‘বিলুপ্তির পথে’ ক্যারাম বোর্ড শিল্প!
চট্টগ্রাম নগরীর চৌমুহনীর কামারপাড়ায় ছোট্ট একটি কক্ষে ক্যারাম বোর্ড তৈরি করেন মো. শাহাজাহান। বর্তমানে সপ্তাহে ২০-৩০টি বোর্ড তৈরি করেন তিনিসহ দুজন। অথচ এক দশক আগেও ৬-৭ জন জনবল দিয়ে শাহাজাহানের ক্যারামের কারখানায় সপ্তাহে ১৫০-২০০টি ক্যারাম বোর্ড তৈরি হতো।
স্বাধীনতার আগে থেকেই বাংলাদেশ অঞ্চলে ক্যারাম শিল্প হিসেবে দাঁড়িয়েছিল। মোবাইল ফোনের নির্ভরশীলতার কারণে ক্যারাম খেলা প্রচলন দিন দিন কমছে। আর শাহাজাহানের কারখানার চিত্র-ই বলে দিচ্ছে একসময়ের জমজমাট শিল্পটি কেমন সংকুচিত হয়েছে। এ খাতের কাঁচামাল; কাঠ, বোর্ড, রং এবং শ্রমব্যয়ের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা কমায় অনেকটা বিলুপ্তির পথে হাঁটছে শিল্পটি। রয়েছে কারিগর সংকটও। উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে কারিগর; অনেকে পেশাও পরিবর্তন করেছেন ইতোমধ্যে।
শাহাজাহান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দুজন মিলে সপ্তাহে বড়-ছোট ৩০-৪০টি ক্যারাম বোর্ড তৈরি করলে সর্বসাকুল্যে ২৪ হাজার টাকা বিক্রয় মূল্য পাই। যেন একেবারে কোনোরকমে চলা! প্রায় ২৫ বছর এই ব্যবসায়ে আছি।"
শহর কিংবা গ্রামের একসময় বেশিরভাগ বাড়িতেই ক্যারাম খেলার আয়োজন ছিল। গ্রামে চায়ের দোকানের পাশে ক্যারাম বোর্ড বসিয়েও খেলার ব্যবস্থা থাকত। মানুষের বিনোদন মোবাইল বা ডিজিটাল ডিভাইসকেন্দ্রিক হওয়ার পর ধীরে ধীরে ক্যারামের চাহিদা কমতে থাকে। বিশেষ করে করোনা মহামারির পর থেকে শিল্পটি একেবারেই ধসের মুখে।
এ খাতের উদ্যোক্তা ও সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, একসময় ঢাকার সিদ্দিক বাজার, গুলিস্তান, পুরান ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গায় প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে দুই শতাধিক ক্যারাম বোর্ডের কারখানা ছিল। বর্তমানে ঢাকায় ৩০-৩৫টি, চট্টগ্রামে ৬টি, চাঁদপুরে ৩টি, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গায় ৮টি করে কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় মাসে সাড়ে পাঁচ থেকে সাড়ে ছয় হাজার ক্যারাম বোর্ড তৈরি হয়। প্রায় তিন শতাধিক জনবল কর্মরত রয়েছে এগুলোতে। কারখানা পর্যায়ে দেড় থেকে দুই কোটি টাকার ক্যারাম তৈরি হয় মাসে।
চট্টগ্রাম নগরীর কাজির দেউড়ি স্টেডিয়াম পাড়ায় ও রিয়াজউদ্দিন বাজারের ক্রীড়া সামগ্রীর অর্ধশতাধিক দোকানের একসময়ের প্রধান পণ্য ছিল ক্যারাম বোর্ড। স্টেডিয়াম পাড়ার গ্রিন স্পোর্টসের পরিচালক ইয়াসিন ভূইয়া টিবিএসকে বলেন, "ক্যারাম বোর্ড বিক্রি করেই আমরা এখানে দোকান কিনেছি। গ্রামে বাড়ি করেছি। ১০-১২ বছর আগে মাসে ৩০০-৫০০ ক্যারাম বোর্ড বিক্রি করতাম। এখন কম চলে। রমজানের পর গত ২৫ দিনে মাত্র দুটি বোর্ড বিক্রি করেছি।"
চাঁদপুরের পাটোয়ারীর হাতে প্রসার
