বিকল্প রয়েছে। যদিও এই বয়কট কোকা-কোলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও ফাইভারের ক্ষেত্রে এমনটা হচ্ছে না। এটি একটি ইসরায়েলি আউটসোর্সিং কোম্পানি যা অনেক বাংলাদেশির আয়ের গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
বিশ্বের অন্য প্রান্তের বয়কটও জনগণকে এসব উদ্যোগ নিতে অনুপ্রাণিত করে। যেমন, গত বছর তুর্কি সংসদের ক্যাফেটেরিয়া থেকে কোকাকোলা সরিয়ে ফেলা হয়। তুর্কি এয়ারলাইনসও একই পথ অনুসরণ করে। এইভাবে জনগণের মধ্যে একটি দৃঢ় ধারণা জন্মায় যে, এই উদ্যোগে তারা একা নয়। এভাবে বর্জনের বিষয়টি দ্বিগুণ মাত্রা লাভ করেছে।
মার্কেট রিসার্চ অনুসারে, সম্প্রতি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে কোকা-কোলার বিক্রয় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। কোম্পানিটি দেশের বাজারের অন্তত ২৩ ভাগ শেয়ার হারিয়েছে। এর আগে কোম্পানিটি বাংলাদেশের কার্বোনেটেড বাজারের ৪২ শেয়ার নিয়ে বেশ শক্তিশালী অবস্থানে ছিল।