স্বাধীনতার আগে ঢাকার ছিদ্দিক বাজারে কারখানা ছিল পাকিস্তানি নাগরিক লালাজির। সেখানে চাকরি করতেন চাঁদপুরের কচুয়ার উপজেলার রহিমানগরের বাসিন্দা ইউসুফ পাটোয়ারী। দেশ স্বাধীনের পর কারখানাটি নতুন করে চালু করেন ইউসুফ।
এরপর তার ভাই, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে আবদুল মোমেন পাটোয়ারী, আবদুল হক পাটোয়ারী, আবু তাহের পাটোয়ারী, আবদুল মোমেন ব্যাপারী, খলিলুর রহমান যুক্ত হন ক্যারাম বোর্ড শিল্পে। তাদের হাত ধরেই প্রসার ঘটে শিল্পটির। ঢাকা, চাঁদপুর ও চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে কারখানা। কারিগর-শ্রমিকেরা নিজ উদ্যোগে কারখানা স্থাপন করলে এ খাত প্রসারিত হতে থাকে।
ক্যারাম কারখানার শুরুর দিকের উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রায় সবাই মারা গেছেন। তাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের কেউ কেউ ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন। প্রথম দিকের উদ্যোক্তা আবু তাহের পাটোয়ারীর ভাই খলিলুর রহমান চট্টগ্রাম নগরীর ঈদগা এলাকায় 'কে রহমান' নামে ক্যারামের কারখানা করেছিলেন ১৯৯০ সালের পর। ২০১২ সালে কারখানাটি বন্ধ হলেও এখানকার কারিগররা এখনো চট্টগ্রামে ক্যারামের কারখানা ধরে রেখেছেন।
কাজির দেউড়ি স্টেডিয়াম পাড়ার ওকে স্পোর্টসের খলিলুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "ইউসুফ পাটোয়ারীর ভাই, চাচাতো ভাইসহ আত্মীয়স্বজনদের হাত ধরে প্রসার ঘটে। ২০০০ সালের পর এ খাতে জৌলুস ছিল। তখন কারখানায় ২৮-৩০ জনও শ্রমিক ছিলেন। দৈনিক এক গাড়ি অর্থাৎ ৩০০টি ক্যারাম তৈরি হতো।"
তিনি বলেন, অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে কাঠসহ কাঁচামাল ও শ্রমের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্যারামের মূল্য বাড়েনি। এ কারণে ছিটকে পড়তে হয়। বর্তমানে অন্যান্য ক্রীড়া সামগ্রীর দোকান দিয়ে ব্যবসা চলছে।
চাঁদপুরের এ রহিম ক্যারামের স্বত্বাধিকারী আবদুর রহিম টিবিএসকে বলেন, "জেলার হাজীগঞ্জে মাত্র ৩টি ক্যারামের কারখানা আছে। করোনার আগেও ৮-১০টি ছিল।"
সুবিধা ও মানের কারণে কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গায় থিতু
এখনও যেটুকু ক্যারাম বোর্ড ব্যবসা চলছে, এর বেশিরভাগ কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গার। মানের দিক থেকে ভালো ও টেকসই এসব ক্যারামের কারণে ছিটকে পড়েছে চাঁদপুর ও চট্টগ্রামের ক্যারাম বোর্ড। মূলত ২০০০ সালের পর থেকে শুরু দক্ষিণবঙ্গের ক্যারামের আধিপত্য।
চাঁদপুরের বাসিন্দা খালেক দেওয়ান ও রাজ্জাক দেওয়ানসহ তারা চার ভাই পুরো পরিবার নিয়ে কুষ্টিয়ায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন তখন। তাদের হাত ধরে এ জেলায় ক্যারাম বোর্ডের কারখানা শুরু হয়। এরপর তা পাশ্ববর্তীয় চুয়াডাঙ্গায়ও পৌঁছে যায়।
উদ্যোক্তা ও কারিগরদের তথ্যমতে, কম দামে ভালো মানে কাঠের সহজলভ্যতা, শ্রমের স্বল্প মূল্যের কারণে কম খরচে ক্যারাম বোর্ড তৈরি করা যায় কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গায়। যেমন, যে কাঠ চট্টগ্রাম-চাঁদপুরে প্রতি ফুট এক হাজার টাকায় কিনতে হয়, তা দক্ষিণবঙ্গে অর্ধেক দামে ৫০০ টাকায় পাওয়া যায়। আর চট্টগ্রামে গড়ে একজন শ্রমিকের পেছনে দৈনিক ৮০০-১০০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। সেখানে দক্ষিণবঙ্গে প্রধান কারিগরের দৈনিক মজুরি সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা।
এছাড়া দক্ষিণবঙ্গের কারিগরেরা ক্যারামে নতুনত্বও এনেছেন। ভালো মানের গেওয়া, মেহগনি, আকাশি কাঠ ব্যবহার করেন তারা। আর বোর্ডের ক্ষেত্রেও গর্জন, মেলামাইন বা পেস্টিংয়ের প্রচলন এনেছেন তারা। পানি পড়লেও সহজে নষ্ট হয় না এসব বোর্ড।
চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর ক্যারাম বোর্ড প্রস্তুতকারক মো. আল-আমিন টিবিএসকে বলেন, "আমরা খরচের কারণে পোষাতে পারি না। দক্ষিণবঙ্গের কাঁচামাল ও শ্রমের মূল্য কম। তাদের তৈরি ক্যারাম বোর্ড ৬-৮ বছর টিকে। কেউ একবার কিনলে, অনেক বছর কিনতে হয় না।"
মূলত ছোট ও কম দামের ক্যারামগুলো চট্টগ্রাম থেকে নেওয়া হয়। মাঝারি-বড় ও ভালো মানের ক্যারাম নেওয়া হয় দক্ষিণবঙ্গ থেকে বলে জানান তিনি।
কুষ্টিয়ার এসবিএ ক্যারামের স্বত্বাধিকারী এফএম আজিম কবির টিবিএসকে বলেন, "প্লাই বোর্ডের তৈরি ক্যারাম আমরা দুই বছরের গ্যারান্টি দিয়ে বিক্রি করি। এ কারণে আমাদের পণ্য বেশি চলে।"
সহজ পন্থায় তৈরি, অসম প্রতিযোগিতা
বাজারের ২৮, ৩০, ৩৪, ৩৮, ৪২, ৪৫, ৪৮, ৫০ ও ৫৬ ইঞ্চি সাইজের ক্যারাম বোর্ডের প্রচলন আছে। সর্বনিম্ন ৪০০ টাকা থেকে শুরু করে ১৪ হাজার টাকা দামেরও ক্যারাম আছে। সাইজের পাশাপাশি মানের তারতম্যে দামের পার্থক্য হয়। ক্যারামের গুটি আসে নারায়নগঞ্জের কয়েকটি কারখানা ও চীন থেকে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, সহজপন্থায় ক্যারাম তৈরি হয় বলে কারিগর থেকে শ্রমিক; সবাই নিজ উদ্যোগে কারখানা গড়ে তুলতে থাকেন। ফলে কম দামের সরবরাহের প্রতিযোগিতা বাড়তে থাকে।
কুষ্টিয়ার এসবিএ ক্যারামের স্বত্বাধিকারী এফএম আজিম কবির বলেন, "কোনো ভারী যন্ত্র ছাড়াই ক্যারাম বানানো যায়। ফলে কারিগররা বেশিদিন কারখানায় কাজ না করে স্বাধীনভাবে ক্যারাম তৈরি করে সরবরাহ করেন। বিক্রির জন্য দাম কমিয়ে দেন। ফলে অন্যদেরও কম দামে বিক্রি করতে হয়।"
"আর ক্যারাম ধীরগতির পণ্য হওয়ায় নগদ টাকার ব্যবসা। টাকা আটকে গেলে, এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গিয়ে তা আদায় করা যায় না," বলেন এ ব্যবসায়ী।
চট্টগ্রামের প্রথম ক্যারাম বোর্ড প্রস্তুতকারক খলিলুর রহমান বলেন, কারিগররা ঝামেলার কারণে তিনি এ কারখানাটি বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
"ঠিকমতো কারিগর পাওয়া যেত না। পাওয়া গেলেও বেশিদিনি টিকত না। নিজেরা কারখানা শুরু করতো। পণ্য বিক্রির জন্য দোকানে গিয়ে দাম কমিয়ে দিত। এভাবে খরচ পোষাতে না পেরে কারখানা বন্ধ করে দেই," বলেন তিনি।